২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই তুরস্কে সংঘটিত হয়েছিল এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার রূপকার হিসেবে বৈশ্বিক পাদপ্রদীপের নিচে চলে আসেন যে ব্যক্তিটি- ফেতুল্লাহ গুলেন।
পেশায় ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক ও বক্তা। সেই জায়গা থেকে জাতীয় রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে কীভাবেই বা এত বড় নাম হয়ে গেলেন তিনি? ফেতুল্লাহ গুলেনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল? এসব কিছুরই উত্তর খোঁজা হবে আজকের লেখায়।
ফেতুল্লাহ গুলেনের জন্ম ১৯৪১ সালে, তুরস্কের এরজুরুম শহরে। প্রাথমিক জীবনে তিনি ইমাম ওয়ায়েজ ও লেখক ছিলেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়ায়েজ হিসেবে বিভিন্ন শহরে ওয়াজ করে বেড়াতেন। পরবর্তীকালে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেন। এর মাঝে তিনি বেশ কিছু ম্যাগাজিন বের করেন।
সাংগঠনিকভাবে ফেতুল্লাহ গুলেন সত্তরের দশক থেকে সংগঠন গোছানো শুরু করেন। এক শহর থেকে অন্য শহরে কিংবা গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্রদের নানা সমস্যা, বিশেষ করে আবাসন সমস্যা, সমাধানের নিমিত্তে ‘আলোকিত ঘর’ নামে ছাত্র হোস্টেল চালু করার মাধ্যমে তার সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তীকালে স্কুল-কলেজ প্রকাশনা, হোস্টেলসহ নানা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা শুরু করেন। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত নিজেদেরকে একটি ইসলামিক গ্রুপ হিসেবে উপস্থাপন করেন। প্রথমে বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর উত্তরসূরি হিসেবে পরিচয় দিতেন, এবং পরে নিজের মতো করে আদর্শ প্রচার করে বেড়াতেন।
প্রকৃতপক্ষে তার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। নিছক ধর্মপ্রচার বা ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদের মন্ত্র ব্যক্তি-পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া নয়, তার চোখে ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার জ্বলজ্বলে স্বপ্ন!
গুলেন মুভমেন্ট
রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছাপোষণ কোনো নাগরিকের জন্য দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেটার জন্য প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া।
ওদিকে গুলেন পুরো ভিন্ন এক পদ্ধতিতে এবং ভিন্ন পথে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি চাইছিলেন, দেশের শিক্ষা, মিডিয়া, ব্যবসা খাতসহ প্রভাবশালী সেক্টরে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ গ্রুপ থেকে সব লোক ঢোকানোর ফন্দিফিকিরও শুরু করেন। ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালে তার দেওয়া দুটি বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য
হুরুচ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আজ থেকে ৩৪-৪০ বছর পর বাস্তবায়ন হবে। আজকের প্রেক্ষাপটে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। হুরুচ আন্দোলনের সফলতার জন্য পুরো দেশে নিজেদের কিংবা ভাড়া করা বাড়িগুলোতে মাধ্যমিক (কলেজ লেভেল) ও উচ্চশিক্ষায় (বিশ্ববিদ্যালয়ে) অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য আবাসনের (হোস্টেলের) ব্যবস্থা করা দরকার। হোস্টেলে থাকতে আসা ছাত্রদের ভালো ফলাফল করা, মাথায় নিজেদের (আমাদের) চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বই ও ম্যাগাজিন বের করতে হবে। বিশেষ করে, তুরস্কে শিক্ষকদের বিশাল অংশকে আমাদের পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য রাস্তা দেখানো, ছাত্রদেরকে প্রথমত প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক হওয়া এবং দ্বিতীয়ত পরিকল্পনায় (সামরিক বাহিনীগুলোর) লেফটেন্যান্ট, পুলিশের কর্মকর্তা ও আইনজীবী হওয়ার জন্য পরামর্শ দিব।
১৯৮০ সাল থেকেই সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার জন্য তাদের হোস্টেলে থাকা ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে শুধু নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করার জন্য হোস্টেল প্রতিষ্ঠা এবং সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে লোক ঢোকানো শুরু করেন।
আবার তাদের সংস্পর্শে থাকা নিয়োগকৃত লোকদের মাসিক আয়ের একটি অংশ চাঁদা হিসেবে সংগঠনে দেওয়ার সিস্টেম চালু করেন। তাতে সংগঠনের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়।
