হে। আদনান। জে।
২০১৪ সালের শেষ কয়েক মাস যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছিল এই তিনটি নাম, যেগুলো জড়িত এক চাঞ্চল্যকর হত্যা রহস্যের সাথে। তখন এই নামগুলো মানুষের কাছে অতি পরিচিত হয়ে ওঠে সারাহ কিনিগ উপস্থাপিত, সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত অডিও ডকুমেন্টারি পডকাস্ট ‘সিরিয়াল’ এর মাধ্যমে। পডকাস্টটিও পরিণত হয় একটি পপ কালচার অবসেশনে।
এই একটি পডকাস্টই যখন ১০০ মিলিয়নেরও বেশিবার ডাউনলোড হয়ে যায়, তখন পডকাস্ট জিনিসটির অনুপ্রবেশ ঘটে মূলধারার গণমাধ্যমে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী জোয়ার আসে ‘দ্য জিংক্স’ কিংবা ‘মেকিং আ মার্ডারার’ প্রভৃতি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে টিভি সিরিজ নির্মাণের।
এরপর প্রায় পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো জনমনে উন্মাদনা কমেনি হে, আদনান কিংবা জে’র ব্যাপারে। বরং এ বছর মার্চে মুক্তি পাওয়া এইচবিও অরিজিনাল ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘দ্য কেস এগেইনস্ট আদনান সৈয়দ’-এর মাধ্যমে নতুন করে আবারো আলোচনায় এসেছে হে মিন লি-র হত্যা রহস্য।
আদনান সৈয়দ কে?
আদনান সৈয়দ একজন মুসলিম-আমেরিকান। তার জন্ম ২১ মে, ১৯৮০ সালে, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ডের একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তার বাবা শামিম রহমান, মা সৈয়দ রহমান। তিন ভাইয়ের মধ্যে আদনান দ্বিতীয়। তার বড় ভাই তানভীর, আর ছোট ভাই ইউসুফ।
উডল্যান্ড হাই স্কুলে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন আদনান। পড়াশোনাতেও ছিলেন সমান মেধাবী, সব বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড পেতেন তিনি। এছাড়াও তিনি ছিলেন হোমকামিং কিং, খেলতেন ভার্সিটি ফুটবল দলের হয়ে। এছাড়া পার্ট-টাইম চাকরিও করতেন একটি প্যারামেডিক সার্ভিসে।
কেন তিনি পরিচিত?
আদনান ১৯৯৯ সালে তার প্রাক্তন প্রেমিকা হে মিন লিকে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। খুনের সময়, আদনান এবং কোরিয়ান-আমেরিকান হে, দুজনেই বাল্টিমোরের উডলন হাই স্কুলের সিনিয়র ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১৩ জানুয়ারি নিখোঁজ হন হে, এবং তার মাসখানেক বাদে নিকটস্থ একটি সিটি পার্কে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় শ্বাসরোধ করে হত্যা। প্রাথমিক সন্দেহভাজন হিসেবে আদনানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, এবং ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে অতিরিক্ত ৩০ বছরসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।
তবে আদনান আদালতে বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন। ২০১৪ সালে ‘সিরিয়াল’ পডকাস্টের মাধ্যমে সাংবাদিক ও রেডিও ব্যক্তিত্ব সারাহ কিনিগ তার মামলাটির ব্যাপারে আলোকপাত করলে, বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পডকাস্টে সারাহ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, আসলে হয়তো আদনান দোষী ছিলেন না। ফলে বিভিন্ন মহল থেকে পুনরায় বিচারকার্য শুরু করার দাবি উঠতে থাকে।
২০১৬ সালের জুনে বাল্টিমোর সিটি সার্কিট আদালতের একজন বিচারপতি আদনানের মামলার নতুন করে শুনানির আবেদন মঞ্জুর করেন। ২০১৮ সালের মার্চে মেরিল্যান্ড কোর্ট অব স্পেশাল আপিলস সে সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। কিন্তু ২০১৯ সালের ৮ মার্চ মেরিল্যান্ড কোর্ট অব আপিলস তা নাকচ করে দেয়।
