[৩য় পর্ব পড়ুন]
সম্প্রতি দনেৎস্কের ওপরে পরিচালিত ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক বিষয়াবলি সংক্রান্ত বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে এবং বিশ্বব্যাপী সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই বিষয়ে নানাবিধ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। দনবাস যুদ্ধ যেহেতু চলমান রুশ–পশ্চিমা প্রক্সি যুদ্ধের একটি অংশ (যেখানে দনেৎস্ক ও লুহানস্ক রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে এবং ইউক্রেন মার্কিন–নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে), সেহেতু এই বিষয়ে রুশ ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতামত প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে পরিচালিত ড্রোন আক্রমণের ব্যাপারে রুশ ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতামতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান।
রুশ বিশ্লেষকদের মতামত
দনেৎস্কের ওপর পরিচালিত ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণের বিষয়ে রুশ বিশ্লেষকরা কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এদের মধ্যে একাংশ দনেৎস্ক ও লুহানস্ক কর্তৃক ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্যের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন, অন্যদিকে অপর অংশ এই ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু উভয় পক্ষই একটি বিষয়ে একমত, আর সেটি হচ্ছে, দনবাসে ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার বিশেষভাবে সক্রিয় হওয়া উচিত।
রুশ–আর্মেনীয় রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া বিশেষজ্ঞ এবং রুশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ দ্য মিডল ইস্ট অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়া’র পরিচালক সেমিয়ন বাগদাসারভ মন্তব্য করেছেন যে, দনবাসের বর্তমান সামরিক পরিস্থিতির সঙ্গে ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের (যেটি ‘৪৪ দিনের যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত) উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। তার মতে, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক সৈন্যদের ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর সামর্থ্যকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না, কারণ ইউক্রেন সক্রিয়ভাবে নিজেকে অস্ত্রসজ্জিত করছে এবং রাশিয়ার শত্রুদের মধ্যে নিজেদের মিত্র খুঁজে পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দনেৎস্ক ও লুহানস্ক একবার (২০১৪ সালে) ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বলেই যে আবারো তারা বিজয়ী হবে, এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই, কারণ একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে তারাই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, যারা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত।
বাগদাসারভ উল্লেখ করেছেন, আর্তসাখে সুসজ্জিত সামরিক প্রকৌশলগত কাঠামো ছিল না, কেবল পরিখা ও ছোট ছোট আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। এর ফলে আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী সহজেই আর্মেনীয়দের অবস্থান ধ্বংস করে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করতে পেরেছিল। দনবাসের পরিস্থিতিও বহুলাংশে আর্তসাখের অনুরূপ, কারণ সেখানেও সংযোগরেখা বরাবর কোনো শক্তিশালী সামরিক প্রকৌশলগত কাঠামো নেই। তদুপরি, নাগর্নো–কারাবাখ মূলত পার্বত্য অঞ্চল (যেখানে শত্রুপক্ষের জন্য অগ্রসর হওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল), কিন্তু দনবাস সমতলভূমি। তার মতে, এটি দনেৎস্ক ও লুহানস্ক সৈন্যদের প্রতিকূলে। কার্যত তিনি এই মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হলে প্রজাতন্ত্র দুটি ৪৪ দিন টিকে থাকতে পারবে কিনা।
বাগদাসারভের মতানুযায়ী, ইউক্রেন ‘মিনস্ক প্রোটোকল’ ও ‘মিনস্ক ২’ চুক্তি মেনে চলবে, এই আশা করা অযৌক্তিক। বর্তমান বিশ্বে চুক্তি অকার্যকর এবং যারা শক্তিশালী, কার্যত তারাই সঠিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পরিস্থিতিতে রুশ সহায়তা ছাড়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ক টিকতে পারবে না। এমতাবস্থায় দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে, এই মর্মে রাশিয়ার ঘোষণা প্রদান করা উচিত বলে বাগদাসারভ মন্তব্য করেছেন।
