একটি বহুল প্রচলিত নীতিবাক্য হলো, “অর্থ সুখ ক্রয় করতে পারে না।” সত্যি কিন্তু, অর্থ আপনার জীবনকে রাজকীয় করে তুলতে পারে ঠিকই। রাজার মুকুট মাথায় না দিয়ে কিংবা রাজদরবারে সভাসদদের সাথে নিয়ে না বসেও নিজেকে রাজকীয় মনে করতে পাড়েন অর্থ ব্যয় করলে, হোক না সেটা একরাতের জন্যই। আর এই অনুভূতি দিতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল, একইসাথে ব্যয়বহুল হোটেলগুলোর সবচেয়ে দামী স্যুইটগুলো। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ১০টি স্যুইটের তালিকার তথ্য জানাচ্ছি আজ, যেগুলোতে একটিমাত্র রাত অবস্থান করলেই আপনার গুণতে হবে ৩০ লক্ষ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা!
১. দ্য পাম’স ইমপ্যাথি সুইট
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেল স্যুইটটি ২ বছর আগেও সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেল স্যুইটের তালিকায় সেরা দশের মাঝে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অবস্থিত পাম’স হোটেলের এই স্যুইটকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে গত দু’বছরে খরচ করা হয়েছে ৬৯০ মিলিয়ন ডলার। ব্রিটিশ স্থপতি ডেমিয়েন হার্স্টের নকশায় নির্মিত এই হোটেল স্যুইটটি এখন যেন পৃথিবীর বুকে একটি স্বর্গীয় কক্ষ। কেননা, ৯ হাজার বর্গ ফুটের বিশাল এই স্যুইটে প্রবেশ করলে মনে হতে পারে- আপনি কোনো হোটেলে নয়, বরং শিল্পীর শিল্পকর্মেই প্রবেশ করেছেন!
বিশাল জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হলেও এতে রয়েছে মাত্র দুটি শয়নকক্ষ, একটি সল্ট রিল্যাক্স রুম, একটি ম্যাসাজ টেবিল, একটি সুদৃশ্য জাকুজি, মনোরম সুইমিংপুলসহ বারান্দা ও ২টি গোসলখানা। ভাবছেন, তাহলে এর পেছনে ব্যয় হলো কী করে? এর ব্যয় পুরোটাই এর অঙ্গসজ্জায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো স্যুইটটি। আছে নামীদামী চিত্রকরদের নমকরা সব চিত্রকর্ম। স্যুইটের মিনি বারটিতে থাকা একেকটি মদের গ্লাসের দামও শতাধিক ডলার! মেঝের কার্পেটগুলোও পুরো আমেরিকা আর ইউরোপের মাঝে সবচেয়ে দামী। এই কারুকার্যময় স্যুইটটিতে একরাত থাকতে হলে গুণতে হবে ১ লক্ষ ডলার!
২. দ্য রয়্যাল পেন্টহাউজ সুইট, হোটেল প্রেসিডেন্ট উইলসন
অনেকেরই শখ থাকে এমন কোনো হোটেলে রাত কাটানোর যেখানে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কিংবা কোনো তারকারা কোনো একসময় রাত কাটিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আপনার যদি আর্থিক সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে জেনেভায় অবস্থিত রয়্যাল পেন্টহাউজ স্যুইটটি আপনার জন্যই, যেখানে রাত কাটিয়েছেন বিল গেটস, বিল ক্লিন্টন, মাইকেল জ্যাকসনের মতো ব্যক্তিরা। এই হোটেল স্যুইটের ছাদ থেকে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যাবে, তা পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক হোটেলেই পাওয়া সম্ভব।
প্রেসিডেন্ট উইলসন হোটেলের উপরতলার পুরোটা জুড়ে অবস্থিত এই পেন্টহাউজটি থাকে উপভোগ করা যাবে জেনেভা লেকের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য। সাথে মেঘাচ্ছন্ন রাতের আকাশে দূর-দূরান্তে চোখ মেলার জন্য টেলিস্কোপ তো আছেই। বিলাসবহুল এই পেন্টহাউজে আছে মোট ১২টি শয়নকক্ষ, প্রতিটিতে আছে দামী মার্বেলে বাঁধাই করা গোসলখানা, আছে ফিটনেস রুম, লাইব্রেরি, বার, বিশাল ডাইনিং রুম যেখানে আছে সুদৃশ্য একটি পিয়ানো ও বিলিয়ার্ড টেবিল। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই পেন্টহাউজের নিরাপত্তার জন্য আছে বুলেটপ্রুফ কাঁচের জানালা। আর এই বুলেটপ্রুফ কাঁচের ভেতরে বসে নিরাপদে বাইরের জেনেভা লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে প্রতি রাতে খরচ করতে হবে ৮০ হাজার ডলার!