এদিকে হোস্টেলসহ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। দরিদ্র ছাত্ররা তাদের কাছে ভিড়তে শুরু করে। আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করে।
গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাদেরকে খুব বেশি কিছু মনে করেনি। কারণ, তারা রাজনৈতিক দল করে না। নিজেদেরকে পরিচয় দিত ‘হিজমত‘ তথা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ফেতুল্লাহ গুলেন সবার নিকট ‘হোজা’ তথা শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পান।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তুরস্কে বেশ কিছু দ্বীনি উপদল রয়েছে, যারা সাধারণত তরীকতপন্থী কিংবা কোনো বড় আলেমের মুরিদ। যেমন: নকশাবন্দী জামায়াত, নুরি জামায়াত (বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির ভক্তবৃন্দের সংগঠন) ইত্যাদি। সমাজে যাদের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়।
এই উপদলগুলো সাধারণত রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। তবে রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের সময় তাদের ভোট নিজেদের দলে আনার জন্য তাদেরকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। কেননা তাদের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে। গুলেন গ্রুপও শুরু থেকে নিজেদের জামায়াত তথা গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি দিত।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গুলেন নিজেকে প্রগ্রেসিভ ইসলাম বা ইসলামের ‘উদারবাদী’ ধারার একজন প্রচারক বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে নিজেকে চরমপন্থী ইসলামের বিপরীতে আরো বেশি করে উদারবাদী ইসলামের অগ্রগণ্য মুখ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
গুলেন মুভমেন্ট প্রাথমিকভাবে পরিচয় পায় একটি শিক্ষা আন্দোলন হিসেবে কিংবা সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এজন্য তুরস্কে তারা একসময় পরিচিত ছিল ‘হিজমেত’ তথা সেবা মুভমেন্ট হিসেবে।
এই নাম দিয়ে তারা তুরস্কে ব্যাপকহারে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থার নাম দিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে ডরমিটরি প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ব্যবসা, প্রকাশনা, ব্যাংকিংসহ সকল সেক্টরে তারা ভালো একটি অবস্থান সৃষ্টি করে। প্রথমে তুরস্কে, পরে পুরো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
গুলেন সংগঠনটি একটি পদ-সোপানের ভিত্তিতে চলা সংগঠন, যার সর্বোচ্চ কমিটিগুলো হচ্ছে- নিয়োগ কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদ, গ্রুপ অভ মোল্লা অ্যান্ড মজলিস। তাদের নেতারা ইমাম হিসেবে পরিচিত।
ওপর থেকে নিচের দিকে যথাক্রমে বিশ্ব ইমাম, মহাদেশীয় ইমাম, জাতীয় ইমাম, আঞ্চলিক ইমাম, প্রদেশীয় ইমাম, উপজেলা/কাউন্টি ইমাম, হাউজ ইমাম, হেড গাইড, ছাত্র এবং কংগ্রেস সদস্য হিসেবে পরিচিত। সংগঠনটি একটি পিরামিড নির্দেশিকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রথম সারি দ্বিতীয় সারিকে নির্দেশ দেয়, দ্বিতীয় সারি তৃতীয় সারিকে নির্দেশ দেয়, এভাবে নিচের দিকে আসে। ফেতুল্লাহ গুলেন পরিচিত বিশ্ব ইমাম কিংবা প্রধান হিসেবে। তিনি-সহ সাত সদস্যের গভর্নিং বডি-ই ‘গুলেন’-এর সর্বোচ্চ বডি হিসেবে পরিচিত।
সংগঠনের ওপরের স্তরে সদস্যদেরকে ইমামদের নিকট শপথ নিতে হয়। শপথ অনুষ্ঠান খুবই ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। আর শপথ নেওয়াটা বাধ্যতামূলক, যাতে তারা অনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়।
তাদের বাসা-বাড়ি কিংবা ডরমেটরিগুলোতে থাকা ছাত্র, যারা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছে, তারা ইমামের কথামতো মুভমেন্টের স্বার্থে যেকোনো কিছু করার জন্য শপথ গ্রহণ করেন।
তাদের সংগঠনে একক যোগাযোগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তাতে একজন সদস্য শুধু তার সাথে যোগাযোগ করার লোককেই চেনে। যার ফলে কোনো কারণে কোনো বিষয় ফাঁস হয়ে গেলে, শুধু ঐ একজন পর্যন্তই যেতে পারে। পুরো বিশ্বেই তাদের এই যোগাযোগ নেটওয়ার্কটি একই রকম।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, তারা লং টাইম পরিকল্পনায় যেকোনোভাবেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। এজন্য সরকারের বিভিন্ন জায়গাতে তারা লোক ঢুকিয়ে দেয়। নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে প্রশাসন, বিচারবিভাগ, সেনাবাহিনীসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের লোক প্রবেশ করায়।
