বর্তমান বিশ্বের বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভূখণ্ড হচ্ছে গোলান মালভূমি। ক্ষুদ্র এই পাথুরে উচ্চভূমির অধিকার নিয়ে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম এশিয়ার ‘লেভান্ট’ অঞ্চলে অবস্থিত দুটি রাষ্ট্র সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী, গোলান মালভূমির সম্পূর্ণ অংশ সিরিয়ার ভূমি। কিন্তু কার্যত গোলানের দুই–তৃতীয়াংশ ভূমি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অঞ্চলটি ইসরায়েল কার্যত অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র ইসরায়েল কর্তৃক গোলান অঙ্গীভূতকরণকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি।
গোলান মালভূমির মোট আয়তন প্রায় ১,৮০০ বর্গ কি.মি.। অঞ্চলটির উত্তরে মাউন্ট হেরমনসহ অ্যান্টি–লেবানন পর্বতমালা, পূর্বে ওয়াদি রাক্কাদ, দক্ষিণে ইয়ারমুক নদী এবং পশ্চিমে গ্যালিলি সাগর ও হুলা উপত্যকা অবস্থিত। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৬৭ সালের জুনে আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় ইসরায়েল গোলান মালভূমির পশ্চিমাংশ (গোলানের দুই–তৃতীয়াংশ ভূমি) দখল করে নেয়। গোলানের পূর্বাংশের ওপর সিরীয় কর্তৃত্ব বজায় থাকে। যুদ্ধের পর ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিনিময়ে সিরিয়ার নিকট গোলানের অধিকৃত অংশ ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে, কিন্তু সিরিয়া এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় সিরিয়া ইসরায়েলের কাছ থেকে গোলানের হারানো অংশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে দক্ষিণ গোলানের অংশবিশেষ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যুদ্ধে সিরিয়া পরাজিত হয় এবং তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৭৪ সালে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল অধিকৃত গোলানের ৫% ভূমি সিরিয়ার নিকট হস্তান্তর করে, কিন্তু হস্তান্তরকৃত ভূমিকে স্থায়ীভাবে অসামরিকীকৃত (demilitarized) রাখার শর্ত জুড়ে দেয়।
চুক্তি অনুযায়ী, গোলান মালভূমিতে একটি ৪০০ বর্গ কি.মি. বিস্তৃত ‘অসামরিকীকৃত অঞ্চল’ (demilitarized zone) স্থাপিত হয় এবং এই অঞ্চলের সিরীয়–নিয়ন্ত্রিত ও ইসরায়েলি–নিয়ন্ত্রিত অংশে কোনো প্রকার সামরিক উপস্থিতি রাখা যাবে না বলে ঠিক হয়। তদুপরি, অসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই অসামরিকীকৃত অঞ্চলের পশ্চিমে ও পূর্বে উভয় দিকে ২৫ কি.মি. অঞ্চল পর্যন্ত মোতায়েনকৃত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বর্তমানে গোলান মালভূমির প্রায় ১,২০০ বর্গ কি.মি. ভূমি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন এবং প্রায় ৬০০ বর্গ কি.মি. ভূমি সিরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। সিরীয়–নিয়ন্ত্রিত ভূমির অভ্যন্তরে ২৩৫ বর্গ কি.মি. বিস্তৃত একটি ‘নিরপেক্ষ অঞ্চল’ (buffer zone) রয়েছে, এবং এখানে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য ‘জাতিসংঘ অসংযোগ পর্যবেক্ষণ বাহিনী’ (United Nations Disengagement Observer Force) মোতায়েনকৃত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, গোলান মালভূমির সম্পূর্ণ অংশ সিরীয় ভূমি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে এবং অঞ্চলটিকে সিরিয়ার নিকট প্রত্যর্পণ করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু ইসরায়েল এই আহ্বান অগ্রাহ্য করে এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকেই গোলানের দখলকৃত অঞ্চলে ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু করে। ইসরায়েল কর্তৃক গোলান দখলের পর অঞ্চলটি থেকে ৬০,০০০ থেকে ১,৩০,০০০ নাগরিক সিরীয়–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে পালিয়ে যায়। ইসরায়েলি সরকার গোলানে বসবাসরত অবশিষ্ট সিরীয় নাগরিকদের ইসরায়েলি নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ প্রদান করে, কিন্তু তাদের সিংহভাগ এই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে। বর্তমানে গোলানের ইসরায়েলি–অধিকৃত অংশে প্রায় ২৬,০০০ ইহুদি বসতি স্থাপনকারী এবং প্রায় ২০,০০০ সিরীয় নাগরিকের বসবাস।
১৯৮১ সালে ইসরায়েলি আইনসভায় ‘গোলান মালভূমি আইন’ (Golan Heights Law) অনুমোদিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গোলানের অধিকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলি আইনের প্রয়োগ আরম্ভ হয়। অর্থাৎ, কার্যত ইসরায়েল ভূখণ্ডটি নিজেদের রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করে নেয়। অবশ্য ইসরায়েলি সরকার এই আইনে ভূখণ্ডটি আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করে নেয়ার কথা উল্লেখ করেনি, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ইসরায়েল কর্তৃক কার্যত গোলান দখলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৯০–এর দশকে গোলানের অধিকৃত অংশ সিরিয়াকে প্রত্যর্পণ ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ইসরায়েল সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয়, কিন্তু এই আলোচনা ব্যর্থ হয়।
