তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মূলত জনবহুল দেশ। প্রচুর শ্রমিকের উপস্থিতি দেশগুলোতে তৈরি করে সুলভ শ্রম। আইএমএফ (IMF) এর মতে, পৃথিবীর সর্বমোট ১৫২টি তৃতীয় বিশ্বের দেশের মোট জনসংখ্যা ৬.৬৯ বিলিয়ন, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৮৫.৩৩ শতাংশ। অধিক জনসংখ্যার দরুন সৃষ্ট সুলভ শ্রমের উপস্থিতির পরও কেন তৃতীয় বিশ্বের দেশে যথাযথ উন্নয়ন হচ্ছে না? কেন উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে পারছে না তারা?
সুলভ শ্রম ও তৃতীয় বিশ্বের চিত্র
যখন একজন ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত কম অর্থের জন্য অধিক পরিশ্রম করেন, তখন একে সুলভ শ্রম বলা হয়। অর্থাৎ, কোনো ফার্ম বা শিল্প প্রতিষ্ঠান একজন শ্রমিককে প্রতি ঘন্টা শ্রমের জন্য যত টাকা দেয়ার কথা তার চেয়ে কম টাকা দিয়ে শ্রমিক পেয়ে যাওয়া। ধরা যাক, একটি ফার্মে এক ঘন্টা কাজের জন্য কোনো ব্যক্তিকে ৫ ডলার মজুরি দিতে হয়। কিন্তু একই কাজের জন্য যতজন শ্রমিক দরকার, বাজারে তার চেয়ে অধিক শ্রমিক বিদ্যমান। সেক্ষেত্রে শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় নেমে যাবে।
ফার্ম যদি এবার প্রতি ঘন্টায় ৪ ডলার দিতে চায়, এতেও কিছু শ্রমিক তারা পেয়ে যাবে বাজারে অত্যধিক শ্রমিকের উপস্থিতির জন্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে- যে শ্রমিক নিয়োগ পাচ্ছে সে কম টাকায় বেশি সময় কাজ করছে। যেহেতু প্রতি ঘন্টায় তাকে পূর্বের সমান কাজই করতে হচ্ছে, তাহলে সে এখানে কম টাকায় অধিক পরিশ্রম করছে।
‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ মূলত একগুচ্ছ বিতর্কিত শব্দ। স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর তিনটি বিশ্বের মডেল মূলত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই মডেল অনুযায়ী, ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র প্রথম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে, পূর্ব ব্লকের রাষ্ট্র দ্বারা দ্বিতীয় বিশ্ব, এবং তৃতীয় বিশ্বের অধীনে পৃথিবীর অন্য সব রাষ্ট্র। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে বেশি বসবাস করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে। জন্মগ্রহণ করা ১০০ শিশুর মধ্যে ৯৭ জনই জন্ম নেয় তৃতীয় বিশ্বের দেশে।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো অধিক জনসংখ্যায় জর্জরিত। সেসব দেশে সুলভ শ্রমের উপস্থিতি ও তার ফলে কাজের পরিবেশ উভয়ই মারাত্মক নিম্ন অবস্থানে রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্ন উৎপাদনশীলতা, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষা, নিম্ন মজুরি, প্রতিকূল ও অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি। এসব দেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ বেশি। যার দরুন উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকরা মূলত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবার থেকে আসে, ভোগে বিভিন্ন শারিরীক রোগে আর অপুষ্টিতে। তাছাড়া, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ততটা অনুকূলে থাকে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নাগরিক অধিকার নিয়ে সরকার এতটা সচেতন থাকে না, মালিকরা শ্রমিকদের খাটিয়ে নেয় ইচ্ছেমতো। শ্রমিকদের কাজ করতে হয় তুলনামূলক বেশি, মানা হয় না মানসম্মত শ্রম ঘণ্টা। যেখানে উন্নত বিশ্বে সপ্তাহে ৪০ শ্রমঘণ্টা কাজ করা মানসম্মত ধরা হয়, উন্নয়নশীল দেশে তার চেয়ে বেশি সময় কাজ করে শ্রমিকেরা।
উন্নয়নশীল দেশ অনেকাংশে ভোগে বেকার সমস্যায়, তৈরি করতে পারে না পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্রের। তাই বাধ্য হয়ে মানুষ প্রবেশ করে সস্তা শ্রমের বাজারে। তাছাড়া, এসব দেশের শ্রমিকেরা আসে তুলনামূলক কম শিক্ষিত পরিবার থেকে, থাকে না কোনো ভোকেশনাল ট্রেনিংও।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হওয়ায় সেখানে নারী শ্রমিকদের আধিক্য দেখা যায়। অধিকাংশ নারী শ্রমিকই চাকরি করে পোশাক শিল্পে। নাগরিক অধিকার দুর্বল বলে এসব দেশে অনেক সময় চলে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিকরা শিকার হন বিভিন্ন রকমের হয়রানির। অনেক সময় দেখা যায়- নারী শ্রমিকদের জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে।