আদনান ও হে-র সম্পর্ক
আদনানের মতো স্কুলে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন হে-ও। তিনি ল্যাক্রোজ ও ফিল্ড হকি টিমের সদস্য ছিলেন, দায়িত্ব পালন করতেন ছেলেদের রেসলিং টিমের ম্যানেজার হিসেবে, এবং সেই সাথে তিনি স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে একজন অপটিশিয়ান হওয়ারও।
আদনান ও হে-র মধ্যে একটি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু তারা এ সম্পর্কটিকে গোপন রেখেছিলেন। কেননা তারা দুজনেই উঠে এসেছিলেন রক্ষণশীল অভিবাসী পরিবার থেকে। তাই তাদের আশঙ্কা ছিল, দুজনের কারো পরিবারই তাদের মধ্যকার সম্পর্কটিকে ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন সম্পর্ককে আড়াল করে রাখতে রাখতে, হাঁপিয়ে উঠেছিলেন হে। তাই আদনানের সাথে ব্রেক-আপ করে ফেলেন তিনি, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ডন নামে একটি ছেলের সাথে। ডন ও হে একসাথে কাজ করতেন স্থানীয় লেনসক্র্যাফটারে।
হে-র হত্যাকাণ্ড
১৯৯৯ সালের ১৩ জানুয়ারি নিখোঁজ হন ১৮ বছর বয়সী হে। অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন না, তখন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে তার পরিবার। এর চার সপ্তাহ পরে, নিকটস্থ লিকিন পার্কে তার মৃতদেহ অর্ধ-সমাহিত অবস্থায় আবিষ্কার করেন এক পথচারী। অটোপসি রিপোর্ট জানায়, শ্বাসরোধের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে তাকে।
আদনানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রমাণ
হে-র মৃতদেহ আবিষ্কারের পর, পুলিশি তদন্ত চলতে থাকে। তদন্তের মাধ্যমে পুলিশ আদনানের বন্ধু জে ওয়াইল্ডসের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে যে, তিনি হে-র লাশ কবর দিতে আদনানকে সাহায্য করেছিলেন। এর সূত্র ধরে, ১৯৯৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় আদনানকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় হে-কে অপহরণ ও হত্যার।
যদিও প্রসিকিউটররা আদনানের বিরুদ্ধে কোনো শারীরিক প্রমাণ হাজির করতে পারেননি, তবে তারা ওয়াইল্ডসের জবানবন্দিকে আদালতে গুরুত্বের সাথে পেশ করেন। পাশাপাশি জেনিফার পুসাটেরি নামক একজন প্রতিপাদক সাক্ষীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করেন, যিনি আদালতে বলেন যে ওয়াইল্ডস তার কাছে আদনানের স্বীকারোক্তির কথা বলেছিলেন, এবং তাকে মৃতদেহটিও দেখিয়েছিলেন।
ওয়াইল্ডস বলেন, ব্রেক-আপ করায় হে-র উপর খুবই রেগে ছিলেন আদনান। ডনের সাথে হে-র নতুন সম্পর্কও মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। এবং প্রতিশোধ নিতেই হে-কে হত্যা করেছিলেন তিনি। এছাড়া প্রসিকিউটররা সেল টাওয়ার রেকর্ডকেও কাজে লাগান, যার অনেক তথ্যের সাথে ওয়াইল্ডসের বলা ঘটনাপ্রবাহের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বিচারের রায়
আদনান কখনোই তার দোষ স্বীকার করেননি। আগাগোড়াই তিনি নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে এসেছেন। তারপরও ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে ফার্স্ট-ডিগ্রি মার্ডার চার্জ আনা হয়, এবং তাকে অতিরিক্ত ৩০ বছরসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
আদনানের রায়ের পর থেকে, ওয়াইল্ডস বেশ কয়েকবার তার স্বীকারোক্তি পরিবর্তন করেছেন। সম্প্রতি পুলিশের সাথে ওয়াইল্ডসের সাক্ষাৎকারের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, অনেক জবানবন্দিই তিনি বাল্টিমোর পুলিশের নির্দেশ অনুযায়ী দিয়েছেন। এ থেকে অনেকেরই ধারণা, পুলিশ হয়তো ভালো করে তদন্ত করেনি। বরং ইচ্ছা করেই আদনানের উপর সকল দায় চাপিয়ে দিয়েছে।
