ভারতের রহস্যময় গ্রাম জাতিংগা: যেখানে আত্মহত্যা করে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি

বিজ্ঞান পৃথিবীর অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। তবুও জগতে এখনো এমন অনেক রহস্য রয়ে গেছে যা খোদ বিজ্ঞানীদের কাছেও ধোঁয়াশাপূর্ণ। যুগের পর যুগ গবেষণা করেও তারা সেসবের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেননি। কিংবা যা করছেন তা হয়তো বিজ্ঞানের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। আর এমন এক রহস্যে ঘেরা গ্রাম জাতিংগা

প্রতিবছর হাজারো মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। পৃথিবীর প্রতি অভিমান করে কিংবা কোনো দুঃসহ যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেক মানুষই চলে যান না ফেরার দেশে। নিরাপদ আত্মহত্যার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‘সুইসাইড জোন’ বা নিরাপদ আত্মহত্যা কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। যেমন জাপানের ‘আকিগাহারা জঙ্গল’ আত্মহত্যার স্থান হিসেবে বিখ্যাত। কিন্তু পাখিদের আত্মহত্যার কথা শুনেছেন কখনো? কিংবা পাখিদের সুইসাইড জোনের কথা?

অবাক করা তথ্য হলেও সত্য যে, ভারতের জাতিংগা গ্রামে রয়েছে এমনই একটি সুইসাউইড জোন। যেখানে প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা আত্মহত্যা করতে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আত্মহত্যার জন্য অসংখ্য পাখিরা সেখানে এসে ভিড় জমায়।

জাতিংগা গ্রামে যাওয়ার পথনির্দেশক; Image Source: YouTube

জাতিংগা গ্রামটি ভারতের আসাম রাজ্যের দিমা হাসাও জেলায় অবস্থিত। পাহাড়বেষ্টিত এই গ্রামটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ‘বার্ড সুইসাইড জোন’। জগতের বুকে এ এক রহস্যময় ঘটনা।  কথিত আছে, প্রায় ১ হাজার বছর আগে কোনো এক অলৌকিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখানে হাজার হাজার পাখি আত্মহত্যা করতে শুরু করে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে।

এজন্য তখন থেকেই সেই গ্রামের অধিবাসীরা রাতের বেলায় বাইরে বেরোতেন না। তারা এই ঘটনাকে দেবতাদের অভিশাপ বলে মানতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের সামনে যুক্তি-বুদ্ধি তথা বিজ্ঞানের আবেশ আসতে শুরু করে। অনেকে এই রহস্য উদ্ঘাটনের আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অনেক প্রাণিবিজ্ঞানীরাও এ গবেষণায় লিপ্ত হলেন। কিন্তু কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বা যৌক্তিক রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলেন না। যদিও তারা সবাই বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হাজার হাজার পাখিদের আত্মহত্যা বন্ধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেননি তারা।

পাহাড়বেষ্টিত জাতিংগা গ্রামের একটি দৃশ্য; Image Source: tripoto.com

আত্মহত্যার জন্য প্রতি বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় বেছে নেয় পাখিরা। সাধারণত বর্ষাকালকে বেছে নেয় তারা। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে, আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে পাখিদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা জায়। এই নির্মম আত্মহত্যা যজ্ঞ দেখতে প্রতি বছর অসংখ্য কৌতূহলী মানুষকে জাতিংগা গ্রামে ভিড় জমাতে দেখা যায়। তবে পক্ষী বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে মোটেও দর্শনীয় বা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ভাবতে নারাজ। তারা এই নির্মম সঙ্কট সমাধানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আত্মহত্যার জন্য পাখিরা সাধারণত জাতিংগা গ্রামের পাহাড়ি খাদসমূহকে বেছে নেয়। গভীর রাতে সেখানে গিয়ে তারা আত্মহত্যা করে। তবে পক্ষী বিজ্ঞানীরা এতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছেন যে, রাতের বেলায় আলোময় বস্তুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয় এসব পাখিরা। সকাল বেলা সেখানে তাদের কোমল দেহ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

কেন এভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা জাতিংগা গ্রামে এসে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করছে? এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন পক্ষী বিজ্ঞানীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে এই গবেষণা শুরু হয় ১৯০৫ সালে। এক রহস্যময় ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই গবেষণা শুরু হয়েছিল-

জাতিংগা গ্রামের আকাশে পাখিদের মেলা; Image Source: Travelogue India

১৯০৫ সালের কোনো এক রাতে জাতিংগা গ্রামে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। ঝড়ের মুখে জাতিংগা গ্রামের অধিবাসীদের একটি মেষ হারিয়ে যায়। নানা কারণে সেই মেষটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল গ্রামবাসীর কাছে। ফলে সাধারণত রাতের বেলায় তারা ঘরের বাহিরে বের না হলেও সেই মেষকে খোঁজার জন্য তারা দল বেঁধে বের হয়।

অন্ধকারে মোকাবেলা করার জন্য তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল মশাল। পাহাড়ি বনের বুক চিরে চলে যাওয়া পথ ধরে তারা হাঁটছিল। তাদের ধারণা ছিল, এই পথে ধরেই হয়তো তাদের মেষ হারিয়ে গেছে। মশালের আলো এদিক-ওদিক করে ঘুরিয়ে হারানো মেষকে খুঁজছিলেন তারা।  হঠাৎ এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।

তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, চারদিক থেকে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাজার হাজার পাখি ছুটে আসছে তাদের দিকে। সেসব পাখি তীরবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মশালগুলোর আগুনের মধ্যে। মুহূর্তের মধ্যে তাদের মশালের আগুনে পুড়ে হাজার হাজার পাখি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো। দেশি-বিদেশি নানা পাখি যোগ দিলো সেই মৃত্যুর মিছিলে।

