প্রতিটি দেশেই শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে এমন একজন ব্যক্তি থাকেন, যিনি দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা উপভোগ করেন। সাংবিধানিক উপায়েই দেশ পরিচালনার দায় যেই ব্যক্তির কাঁধে ন্যস্ত থাকে, তার হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। যেমন- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে।
আমাদের দেশের কথা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে আক্ষরিক অর্থে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তার এই ক্ষমতার বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। রাষ্ট্রপতি কাগজে-কলমে রাষ্ট্রীয় প্রধান হলেও তিনিও আমাদের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কোনো কোনো দেশে আবার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে বেশি হয়ে থাকে। যেমন- আমেরিকার কথা বলা যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হচ্ছে ইরান। এই দেশের শাসনব্যবস্থা বেশ জটিল। এখানে একইসাথে যেমন শিয়া মতাদর্শভিত্তিক ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করা হয়েছে, তেমনই অনেক ক্ষেত্রে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন নীতিকেও স্থান দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধান বিচারপতি নয়, ইরানের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী হলেন দেশটির ‘সুপ্রিম লিডার’। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘রাহবার-ই-মোয়াজেম-ই-ইরান’। এছাড়াও তাকে ‘রাহবার-ই-মোয়াজেম-ই-ইনকিলাব-ই-ইসলাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে ‘ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা’। তিনি এত বেশি ক্ষমতা উপভোগ করেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে একজনের হাতে এত বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে যে, এটি রীতিমতো বিস্ময়কর। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে রদবদলও এসেছে অনেক কম। ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ইরানে এখন পর্যন্ত ছয়জন ব্যক্তি দেশটির রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও এখন পর্যন্ত ‘সর্বোচ্চ নেতা’র পদ অলংকৃত করেছেন মাত্র দুজন ব্যক্তি।
ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করে থাকে ‘মজলিস-ই-খোবরেগান-ই-রাহবারি’ নামেী একটি সংসদ। এই সংসদের সদস্য হচ্ছেন ৮৮ জন। এই সংসদ চাইলে একজন দায়িত্বরত সর্বোচ্চ নেতাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও প্রদান করতে পারে। সাধারণত একটি দেশের সরকারের তিনটি বিভাগ থাকে। এগুলো হল– আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আইন বিভাগের কাজ হচ্ছে দেশ শাসনের জন্য আইন প্রণয়ন করা, শাসন বিভাগ সেই আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ও আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে। ইরানে এই তিনটি বিভাগেরই প্রধান হচ্ছেন হচ্ছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা বা ‘সুপ্রিম লিডার’। তিনি একইসাথে দেশটির সামরিক বাহিনীগুলোর সর্বোচ্চ নেতা। ইরান রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি কারও বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়, তবে সেটি দেশটির সর্বোচ্চ নেতার অনুমতি ব্যতীত সম্ভব নয়। এত ক্ষমতাশালী একটি পদে তাই ঘন ঘন রদবদল আনা হয় না। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি প্রায় চৌত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন।
ইরানের প্রায় সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ নেতার হাতে। যেমন- ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেন দেশটির রাষ্ট্রপতি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা চাইলে দেশটির আইনসভার দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়ে তাকে অভিশংসন করতে পারেন। দেশটির প্রধান বিচারপতিকে আট বছর মেয়াদে নিয়োগ প্রদানের কাজটিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা করে থাকেন। দেশটির প্রভূত ক্ষমতাশালী ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’ এর মোট বারোজন সদস্যের মধ্যে ছয়জনকে তিনি সরাসরি নিয়োগ দেন, আর বাকি ছয়জনকে প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। গার্ডিয়ান কাউন্সিল দেশটির জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয় এবং আইনসভা দ্বারা পাশকৃত আইনে ভেটো দেয়ার ক্ষমতাও এই সংসদের রয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা চাইলে দেশটির সরকারের প্রতিটি বিভাগে নিজের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারেন। এছাড়াও ইরানের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের প্রধানকেও তিনিই নিয়োগ প্রদান করে থাকেন।
সংবিধান ও অন্যান্য আইনের দ্বারা ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপর বিশাল ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। একটি ছোট আর্টিকেলে সবগুলো বর্ণনা করা করা সম্ভব নয়। ইরানের জাতীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তবে সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের দায়িত্ব হচ্ছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার। তিনটি সামরিক বাহিনীর প্রধান হচ্ছেন তিনি। সংসদ কোনো আইন পাশ করলে তিনি সেটাতে কারণ দর্শানোর পরিপ্রেক্ষিতে ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়া দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে দুজন প্রতিনিধি প্রেরণ করার এখতিয়ার রয়েছে তার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদেরও তিনি চাইলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি কিংবা পুনর্বহাল করতে পারেন। এছাড়াও বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া কোনো ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে তিনি শাস্তি মওকুফ করতে পারেন বা কমিয়ে দিতে পারেন। এছাড়াও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে গ্রহণকৃত কোনো সিদ্ধান্ত তার অনুমোদন পাওয়ার পর কার্যকর করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কূটনৈতিকভাবে ইরান কোনো নীতি অনুসরণ করবে– এটিও তার দ্বারাই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
কেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হাতে এত বেশি ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গ্রহন করা উচিত। শিয়ারা মনে করে, ইসলাম ধর্মের সর্বোচ্চ নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর উত্তরসূরি হিসেবে বারোজন ইমাম রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। তাদের ইতিহাস অনুযায়ী, নবম শতকে বারোতম ইমাম আত্মগোপন করেন। সেই ইমামের অনুসারীরা পরবর্তীতে প্রচার করেন যে ভবিষ্যতে রক্ষাকর্তা হিসেবে সেই ইমাম আবার আবির্ভূত হবেন মানুষের মাঝে। ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর বিপ্লবের প্রাণপুরুষ আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি বলেছিলেন যে সেই আত্মগোপনে কিংবা হারিয়ে যাওয়া ইমামের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্বের জন্য ইরানের শাসনব্যবস্থায় এমন একটি পদ তৈরি করা হবে, যে পদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী পদ হিসেবে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হবে। এভাবেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদ তৈরি করা হয়েছিল।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্রই চেষ্টা করে থাকে একজন ব্যক্তির হাতে যেন বিশাল ক্ষমতা অঙ্গীভূত না হয়। তাই সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মাঝে ক্ষমতা বন্টন করে দেয়া হয়। কিন্তু ইরান এই দিক থেকে ব্যতিক্রম। ইরানে কখনোই ‘সুপ্রিম লিডার’ তথা সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা কমিয়ে আনার দাবি তোলা হয়নি প্রবলভাবে। দেশটির যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার সবগুলোই প্রায় সর্বোচ্চ নেতার এখতিয়ারে রয়েছে। তিনি চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারেন, যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা হলেন আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি, যিনি দীর্ঘসময় ধরে পদটিতে বহাল রয়েছেন।