২০১১ সালে সিরীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর গোলানের সিরীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশ একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অঞ্চলটিতে সিরীয় সরকার ও বিদ্রোহী দলগুলোর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ সংঘটিত হয়, কিন্তু ২০১৮ সাল নাগাদ সিরীয় সরকারি বাহিনী গোলানের সিরীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এদিকে ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলি ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এর মধ্য দিয়ে অঞ্চলটির ওপর ইসরায়েলি দাবি জোরদার হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিরিয়া সম্পূর্ণ গোলান মালভূমির মালিকানা দাবি করে আসছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ইসরায়েল কর্তৃক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অধিকৃত ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার নজির রয়েছে। মিসরের কাছ থেকে অধিকৃত বিশাল সিনাই উপদ্বীপকে ইসরায়েল মিসরের কাছে প্রত্যর্পণ করেছিল। অনুরূপভাবে, ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের কাছে তারা গাজা ভূখণ্ড ও পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ হস্তান্তর করেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই ইসরায়েল শান্তিচুক্তির বিনিময়ে ভূমি হস্তান্তর করেছে। কৌতূহলের ব্যাপার এই যে, গোলান মালভূমি ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েল কেন অনুরূপ নীতি অনুসরণ করল না? বস্তুত, ইসরায়েলের জন্য গোলান মালভূমি খুবই প্রয়োজনীয় এবং এজন্য ইসরায়েল এই ভূখণ্ডটি সিরিয়ার নিকট প্রত্যর্পণ করতে ইচ্ছুক নয়।
প্রথমত, গোলান মালভূমি সামরিক ও ভূকৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উচ্চভূমি থেকে জর্দান নদীর উপত্যকা, ইসরায়েলের গ্যালিলি অঞ্চল এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কার্যত গোলান মালভূমি থেকে দামেস্ক মাত্র ৬০ কি.মি. দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ, গোলানে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলে সম্ভাব্য সিরীয়–ইসরায়েলি যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসরায়েলিরা সহজেই দামেস্ক পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সিরিয়ার কেন্দ্রবিন্দুকে হুমকির সম্মুখীন করতে পারবে। ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে, গোলানের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ সম্ভাব্য সিরীয় ‘আগ্রাসনে’র ক্ষেত্রে ‘নিবারক’ (deterrent) ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে, গোলান যদি সিরিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে সিরিয়ার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ হয়ে যাবে।
‘জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি’র প্রেসিডেন্ট এফ্রাইম ইনবারের মতে, গোলান মালভূমি ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠ উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিরক্ষা রেখা। পূর্ব দিক (অর্থাৎ) সিরিয়া থেকে আক্রমণকারী যে কোনো সৈন্যদল গোলান অতিক্রম করা ব্যতীত ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারবে না। গোলান যেহেতু উচ্চভূমি, এজন্য আক্রমণকারীদেরকে পার্শ্ববর্তী নিচু ভূমি থেকে ক্রমশ গোলানের উঁচু ভূমির দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং দখল করতে হবে। উচ্চস্থানে অবস্থান গ্রহণকারী ইসরায়েলি সৈন্যদল এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে, কারণ নিচু স্থান থেকে আক্রমণ চালিয়ে উঁচু স্থান দখল করে নেয়া খুবই কঠিন কাজ।
১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের নিকট সিরিয়ার পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ। গোলানের উচ্চভূমিতে মোতায়েনকৃত ১৭৭টি ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক উঁচু স্থানে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে নিচু ভূমি থেকে অগ্রসরমান ১,৫০০টি সিরীয় ট্যাঙ্ককে যথেষ্ট সময় আটকে রাখতে পেরেছিল, এবং এর ফলে ইসরায়েল গোলান ফ্রন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণে অতিরিক্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণের সময় ও সুযোগ পেয়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘এলিমেন্ট অফ সারপ্রাইজ’-এর সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও সিরিয়া যুদ্ধে পরাজিত হয়।