আপিল
২০০৩ সালে আদনান তার মামলার আপিল করেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ২০১০ সালে তিনি আবার আপিল করেন, এবার “কাউন্সেলের সমর্থনহীনতা”র উপর ভিত্তি করে। আদনান দাবি করেন যে, এ পর্যায়ে তার অ্যাটর্নি ক্রিস্টিনা গুতিয়েরেজ তার সাক্ষী অ্যালিবাই আশিয়া ম্যাকক্লেইনের কথা আমলে নেননি, যিনি বলেছিলেন হত্যাকাণ্ডের সময় আদনান তার সাথে উডলন হাই স্কুলের লাইব্রেরিতে ছিলেন।
ম্যাকক্লেইনের বক্তব্যের পাশাপাশি আদনানের আপিল আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ-ও বলেন যে, প্রথম শুনানির সময় আদালতে প্রমাণ হিসেবে যে সেল টাওয়ার রেকর্ড ব্যবহৃত হয়েছিল, তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
২০১৪ সালে ‘সিরিয়াল’-এর মাধ্যমে আদনানের বিরুদ্ধে মামলাটি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে, ২০১৬ সালের জুনে বাল্টিমোর সিটি সার্কিট কোর্টের আইনজীবী মার্টিন ওয়েলচ আদনানের পুনঃবিচারের আবেদন মঞ্জুর করেন। ২৯ মার্চ, ২০১৮ সালে মেরিল্যান্ড কোর্ট অব স্পেশাল আপিলসও তা বহাল রাখে। কিন্তু এক বছর পর, রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত ৪-৩ ভোটে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেয়। পাশাপাশি তারা আরো বলে, আদনানের প্রথম বিচারের সময় লিগ্যাল কাউন্সেলের যদি কোনো খামতি থেকেও থাকে, তারপরও নতুন যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হচ্ছে তাতে জুরিদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হবে না।
গণমাধ্যমে আদনানের মামলা
যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে আদনানের মামলা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় ‘সিরিয়াল’ পডকাস্টের মাধ্যমে। এছাড়া সম্প্রতি, ২০১৯ সালের মার্চে এইচবিও-তে সম্প্রচার শুরু হয়েছে আদনানের বিচারকার্য নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি। কিন্তু শুধু এই দুটিই নয়। গণমাধ্যমে আরো একাধিকবার এসেছে আদনানের মামলাটি।
আদনানের আইনজীবী ও পারিবারিক বন্ধু রাবিয়া চৌদ্রি প্রকাশ করেছিলেন তার নিজস্ব একটি পডকাস্ট – ‘আনডিসক্লোজড: দ্য স্টেট ভার্সেস আদনান সৈয়দ’। তিনি আদনানকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন, যার নাম ‘আদনান’স স্টোরি: দ্য সার্চ ফর ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস আফটার সিরিয়াল (২০১৬)’। আদনানকে নিয়ে বই লিখেছেন ম্যাকক্লেইনও, নাম দিয়েছেন ‘কনফেশন্স অফ এ সিরিয়াল অ্যালিবাই (২০১৬)’। একই বছর ইনভেস্টিগেশন্স ডিসকভারিও আদনানকে নিয়ে মুক্তি দেয় ডকুমেন্টারি ‘আদনান সৈয়দ: ইনোসেন্ট অর গিল্টি?’
শেষ কথা
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে আদনান সৈয়দের মামলাটি নিয়ে যে পরিমাণ চর্চা হয়েছে, আর কোনো হত্যা মামলা নিয়েই এত বেশি চর্চার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, গণমাধ্যমে মামলাটিকে যতটা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য হাজির করা হচ্ছে, সে তুলনায় মূল আদালতে মামলাটি নিয়ে সেরকম কোনো অগ্রগতিই চোখে পড়ছে না। ফলে প্রায় ২০ বছর হতে চললেও, এখন পর্যন্ত এটিই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, আদনান কি আসলেই দোষী, নাকি নির্দোষ?
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/