অদ্ভুত এই ঘটনা দেখে কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে পড়েন জাতিংগা গ্রামের অধিবাসীরা। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের শাসন চলে। নিরুপায় হয়ে পাহাড়ি অধিবাসীরা সেই খবর বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে জানালেন। কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেই খবর পৌঁছে গেল ইংরেজ শাসকদের কানে। তারাও এমন অবিশ্বাস্য সংবাদ শুনে বিস্মিত হয়ে উঠলেন।

আত্মহত্যার পর এভাবেই পড়ে থাকতে দেখা যায় পাখিদের; Image Source: tripoto.com

ইংরেজ শাসকরা ভাবলেন এর একটি বিহিত করা দরকার; এই রহস্য উদ্ঘাটন করা দরকার। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন নানা প্রজাতির পাখির নিবাস। ফলে অনেক ইংরেজ পক্ষী বিজ্ঞানী এখানে গবেষণা করতে আসতেন। ।

পাশাপাশি এই সংবাদ তৎকালীন ইংরেজদের পরিচালিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হলো। ফলে সারা বিশ্বে এই রহস্যময় ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। বিদেশ থেকে অনেক গবেষক এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ছুটে আসলেন। কিন্তু অধিকাংশ গবেষকই এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে খালি হাতে ফিরে যান।

এদের মধ্যে ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ প্রাণী বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড রিচার্ড জি সর্বপ্রথম এই রহস্যের প্রাথমিক কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তিনি তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রাণী বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সময় ভারতের বিখ্যাত পক্ষী বিজ্ঞানী সালিম আলিও এই গবেষণায় এগিয়ে আসেন।

উভয় বিজ্ঞানী দাবি করেন, প্রচণ্ড বাতাসের কারণে পাখিরা পাহাড়ের কোলে আছড়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু তাদের এই দাবি তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিশেষত নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে কেন এসব পাখিরা মৃত্যুবরণ করে এবং আশেপাশের অন্যান্য এলাকায়- যেসব জায়গার ভৌগলিক অবস্থান জাতিংগার অনুরূপ সেসব জায়গায় কেন পাখিরা আত্মহত্যা করে না এমন প্রশ্নের জবাব তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

পাখিদের কোলাহলে এভাবেই মুখরিত হয়ে ওঠে জাতিংগার আকাশ; Image Source: jungleideas.wordpress.com

অনেকে আবার বলেছেন, বর্ষাকালে প্রচণ্ড বেগে ঝড় হওয়ায় সেখানকার পাখিরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ের কোলে, গাছের ডালে বা আগুনের মধ্যে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু স্বভাবতই এই দাবিও হালে তেমন পানি পায়নি।  

অবশেষে ভারতের বিশিষ্ট পাখি বিজ্ঞানী আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরী ২০০০ সালে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘দ্য বার্ড’স অফ আসাম’ নামের এই বইতে তিনি যে রহস্য তুলে ধরেন তার সারমর্ম হলো-

বর্ষাকালের রাতে জাতিংগা গ্রামের চুম্বকীয় স্তরে বেশ পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এ সময় আকাশের পাখিদের পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে প্রচণ্ড বেগে আকর্ষণ করতে থাকে। ফলে পাখিরা দিশেহারা হয়ে সেখানকার পাহাড়ে আছড়ে পড়ে গুরুতর আহত হয় এবং আঘাতের কারণে কিছুক্ষণ পর তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে এই চুম্বকীয় স্তরের পরিবর্তন কেন ঘটে তা আবিষ্কার করতে পারেননি তিনি। এখন সেসব নিয়ে অধিকতর গবেষণা চলছে।

পাখিদের আত্মহত্যা রোধের উপায় নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি চলছে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডও; Image Source: unconventionalandvivid.com

তার এই গবেষণার পর পাখিদের মৃত্যু কমাতে সেখানে একদল গবেষক পাঠানো হয়েছিল। তাদের দাবি, সেখানে অভিযানের পর পাখিদের আত্মহত্যার পরিমাণ কমে এসেছে। গবেষকরা গ্রামের অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছেন, এটি কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়। এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। গবেষকরা পাখিদের বাঁচাতে তাদের সহায়তাও কামনা করেছেন। কিন্তু অনেকের মতে, এখনো আগের মতোই জাতিংগা গ্রামে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা আত্মহত্যা করতে আসে।

আত্মহত্যা করতে আসা পাখিদের মধ্যে রয়েছে, সাদা সারস, সবুজ পায়রা, সোনা ঘুঘু, কাঠঠোকরা ও মাছরাঙা জাতীয় পাখি। একবার কয়েকজন বিজ্ঞানী জাতিংগা গ্রামে গিয়ে সেখানকার বনাঞ্চলের বেশ কিছু পাখি খাঁচায় আটকে রাখলেন। যাতে তারা আত্মহত্যা করতে না পারে। কিন্তু দেখা গেলো, পাখিগুলো কোনো খাবারই গ্রহণ করছে না। এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে পাখিগুলো খাঁচার ভেতরেই মৃত্যুবরণ করে। জাতিংগার পাখিদের আচরণ এখনো এমন রহস্যময়।

This article is in bengali language. It is about Jatinga bird suicide. Small village in India claims the lives of birds each September. For references please check the hyperlinked texts in the article.

Feature Image: indiarailinfo.com

Related Articles

Exit mobile version