সুলভ শ্রম ও তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়ার কারণ
প্রশ্ন জাগতেই পারে, সুলভ শ্রমের দরুন ফার্ম ও শিল্প প্রতিষ্ঠান কম বিনিয়োগে অধিক উৎপাদন করতে পারছে, তাহলে কেন দেশে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে না? তবুও কেন পিছিয়ে থাকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো? আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকগণ বিভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন এর পেছনে। সেসবের মধ্যে সুলভ শ্রমের অলীক ধারণা, প্রোডাক্টিভিটি, সুলভ শ্রমের সাথে জিডিপির পার কেপিটা ইনকামের বিপরীত সম্পর্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রোডাক্টিভিটি ও নিম্ন মজুরি: যেসব দেশে স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়, সেখানে দেখা গেছে শ্রমিকদের প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদনশীলতা নিম্ন পর্যায়ের। আরভিং বি. ক্রাভিসের মতে, নেতৃস্থানীয় বড় রপ্তানিকারক ফার্ম হচ্ছে যারা তুলনামূলক উচ্চ মজুরি প্রদান করে। উচ্চ মজুরি শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আরও বেশি উৎপাদনক্ষম করে তোলে। একটি দেশের মজুরির সাধারণ স্তর সাধারণত সেই দেশের শ্রম কতটা উৎপাদন করতে পারে তার উপর নির্ভর করে। যে দেশগুলোতে শ্রমিকদের উচ্চ উৎপাদনশীলতা রয়েছে, সেসব দেশে উচ্চ থাকে আয়ের মাত্রা। অন্যদিকে, যে দেশগুলোতে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম, সেই দেশগুলোর আয়ের মাত্রাও কম, অর্থাৎ মজুরি কম। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি কম দেয়া হয়। যার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় সেসব শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কতটুকু নিম্ন। আবার নিম্ন মজুরিতে কাজ করার ফলে শ্রমিক অপুষ্টিতে ভোগে, রোগাক্রান্ত থাকে, বিভিন্ন কারণে তার উৎপাদনশীলতা লোপ পেতে থাকে। সেজন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশে সুলভ শ্রম থাকার পরও শ্রমিকদের নিম্ন উৎপাদনশীলতার কারণে দেশগুলো পিছিয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বের দেশে শ্রমিকরা উচ্চ মজুরি পায়, যার দরুন সেসব দেশের শ্রমিকদের উচ্চ উৎপাদনশীলতা থাকে যা সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখে।
শ্রম ঘণ্টা ও পার ক্যাপিটা জিডিপি: নিম্ন শ্রমঘণ্টা ও পার ক্যাপিটা জিডিপির সম্পর্ক নেগেটিভ। অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর শ্রমিক তুলনামূলক বেশি শ্রমঘণ্টা কাজ করে। কিন্তু তাদের নিম্ন উৎপাদনশীলতা ফার্ম ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিকূল ফলাফল বয়ে আনে। সর্বোপরি, নিম্ন মজুরি শ্রমিকের শুধু উৎপাদনশীলতা কমায় না, পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন করে তোলে দুর্বিষহ। এসব নিম্ন উৎপাদনশীলতাসম্পন্ন শ্রমিক বিদেশে পাঠালেও দেখা যায় তারা যথাযথ কাজ করতে পারে না দক্ষতার অভাবে। এভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশের শ্রমিক বেশি হলেও তাদের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে মোট দেশীয় উৎপাদন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় কম হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশে কম শ্রমিক হলেও তাদের কর্মক্ষমতা বেশি, সেজন্য সেই দেশগুলোর জিডিপিও বেশি।
সুতরাং, শুধু শ্রমিকের আধিক্য ও সুলভ শ্রমের উপস্থিতি একটি দেশর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না। সেজন্য দরকার উচ্চ উৎপাদনশীল শ্রমিক ও শ্রমিকদের কাজের অনুকূল পরিবেশ, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেকটাই অনুপস্থিত।