শুধু তা-ই নয়, গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের কারণে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ইসরায়েলের হাইফা উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তাও জোরদার হয়েছে। হাইফা উপসাগর অঞ্চলটি ইসরায়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অঞ্চল এবং হাইফা সমুদ্রবন্দর ইসরায়েলের দুটি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে একটি। অঞ্চলটি ইসরায়েলের কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম–হাইফা–গেদেরা ত্রিভুজের অংশ, এবং এই ত্রিভুজ অঞ্চলে ইসরায়েলের জনসংখ্যা ও অবকাঠামোর সিংহভাগ অবস্থিত। গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে হাইফা উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে সিরীয় সামরিক বাহিনীর নিকটতম অবস্থানের দূরত্ব প্রায় ৯০ কি.মি. বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এতদঞ্চলকে সম্ভাব্য সিরীয় হুমকি থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রেখেছে।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল যদি গোলানের নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যদের গোলান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০ মিটার নিচু একটি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এরপর যদি সিরিয়া গোলান থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালায়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যদের জন্য এই আক্রমণ প্রতিহত করা কিংবা গোলান পুনর্দখল করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বলা বাহুল্য, ইসরায়েল স্বেচ্ছায় এরকম অসুবিধাজনক অবস্থানে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের জন্যও গোলান মালভূমির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। উত্তর গোলানে অবস্থিত মাউন্ট হেরমনের একটি চূড়া ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন। এটি ইসরায়েলের জন্য সিরিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাকে দারুণ সহজ করে দিয়েছে। এখান থেকে ইসরায়েলিরা সিরিয়ার একেবারে ভিতরের অংশ পর্যন্ত বৈদ্যুতিক নজরদারি (electronic surveillance) চালাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল সিরীয় সশস্ত্রবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে এবং সম্ভাব্য সিরীয় আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা আগেই সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে এখান থেকে ইসরায়েলিরা সহজেই সিরীয় লক্ষ্যবস্তুগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছু কিছু ইসরায়েলি বিশ্লেষকের মতে, বর্তমানে ‘এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমস’ এবং চালকবিহীন আকাশযান (ড্রোন) ব্যবহার করেও সিরিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব, এবং এজন্য এখন আর গোলানে অবস্থিত ইসরায়েলি গোয়েন্দা ঘাঁটির আগের মতো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু এগুলো বড় অ্যান্টেনার মতো ভারী যন্ত্রপাতি বহন করতে পারে না এবং বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবহার করে এগুলোকে ভূপাতিত করা সম্ভব। তদুপরি, তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি আকাশে থাকতে ও তথ্য সরবরাহ করতে পারে না, এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে এদের কার্যকারিতা আরো হ্রাস পেতে পারে। অনুরূপভাবে, গোয়েন্দা স্যাটেলাইটগুলো সিরীয়দের স্থিতিশীল ঘাঁটিগুলো সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারে, কিন্তু ‘ট্যাকটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স’ সরবরাহ করতে পারে না। গোলানে অবস্থানরত ইসরায়েলি গোয়েন্দা ঘাঁটিটির ক্ষেত্রে এরকম কোনো সমস্যা নেই এবং এজন্য এটি ইসরায়েলের দৃষ্টিতে বেশি কার্যকরী ও প্রয়োজনীয়।
তৃতীয়ত, ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে, সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য গোলানের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা আবশ্যক। উল্লেখ্য, আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বের ‘ফ্রন্টলাইন রাষ্ট্র’গুলোর মধ্যে সিরিয়াই একমাত্র রাষ্ট্র, যেটি এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের পর থেকে সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে আর কোনো গুরুতর সংঘর্ষ হয়নি। এমনকি ১৯৮২ সালে লেবাননে সিরীয় ও ইসরায়েলি সৈন্যরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলেও সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। গোলান মালভূমি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকায় এতদঞ্চলে যুদ্ধ করা সিরিয়ার জন্য সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত কঠিন, এবং এজন্যই সিরিয়া আর এই অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে নি বলে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা। সহজ ভাষায়, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি না হওয়ার পরেও গোলানে ইসরায়েলি আধিপত্য এই ফ্রন্টকে শান্ত রেখেছে।