রুশ সামরিক বিশ্লেষক আলেক্সেই লিয়নকভের ভাষ্যমতে, ইউক্রেন কর্তৃক তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ব্যবহারের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে এবং এখন সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। যথারীতি দনেৎস্ক ও লুহানস্ক এজন্য প্রস্তুত ছিল না, কারণ তারা ইতিপূর্বে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করে এসেছে। অবশ্য তার মতে, এই সমস্যার সমাধান রয়েছে, কিন্তু সেই সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ব্যাপারে যথেষ্ট সঠিক ও মনোবলবর্ধক বক্তব্য দিয়েছে, কিন্তু এখন বক্তব্য প্রদানের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এবং রাশিয়াকে তার বক্তব্যের দ্বারা নয়, কর্মের দ্বারা বিচার করা হবে।
লিয়নকভ উল্লেখ করেছেন যে, সিরীয়রা তুর্কি ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং দেরিতে হলেও বিগত আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আর্মেনীয়রা তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ধ্বংস করতে পেরেছে। সহজ ভাষায়, লিয়নকভের মতে দনবাসে ইউক্রেনীয় ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হচ্ছে রাশিয়া কর্তৃক উক্ত ড্রোনগুলো ভূপাতিত করা।
রুশ সামরিক বিশ্লেষক ও ‘আর্সেনাল অফ দ্য ফাদারল্যান্ড’ ম্যাগাজিনের মুখ্য সম্পাদক ভিক্তর মুরাখোভস্কির ভাষ্যমতে, ইউক্রেন দনবাসের রুশ–সমর্থিত প্রজাতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে কমব্যাট ড্রোন ও অন্তর্ঘাতক দল ব্যবহার করে রাশিয়ার ‘রেড লাইন’ পরীক্ষা করছে এবং এক পর্যায়ে এটি এতদঞ্চলে ‘বিস্ফোরণ’ ঘটাতে পারে। তার মতে, ইউক্রেন দনবাসে যে ধরনের কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করেছে, সেই ধরনের ড্রোনের আক্রমণ প্রতিহত করার মতো এয়ার ডিফেন্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এখন পর্যন্ত দনবাসের প্রজাতন্ত্রগুলোতে লক্ষ্য করা যায়নি।
তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে সেখানে এই ধরনের সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা হতে পারে, কিন্তু ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করার, বা অন্ততপক্ষে তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করার, সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রদের ক্যামোফ্লাজের মাধ্যমে আড়াল করে রাখা, সৈন্যদের এক স্থানে কেন্দ্রীভূত না করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রাখা এবং সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জানের জন্য আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা। অবশ্য তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে, এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও দনবাসের প্রজাতন্ত্রগুলোর সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম ড্রোন আক্রমণের শিকার হতে পারে, এমন সম্ভাবনা থেকে যায়। এজন্য ড্রোন আক্রমণ চূড়ান্তভাবে প্রতিহত করার জন্য সেখানে ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম মোতায়েন করা আবশ্যক।
মুরাখোভস্কি যোগ করেছেন যে, সামরিক পন্থা বাদে অন্যভাবেও ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহার বন্ধ করা যেতে পারে, এবং সেই অন্য পন্থাটি হচ্ছে কূটনীতি। তিনি মনে করেন, মিনস্ক চুক্তিসমূহের আওতায় সকল পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে দনবাসে একটি ‘নো ফ্লাই জোন’ সৃষ্টি করা সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে দনবাসের প্রজাতন্ত্রগুলো আর ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণের শিকার হবে না।
রুশ সামরিক বিশ্লেষক, এয়ার ডিফেন্স ট্রুপসের প্রাক্তন সিনিয়র কর্মকর্তা ও ‘মিলিটারি–ইন্ডাস্ট্রিয়াল কুরিয়ার’ ম্যাগাজিনের প্রাক্তন মুখ্য সম্পাদক কর্নেল মিখাইল খোদারেনোকের বক্তব্য অনুযায়ী, দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বর্তমানে পরিস্থিতিতে সেখানে ইউক্রেনীয় কমব্যাট ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। তার মতে, আকৃতি ও গতি অনুসারে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন অপরাজেয় নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ধরনের ড্রোন ধ্বংস করার জন্য একটি কার্যকরী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থাকা প্রয়োজন। কিন্তু একটি কার্যকরী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তোলার জন্য কেবল বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং একটি রাডার রিকনিস্যান্স সিস্টেম, একটি স্বয়ংক্রিয় তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা ও একটি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন এবং সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে সংযুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে করে সঠিক সময়ে লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে সেটির প্রতি আঘাত হানা যায়।
