পূর্ব ইউরোপের অর্থনীতিতে পোল্যান্ড ‘রোল মডেল’ হওয়ার কাহিনী

আতিথেয়তার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ডের দারুণ সুনাম রয়েছে। আপনি যদি কোনো পোলিশ নাগরিকদের বাড়িতে পা রাখেন, তাহলে সেই পোলিশ নাগরিক যে আপনাকে চমৎকার আদর-যত্ন করবে, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। পোল্যান্ডে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, অতিথি বাড়িতে আসা মানে বাড়িতে ঈশ্বরের আগমন ঘটা। তাই তারা অতিথির আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখে না। এছাড়া পোলিশ নাগরিকেরা যেকোনো বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রদানের জন্য সততা ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। যেমন: পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, বিনয়ের খাতিরে মানুষ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পোলিশ নাগরিকেরা সেরকম স্বভাবের নয়। রাস্তাঘাটে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, খারাপ আবহাওয়া কিংবা অসন্তোষজনক পেশার ক্ষেত্রে তারা রাখঢাক না করে সরাসরি সেসবের সমালোচনা করতে অভ্যস্ত। পোল্যান্ড সম্পর্কে আরেকটি কথা না বললেই নয়। ভোজনরসিকদের মধ্যে ইতালীয় পাস্তা, ফরাসি ওয়াইন কিংবা বেলজিয়ান চকলেটের বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু পোলিশ খাবার ‘পিরোজি’ দুর্দান্ত স্বাদ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপে বেশ অবমূল্যায়িত একটি খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়।

হআশয়য়
আতিথেয়তার জন্য পোলিশদের সুনাম রয়েছে; image source: blogs.transparent.com

আজকের দিনে আপনি যদি পোল্যান্ডে বেড়াতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন আলো ঝলমলে শহরগুলোতে অসংখ্য পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাঁটার জন্য কিংবা যানবাহন চলাচলের জন্য যে রাস্তা, সেগুলো খুবই সুন্দর এবং চওড়া। রাস্তার পাশে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল ভবনগুলোতে পূর্ব ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া অনুভব করা যাবে। পোল্যান্ডে বেকারত্বের হার অনেক কম, তাই সব পোলিশ নাগরিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন। দেশটির নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয় আবহাওয়ার কথাও আলাদা করে বলতে হয়। পাহাড়, সাগর কিংবা হ্রদগুলো ভ্রমণ করা যাবে। পোল্যান্ডে শীতের সময় যেমন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, তেমনই গরমের সময় উষ্ণতা বিরাজ করে। এক ঋতুর সাথে আরেক ঋতুর পার্থক্য নিরূপণ করা যায় সহজেই। যদি কখনও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো ভ্রমণের সৌভাগ্য হয় আপনার, তাহলে বুঝতে পারবেন একই অঞ্চলে ভৌগলিক অবস্থান থাকার পরও পোল্যান্ড অন্যান্য পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে গিয়েছে। পোল্যান্ডের এই অগ্রগতি একদিনে হয়নি।

গত শতাব্দীতে ইউরোপ দুটো বিশ্বযুদ্ধের স্বাক্ষী হয়েছে। পোল্যান্ড দুটো বিশ্বযুদ্ধেই হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড স্বাধীন ছিল না, তৎকালীন ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো দেশটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। যুদ্ধের পর পরাশক্তিগুলোর ভঙ্গুর দশার সুযোগ নিয়ে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথমে জার্মানির আক্রমণের শিকার হয় দেশটি। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নও পাল্টা আক্রমণ চালায় সেখানে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ড হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানির ‘রণক্ষেত্র’। জার্মানির লক্ষ্য ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর পতন ঘটানোর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করে ফেলা। সেই উদ্দেশ্যেই পোল্যান্ডে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। অপরদিকে নাৎসিদের প্রতিহত করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও পোল্যান্ডে আক্রমণ চালিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল প্রথমদিকে। নাৎসি সৈন্যরা পোল্যান্ড দখলের পর বিভিন্ন বর্ণবাদী নীতির প্রবর্তন ঘটিয়েছিল। এছাড়া পোলিশ ইহুদিদের উপর চালানো হয়েছিল পরিকল্পিত গণহত্যা।