সিরীয় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর ইসরায়েলিদের নিকট এই ফ্রন্টে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গোলানের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরিয়া ও ইসরায়েল প্রতিবেশী রাষ্ট্র, কিন্তু সিরীয় গৃহযুদ্ধ যেরকমভাবে লেবাননের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেরকমটা ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও ঘটুক, এমনটা ইসরায়েলিরা চায় না। গোলানের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের কারণে সিরীয় গৃহযুদ্ধ ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে থেকেছে, এবং যেহেতু সিরিয়ায় সহসা শান্তি স্থাপিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেহেতু গোলানের ‘স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী’ ভূমিকা ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থত, ইরানি–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষকরা গোলানের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ওপর আরো জোর দিচ্ছেন। ইরানি–সমর্থিত লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ ও গাজাভিত্তিক হামাস ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানকে দুইটি ফ্রন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। সিরীয় গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার ওপর ইরানি প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইরানি ‘বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’ ও ইরানি–সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া সিরিয়ায় বহুসংখ্যক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যেই গোলানের ইসরায়েলি–নিয়ন্ত্রিত অংশে রকেট হামলা পরিচালনার জন্য ইসরায়েল ইরান ও ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়াগুলোকে দায়ী করেছে।
ইসরায়েলিদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এখন যদি গোলান মালভূমিকে সিরিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয়, সেক্ষেত্রে গোলানে ইরানি ঘাঁটি স্থাপিত হবে এবং সেটি ইসরায়েলের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি হিসেবে কাজ করবে। ইসরায়েলি সীমান্তের কাছাকাছি ইরানি সামরিক উপস্থিতি সহ্য করতে ইসরায়েল প্রস্তুত নয় এবং এজন্য বিগত কয়েক বছরে তারা সিরিয়ায় ইরানি বা ইরানি–নিয়ন্ত্রিত সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর শত শত আক্রমণ চালিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল কোনোক্রমেই গোলানকে সিরিয়ার নিকট ফিরিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। ইসরায়েলিদের ভাষ্য অনুযায়ী, গোলান ফিরে পেতে হলে এর পূর্বশর্ত হিসেবে সিরিয়াকে তাদের ভূমি থেকে সমস্ত ইরানি ঘাঁটি অপসারণ করতে হবে। বলাই বাহুল্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই শর্ত পূরণ করা সিরীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
পঞ্চমত, গোলানের সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকেও এটি ইসরায়েলের জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ। এরকম একটি দিক হচ্ছে পানি সরবরাহ। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের পানি সঙ্কট বা পানির ঘাটতি বিদ্যমান এবং ইসরায়েলও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসরায়েলের মোট পানি সরবরাহের এক–তৃতীয়াংশ আসে গোলান মালভূমি থেকে। বলাই বাহুল্য, ইসরায়েলি জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে গোলানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় ইসরায়েল যদি সিরিয়ার কাছে গোলান ফিরিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের পানি সরবরাহের একটি বড় অংশ সিরিয়ার হাতে চলে যাবে। ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকরা এরকম ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন।