যখন যথেষ্ট পরিমাণে লোক হয়, তখন তারা সরকারকে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে পরিচালনা করতে চায়। যদি সরকার কথায় কাজ না করে, তাহলে তারা নিজেরাই ক্ষমতায় বসার জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারে।
গুলেন সবসময় তাদের সাংগঠনিক স্বার্থ উদ্ধারে সব সরকারকেই ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। ১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে যেখানে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, সেখানে তিনি তার গ্রুপের পক্ষ থেকে সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। সে বছর গুলেন দ্য লাস্ট ব্যারাক নামে একটি বই লেখেন, যাতে উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশংসা করেন এবং সামরিক সরকারের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
১৯৯৭ সালের পোস্ট মডার্ন সেনা অভ্যুত্থানের সময় ইসলামপন্থী দল নিষিদ্ধ এবং অন্যান্য জামায়াত তথা ধর্মীয় উপদলগুলো সমস্যার সম্মুখীন হলেও, তারা দিব্যি তাদের কাজ চালিয়ে গেছে। সেই সাথে তারাও সামরিক সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।
বারাক ওবামা যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পেলেন, তখন তারা কেনিয়ার ছাত্রদেরকে বৃত্তি দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। এটি শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং পুরো বিশ্বেই তাদের স্কুলগুলোতে ঐ দেশের উচ্চপদস্থ আমলা, সেনা কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ীদের ছেলেদেরকে টার্গেট করে তাদের স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করেন এবং ওপরের পদ্ধতিতে তাদেরকে ঐ দেশে তাদের লোক বলে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এদিকে ২০১০-১১ সালের দিকে এসে তুরস্কের শিক্ষা, মিডিয়াসহ বড় বড় সেক্টরগুলো তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্বে চলে আসে। ওদিকে সরকারের বিভিন্ন পদে ঢুকানো লোকগুলো সিনিয়র হয়ে বড় পদগুলোতে চলে আসে। পুরো প্রশাসনে তারা সিন্ডিকেট শুরু করে।
তারা রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র তৈরি করে, যাকে ‘প্যারালাল রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করা হয়। সেনাবাহিনী, বিচারপতি, প্রশাসন ইত্যাদি সেক্টরে যখন তার একটা শক্ত অবস্থানে পৌঁছায়, তখনই তাদের মাথায় গণতান্ত্রিক সরকারকে হটানোর চিন্তা আসে। যারই ধারাবাহিকতায় ১৫ই জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থান।
১৫ জুলাই-এ পরিকল্পনা কী ছিল? কীভাবে এই অভ্যুত্থান সম্পাদন করেছে, এগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভ্যুত্থানের রাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের মোবাইলের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপগুলোই তার বড় প্রমাণ। যার মাধ্যমে তারা অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য নেটওয়ার্কিং করছিল।
একে পার্টির সাথে সম্পর্কের অবনতি
২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মিত্র ছিলেন। কিন্তু ঐ বছর তুরস্ক সরকারের সমর্থকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের সূত্র ধরে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জ্যেষ্ঠ সমর্থকদের বিরুদ্ধে ওই দুর্নীতির তদন্তে তার ছেলে বিলালের নামও ছিল। এই তদন্তের জন্য পুলিশ ও বিচার বিভাগে থাকা গুলেনের অনুসারীদের দায়ী করেন এরদোয়ান ও তার দল একে পার্টি। গুলেনপন্থী ও হিজমেত আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার এরদোয়ানের প্রচেষ্টার প্রতিশোধ হিসেবে ওই দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় বলে মনে করে একে পার্টি।
এই বিরোধের জেরে তুর্কি সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলেনপন্থী বেশকিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও যাদের সঙ্গে গুলেনপন্থীদের সম্পর্ক আছে বলে খবর রটে, তাদের বের করে দেয় এরদোয়ান সরকার। বর্তমানে তুরস্কের ফেরারি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় গুলেনের নাম আছে।