হডজচজচজচ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাশক্তিদের রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া পোল্যান্ড ধ্বংসের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল; image source: nypost.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডে শুরু হয় কমিউনিজমের পথচলা। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরবর্তীতে উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও সেগুলো যথাযথ উপায়ে বাস্তবায়নের ফলে দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু পোল্যান্ডে আর দশটা পূর্ব ইউরোপের দেশের মতোই কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয় একেবারে ধীরগতিতে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরা হয়েছিল, যেকোনো ধরনের সমালোচনার শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোর। ফলে সরকারি স্বেচ্ছাচারিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যার খেসারত দিতে হচ্ছিল পোলিশ নাগরিকদের। ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উদ্যোগের কোনো সুযোগ ছিল না, ফলে জাতীয় উৎপাদনও ছিল হতাশাজনক। মোট কথা, কমিউনিস্ট শাসনামল পোলিশ ইতিহাসে ছিল ‘দুঃসময়’। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটার পর দেশটির নতুন যাত্রা শুরু হয়।

কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর পোল্যান্ডের সামনে দ্রুত উন্নয়নের উপায় হিসেবে একটি পথই খোলা ছিল– পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো, ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উদ্যোগের প্রসার ঘটানোর জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি করা। পোল্যান্ডের সরকার এই কাজটি খুব দ্রুত করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খুব দ্রুত আধুনিকায়ন ঘটানো হয়, জনসেবার মান বাড়ানো হয় তড়িৎগতিতে। গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ফলে দুর্নীতির মাত্রা কমে আসে একেবারে, এর পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা হ্রাস পায়। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির পরিকল্পনা গ্রহণ করার ফলে পোলিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়, বাড়তে থাকে মোট জাতীয় উৎপাদন, তৈরি হয় অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান। পোল্যান্ড পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে থাকে।

একই ভূখন্ডে থাকার পরও পূর্ব ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো;
image source: rmx.news

পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটি বড় কারণ ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়া। ২০০৩ সালে গ্রীসের এথেন্সে এক চুক্তির মাধ্যমে পোল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। এর মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সংগঠনটির কাছ থেকে পোল্যান্ড বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করে, যা দিয়ে পোল্যান্ড সরকার রাস্তাঘাট, বিমানবন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে। এছাড়াও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরির জন্য এই চুক্তি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসবের পাশাপাশি পোলিশ সরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য তৎপর হয়। ১৯৮৯ সালে যেখানে প্রতি দশজনে একজন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো, সেখানে বর্তমানে প্রতি দুজন পোলিশ নাগরিকের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সবকিছু বিবেচনায় পনের বছর বয়সী একজন পোলিশ তরুণ তুলনামূলকভাবে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার একই বয়সী তরুণের তুলনায় বেশি শিক্ষিত। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পোলিশ নাগরিকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেক সহজেই।

হডজচৃআ্আ
ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোল্যান্ডের সংযুক্তি দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে; image source: emerging-europe.com

পোল্যান্ডের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারণা পেতে একটি তথ্য বেশ সহায়ক হবে। ২০০৮ সালে যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা দেখা গিয়েছিল, তখন পুরো বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থমকে গিয়েছিল। উন্নয়নের দিক থেকে শীর্ষে থাকা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর এই মহামন্দার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি। মজার ব্যাপার হলো, মহামন্দার সেই সময়েও পোল্যান্ডের অর্থনীতির গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। বর্তমানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি আকারে বিনিয়োগ করছে দেশটিতে, কারণ পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবকাঠামো অনেক বেশি বাণিজ্যবান্ধব। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা আজকের পোল্যান্ডের দিকে তাকালেই অনুধাবন করা যায়। দেশটির তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ‘পশ্চিম ইউরোপীয় অর্থনৈতিক মডেল’ অনুসরণের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তার সুফল আজকে ভোগ করছে পোলিশ নাগরিকরা, সামনের দিনগুলোতেও করবে। এই শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে পোল্যান্ডের নাম আসবে।

Related Articles

Exit mobile version