ষষ্ঠত, গোলান মালভূমি দখলের পর থেকেই ইসরায়েল অঞ্চলটি খনিজদ্রব্যের সন্ধান চালিয়ে আসছিল। গোলানে খনিজ তেলের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ২০১৩ সালে ইসরায়েলি সরকার ‘জিনি এনার্জি’ নামক একটি কোম্পানিকে গোলানে খনিজ তেলের সন্ধানকাজ চালানোর দায়িত্ব প্রদান করে। আন্তর্জাতিক আইনে গোলান সিরিয়ার অংশ এবং গোলানে অবস্থিত সকল সম্পদও সিরিয়ার, তাই এটি ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু ইসরায়েল এটিকে অগ্রাহ্য করে এসেছে। ২০১৫ সালে ইসরায়েলি সরকার ঘোষণা করে যে, গোলানে বিরাট একটি খনিজ তেলের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের মতে, গোলান থেকে উত্তোলনকৃত তেল ইসরায়েলের জ্বালানি স্বল্পতা দূরীকরণ ও দীর্ঘদিনের জন্য ইসরায়েলের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিরিয়া বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং দেশটির পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এজন্য সিরিয়া যদি গোলান হস্তগত করতে পারে, সেক্ষেত্রে এটি সিরিয়ার জন্য খুবই লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল সিরিয়াকে পুনর্গঠিত হতে দিতে ইচ্ছুক নয়। তাদের দৃষ্টিতে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত, বিভক্ত ও বিধ্বস্ত সিরিয়াই ইসরায়েলের জন্য নিরাপদ, কারণ যতদিন সিরিয়ার এই অবস্থা বিদ্যমান থাকবে, ততদিন সিরিয়ার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
সপ্তমত, গোলান মালভূমি দখলের পর থেকে ইসরায়েল সেখানে পরিকল্পিতভাবে ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে। বর্তমানে গোলানে প্রায় ২৬,০০০ ইহুদি বসতি স্থাপনকারী রয়েছে এবং সংখ্যার দিক থেকে তারা এখন গোলানের বৃহত্তম সম্প্রদায়। গোলানের মূল সিরীয় অধিবাসীরাই এখন সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল গোলানকে কার্যত ইসরায়েলি রাষ্ট্রকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। গোলানের উর্বর কৃষিজমিতে তারা কৃষি খামার ও আঙুরের বাগান স্থাপন করেছে, এবং ইসরায়েলের কৃষিতে অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তদুপরি, গোলানের মাটিতে ইসরায়েল নানা ধরনের সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
এসব করতে গিয়ে বিগত প্রায় পাঁচ দশকে ইসরায়েল গোলানের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। এখন যদি ইসরায়েল অঞ্চলটিকে সিরিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়, তাহলে এই অঞ্চলে ইসরায়েলি সম্পূর্ণ বিনিয়োগই ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন হবে। তদুপরি, সেক্ষেত্রে গোলানে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদেরকেও ইসরায়েলের অন্যত্র আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং এটি হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। সামগ্রিকভাবে, সিরিয়ার নিকট গোলানকে হস্তান্তর করা ইসরায়েলের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর।
সর্বোপরি, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি গোলানকে সিরিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার অনুকূল নয়। গোলানে বসবাসকারী ইসরায়েলি নাগরিকরা তো বটেই, ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডের জনসাধারণের সিংহভাগ গোলানকে সিরিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোর বিরোধী। ইসরায়েলি উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্রেণি ও সামরিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি মধ্যপন্থী জনসাধারণও এরকম কোনো সম্ভাবনা বিচার করতে প্রস্তুত নয়।
এমতাবস্থায় কোনো ইসরায়েলি সরকার যদি গোলানকে সিরিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়, সেই সরকার কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও ইসরায়েলি স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত হবে, এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন হবে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ক্ষমতাসীন সরকারই এরকম ঝুঁকি নিতে চাইবে না। ফলে গোলানের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ/দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অবশ্য বর্তমানে সিরীয়–ইসরায়েলি সম্পর্ক আগেকার সরল শত্রুতার সমীকরণ থেকে পরিবর্তন হয়ে একটি জটিল মিথষ্ক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। সিরীয় গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিসামর্থ্যকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিকট ভবিষ্যতে সিরিয়া ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে রুশ মধ্যস্থতায় সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যবর্তী গোপন যোগাযোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং কারো কারো ধারণা, শেষ পর্যন্ত হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক ও গোপন ‘অস্বস্তিকর মৈত্রী’ স্থাপিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো গোলানের ভবিষ্যৎ নতুন রূপ নিতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে, ইসরায়েল গোলানকে নিজস্ব রাষ্ট্রকাঠামোয় অঙ্গীভূত করে নিয়েছে এবং এক্ষেত্রে পূর্ণ মার্কিন সমর্থন লাভ করেছে, সুতরাং নিকট ভবিষ্যতে গোলান মালভূমি হাতবদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।