তুর্কি কর্মকর্তারা তাকে ‘গুলেনপন্থী সন্ত্রাসী সংস্থার’ নেতা বলে অভিহিত করে। তুরস্কের একটি ফৌজদারি আদালত গুলেনের বিরুদ্ধে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিল। তুরস্ক গুলেনকে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়েছিল।
১৫ জুলাই রাতে যখন সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার খবর ছড়িয়ে পড়ে তখন তুর্কি সরকারের পক্ষে কাজ করা আইনজীবী রবার্ট আর্মস্টের্ডাম বলেন, গুলেনপন্থীদের সরাসরি জড়িত থাকার ইঙ্গিত আছে।
তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান বার বার যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে গুলেন ও তার হিজমেত আন্দোলনের ‘হুমকি’ সম্পর্কে ‘সতর্ক’ করার চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন। আর্মস্টার্ডাম বলেন, তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করেছে, নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে গুলেন কাজ করছেন- এমন ইঙ্গিত পেয়েছে তারা
১৫ই জুলাইয়ের অভ্যুত্থান
২০১৬ সালের ১৫ই জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল গুলেন মুভমেন্টের চুড়ান্ত রূপ। সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ে যখন তাদের অধিপত্য চলে আসে তখন তারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য সরকারকে ব্যবহার করতে চাই।
১৫ জুলাই মধ্যরাতের আগে তুরস্কের স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সামরিক পুলিশের অভ্যুত্থানকারী দল ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার মূল পয়েন্টসমূহ, বিমানবন্দর, তুর্কি জেনারেল স্টাফের সদর দপ্তর, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদরদপ্তর, প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সংসদ ভবন ও বসফরাস প্রণালির মূল সেতুতে অবস্থান নেয়।
অভ্যুত্থানকারীরা জাতীয় টেলিভিশন থেকে অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করে এবং অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে এরদোয়ান সরকারের গণতন্ত্রের অপব্যবহার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে।
অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। এরদোয়ানের এই আহ্বান মসজিদ ও একেপি পার্টির অফিসগুলো থেকে প্রচার করা হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একেপি পার্টির কর্মী-সমর্থকরা ইস্তাম্বুল-আঙ্কারার রাজপথে নেমে আসে।
রাত ৩:২০-এ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইস্তানবুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে নামেন। যখন রানওয়ে ছিল পুরোই অন্ধকারে এবং বিমানবন্দরের দখল নিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনতার সংঘর্ষ চলছিল। আকাশে উড়ছিল বিদ্রোহীদের যুদ্ধবিমান।
বিমানবন্দরেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একটি সংক্ষিপ্ত প্রেস কনফারেন্স করেন। তিনি বলেন বিদ্রোহীরা ব্যর্থ হয়েছে। এখনও যারা ব্যারাকের বাইরে আছে, তাদেরকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য আহবান জানান। প্রথমবারের মতো তখন এরদোয়ান ঘোষণা করেন যে, এই ঘটনা ফেতুল্লাহ গুলেনের নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছে।
পরবর্তীতে স্থানীয় সময় সকাল ৮টা নাগাদ এরদোয়ান সরকার পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ব্যর্থ হয় সামরিক অভ্যুত্থান।
ফেতুল্লাহ গুলেন জড়িত থাকার প্রমাণ
তুরস্কের স্থানীয় গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেসব বিশ্লেষণ এসেছে, সবখানেই ফেতুল্লা গুলেনের নামটি এসেছে। আগে-পরের পরিস্থিতির আলোকে তুরস্কের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীরও বদ্ধমূল ধারণা- এ কাজটি গুলেনপন্থীদের দ্বারাই ঘটেছে।
এছাড়া অভ্যুত্থানকারী গ্রেফতার হওয়া সেনা অফিসারদের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে তারা ফেতুল্লাহ গুলেনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিল।
আরেকটি তত্ত্ব এসেছে পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে। তাদের বক্তব্য হলো, এরদোয়ান সরকার গুলেন-সমর্থক সামরিক কর্মকর্তাদের চক্রান্তের বিষয়ে কিছুটা আগেই টের পেয়েছিল। যে কারণে ১৬ জুলাই তারিখেই গুলেন-সমর্থক কিছু সামরিক কর্মকর্তার শাস্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। যা টের পেয়ে অভ্যুত্থানকারীরা নির্ধারিত সময়ের আগেই বিদ্রোহ ঘটিয়ে ফেলে। এটিই ছিল গুলেন সমর্থকদের ক্ষমতা দখলের একটা শেষ চেষ্টা।