৩. মার্ক হোটেল পেন্টহাউজ
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম পেন্টহাউজ, নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের বিপরীতে অবস্থিত মার্ক হোটেল পেন্টহাউজ পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল হোটেল স্যুইট। ১০ হাজার বর্গ ফুটের এই সুদৃশ্য পেন্টহাউজটিতে এক রাত কাটাতে গুণতে হবে ৭৫ হাজার ডলার!
উপর থেকে মার্ক হোটেলের প্রথম ২ তলায় অবস্থিত এই পেন্টহাউজে আছে ৫টি শয়নকক্ষ, ৬টি গোসলখানা, ৪টি ফায়ারপ্লেস, ১টি লাইব্রেরি লাউঞ্জ, ১টি ডাইনিং রুম, ২টি পাউডার রুম এবং ২টি বার। এছাড়াও আছে ২,৫০০ বর্গ ফুটের ছাদ। আধুনিক বিলাসিতা আর জাঁকজমকের চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্বলিত এই পেন্টহাউজটি ডিজাইন করেছেন কিংবদন্তী ফরাসি নকশাকার জ্যাক গ্রেঞ্জ। এখানকার অনেক আসবাবপত্রও গ্রেঞ্জের নকশায় প্রস্তুত হয়েছে, যা সচরাচর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। এর ছাদ থেকে পুরো শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা পাওয়ার পাশাপাশি পেছন দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট’ এর দেখা।
৪. পেন্টহাউজ স্যুইট, গ্র্যান্ড হিয়াট ক্যানস হোটেল মার্টিনেজ
গ্র্যান্ড হিয়াট ক্যানস হোটেল মার্টিনেজের ৭ তলায় অবস্থিত এই ৩০০ বর্গ ফুটের পেন্টহাউজটির চেয়ে আকারে অনেক বড় পেন্টহাউজ রয়েছে ফ্রান্সে। কিন্তু বিলাসিতায় এর ধারে কাছে নেই কেউ। পুরো হোটেল স্যুইটটি সাজানো আছে বিলাসবহুল সব আসবাবপত্রে আর দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পিকাসো, ভ্যান গগ আর ম্যাটিসের মতো চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি। ৪টি শয়নকক্ষ, মার্বেল গোসলখানা, ২৭০ স্কয়ারফুটের ছাদ, একটি সুইমিংপুল, একটি ব্যায়ামাগার এবং একটি চমৎকার বাগান আছে এই পেন্টহাউজে। সবমিলিয়ে বিলাসবহুল এই হোটেল স্যুইটটির পেছনে প্রতিরাতে ৫৩ হাজার ডলার ব্যয় করা মোটেও অপচয় মনে হবে না।
৫. টাই ওয়ার্নার পেন্টহাউজ, ফোর সিজনস
নিউ ইয়র্ক শহরটিকে চারদিক থেকেই দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখতে চাইলে যেতে হবে সেখানকার ফোর সিজনস হোটেলে, যার ৫২ তলায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এবং সর্বোচ্চ পেন্টহাউজ। ৪০০ বর্গ মিটারের এই হোটেল সুইটটির নামকরণ করা হয়েছে এর অধিপতি ধনকুবের ব্যবসায়ী টাই ওয়ার্নারের নামেই।
৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই হোটেল স্যুইটের চারদিকেই কাচ এবং অত্যাধুনিক কাচ নির্মিত ঝুল বারান্দাগুলোর কল্যাণে এই পেন্টহাউজ থেকে পাওয়া যাবে নিউ ইয়র্ক শহরের ৩৬০° দৃশ্য। এই পেন্টহাউজটির পারিবারিক বসবাসের জন্য নয়। এতে আছে ব্যক্তিগত স্পাসহ একটিমাত্র শয়নকক্ষ, ৪টি কাচের ঝুল বারান্দা, সুবিশাল গোসলখানা, একটি ব্যক্তিগত এলিভেটর, হোটেলে থাকাকালীন সময়ে ভ্রমণের জন্য সুদৃশ্য রোলস-রয়েস এবং প্রায় মিলিয়ন ডলার মূল্যের ওয়ার্ডরোব, যা খুব সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ওয়ার্ডরোব! আর তাই এখানে থাকতে হলে প্রতিরাতের জন্য খরচ করা চাই ৫০ হাজার ডলার।
৬. দ্য হিলটপ ভিলা, ফিজি
ফিজির লাউকালা দ্বীপে অবস্থিত হিলটপ ভিলার পেন্টহাউজ এ তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান দখল করেছে। একটুকরো প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্য বলা চলে ফিজির এই দ্বীপকে। আর পেন্টহাউজকে কেন্দ্র করে তৈরি করা সুইমিংপুল, সরু রাস্তাঘাট এর সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধিই করেছে বরং।
৪ একর ভূমির উপর তৈর করা এই বিশাল ভিলায় একটি পেন্টহাউজের পাশাপাশি রয়েছে সাধারণ হোটেলকক্ষও। তবে পেন্টহাউজটি অনন্য এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা পেন্টহাউজটি আদতে তিনটি পৃথক পেন্টহাউজের সমন্বয়। ডেলেনা, দুয়া এবং রুয়া নামক ৩টি পেন্টহাউজকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে পুরোটাই একটি একক কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি পেন্টহাউজ মনে হবে। দুটি শয়নকক্ষ, একটি লাইব্রেরি, বেশ বড় একটি সুইমিংপুল, ঝর্ণা ও বারান্দাসহ ডেলেনা হলো সবচেয়ে বড় পেন্টহাউজ। দুয়া ও রুয়া উভয় পেন্টহাউজের রয়েছে একটি করে শয়নকক্ষ। রুয়ায় একটি ছোট সুইমিংপুলও রয়েছে। সব মিলিয়ে এই সুইটটির ভাড়া প্রতি রাতের জন্য ৪৫ হাজার ডলার।
৭. দ্য গ্র্যান্ড রিয়াদ, মারাকেশ
মরক্কোর রাজা ৬ষ্ঠ মোহাম্মদের নামে নামকরণ করা মারাকেশ শহরের ‘রয়্যাল মনসুর লাক্সারি হোটেল’ এর সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং রাজকীয় সুইটটির নাম হলো ‘দ্য গ্র্যান্ড রিয়াদ’। মরক্কান স্থাপত্যশৈলে নির্মাণ করা ৩ তলা বিশিষ্ট এই হোটেল স্যুইটটির মোট আয়তন ১,৮০০ বর্গ মিটার, যা একে করেছে পৃথিবীর বৃহত্তম হোটেল স্যুইট। ৪টি শয়নকক্ষ, একটি মিনি সিনেমাহল, ব্যায়ামাগার, মরক্কান হাম্মাম, পুল আর প্রশস্ত ছাদ- সব মিলিয়ে এই হোটেল স্যুইটটি সেরাদের মাঝে সেরা। সুবিশাল রয়্যাল মনসুর হোটেলের পেছন দিকে, মূল হোটেল থেকে অনেকটা নির্জন-নিরিবিলিতে তৈরি করা হয়েছে এই স্যুইটটি। তারকাদের জন্য বিশেষ করে এই হোটেল স্যুইটটি সবচেয়ে নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় বলে গণ্য করা হয়। কেননা, এখানকার গোপনীয়তা পৃথিবীর যেকোনো হোটেলের চেয়েই বেশি। ধারণা করা হয়, এ হোটেলে এখনো পর্যন্ত শতাধিক আন্তর্জাতিক তারকা অবস্থান করেছেন, অথচ নেই সেই তালিকা, এতটাই গোপনীয়তা দেয়া হয়েছে এই স্যুইটটিতে! প্রতি রাতের জন্য এখানে ব্যয় হয় ৪৩,৫০০ ডলার।
৮. পেন্টহাউজ সুইট, হোটেল কালা ডি ভোল
ইতালির বিখ্যাত হোটেল ‘কালা ডি ভোল’ এর সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেন্টহাউজ সুইটটি স্থান পেয়েছে এ তালিকার অষ্টম স্থানে। ২,৭০০ বর্গ ফুটের এই বিশাল পেন্টহাউজ স্যুইটটির মূল আকর্ষণ হলো এর ছাদে অবস্থিত সুইমিং পুল এবং ডাইনিং। পাশেই অবস্থিত কস্তা স্মেরাল্ডা নদীর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে খাবার খাওয়ার মজা বেড়ে দ্বিগুণ হবে এখানে। বিশাল এই স্যুইটে আছে তিনটি শয়নকক্ষ, দুটি সুইমিংপুল, একটি বার, একটি সুদৃশ্য সূর্যঘড়ি, জাকুজি, ঝর্ণা, ঝুল বারান্দা, ফিটনেস কক্ষ আর অসংখ্য সৌখিন আসবাবপত্র। প্রতি রাতের জন্য এর ভাড়া ৪১ হাজার ডলার।
৯. রয়্যাল স্যুইট, প্লাজা হোটেল
নিউ ইয়র্কের প্লাজা হোটেলে অবস্থিত রয়্যাল স্যুইটটি একজন ব্যক্তির থাকার মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে। একটিমাত্র শয়নকক্ষবিশিষ্ট এই স্যুইটে অবশ্য ১৫/২০ জন অতিথি নিয়ে পার্টি করা সম্ভব। পার্টি করবার জন্য আছে সুদৃশ্য বার, একটি বড় পার্টি রুম এবং ডাইনিং রুম। এছাড়াও আছে ফিটনেস রুম, লাইব্রেরি আর সুইমিংপুল। তবে এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর একমাত্র শয়নকক্ষটি, যেটিকে অনেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী শয়নকক্ষ বলেও অভিহিত করেন। নিদারুণ বিলাসবহুল সব আসবাবপত্রে সাজানো এই কক্ষটি এবং এর গোসলখানার দেয়ালে আছে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের ব্যবহারে তৈরি করা নয়নাভিরাম কারুকাজ। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এই শয়নকক্ষে থাকতে হলে আপনাকে প্রতি রাতে গুণতে হবে ৪০ হাজার ডলার।
১০. ফায়েনা হোটেল পেন্টহাউজ
সমুদ্রপ্রেমীদের জন্য এমনিতেই ভালোবাসার এক নাম যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি সমুদ্রসৈকত। সমুদ্রতীরে অবস্থিত ফায়েনা হোটেলের পেন্টহাউজটি তাই যেকোনো সমুদ্রপ্রেমীর জন্য স্বপ্ন। ৫টি শয়নকক্ষের সাথে প্রশস্ত লম্বা বারান্দা আর মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কাঁচের জানালা এই স্যুইটটিকে করেছে অনন্য। সমুদ্রের নিকটে হওয়ায় এতে কোনো সুইমিংপুল রাখা হয়নি, তথাপি সৈকতের দৃশ্য সর্বোচ্চ উপভোগ করবার জন্য সবরকম ব্যবস্থাই করা আছে এখানে। চলচ্চিত্র পরিচালক বাজ লুরম্যান এবং সেট ডিজাইনার ক্যাথেরিন মার্টিনের নকশা করা এই পেন্টহাউজ সুইটটির প্রতি রাতের ভাড়া ৩৯ হাজার ডলার।