তিনি যোগ করেছেন যে, হালকা বিমান–বিধ্বংসী অস্ত্রের সাহায্যে কার্যকরভাবে তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়, কারণ এই ড্রোনগুলো বেশ কয়েক হাজার মিটার উচ্চতায় ওড়ে। তার মতানুসারে, ইউক্রেন কর্তৃক এই ধরনের ড্রোনের ব্যবহার দনেৎস্ক ও লুহানস্কের সৈন্যদের মনোবলে চিড় ধরাবে, কারণ ড্রোনগুলো যখন আক্রমণ চালায়, সেগুলোকে দেখা যায় না, সেগুলোর শব্দ প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে এবং সেগুলো থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রও লক্ষ্যবস্তুর ওপর নিপতিত হওয়ার আগে শব্দ করে না। অর্থাৎ, এই ধরনের আক্রমণের সময় স্থলসৈন্যরা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থাকে। খোদারেনোকের মতে, দনেৎস্ক ও লুহানস্কের পক্ষে এই ধরনের আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো সামর্থ্য নেই, এজন্য ইউক্রেন এই ধরনের আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারে।
রুশ রাজনীতিবিদ, সামরিক বিশ্লেষক ও লেখক এবং দনেৎস্কের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কর্নেল ইগর স্ত্রেলকভ রুশ দৈনিক পত্রিকা ‘মস্কোভস্কি কমসোমলেৎস’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে, ইউক্রেন যে দনবাসে তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করবে, সেটি ছিল নিশ্চিত একটি বিষয়, কারণ তারা একমাত্র দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই এই ড্রোনগুলো ক্রয় করেছে। তার মতে, দনেৎস্ক ও লুহানস্কের কার্যকরী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নেই এবং এজন্য প্রজাতন্ত্রগুলোর পক্ষে ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তদুপরি, স্ত্রেলকভ মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অনুমোদন ছাড়া এই আক্রমণ পরিচালনা করা ইউক্রেনের পক্ষে সম্ভব হতো না।
অন্যদিকে, রুশ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারক ‘ভিজিটিআরকে’র যুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিক আলেক্সান্দর স্লাদকভের বক্তব্য অনুযায়ী, তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ভূপাতিত করা সম্ভব। সম্প্রতি ইউক্রেন দনবাসে যে ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে, সেটিকে তাদের বিজয় হিসেবে আখ্যা দেয়া যায় না, কিন্তু এসবের ফলে দনবাসে রক্তক্ষয়ের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, স্লাদকভ বহুদিন যাবৎ দনবাসে চলমান যুদ্ধ সম্প্রচার করেছেন। তার মতে, ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণের পর দনেৎস্ক ও লুহানস্ক ইউক্রেনীয় আক্রমণ সহ্য করতে থাকবে, নাকি এই ‘ফোঁড়া কাটতে’ শুরু করবে (অর্থাৎ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালাবে), সেটিই প্রশ্নের বিষয়।
রুশ সামরিক সাংবাদিক ও লেখক ভিক্তর বারানেৎসের ভাষ্য অনুসারে, ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহার দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে না। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০২০ সালে সিরিয়ার ইদলিবে, লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে ও আজারবাইজানের নাগর্নো–কারাবাখে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন সামরিক সাফল্য অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো অপরাজেয় নয়। প্রাথমিকভাবে ইদলিবে তুর্কি ড্রোন আক্রমণে সিরীয়রা বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জান হারায়, কিন্তু এরপর রুশ–নির্মিত এয়ার ডিফেন্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের সাহায্যে তারা অন্তত ১২টি তুর্কি কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয় এবং তুরস্ক ও তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত মিলিট্যান্টরা ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ডে’র প্রাথমিক পর্যায়ে যে ভূখণ্ড দখল করেছিল, অপারেশনের শেষ পর্যায়ে তারা সেগুলো থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। অনুরূপভাবে, প্রাথমিকভাবে লিবিয়ায় তুর্কি ড্রোন আক্রমণে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’/’এলএনএ’র প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু একই সময়ে তারা রুশ–নির্মিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাহায্যে অন্তত ১৬টি তুর্কি কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয় এবং পশ্চিম লিবিয়ায় তুরস্ক ও তুর্কি–সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ডে’র আক্রমণাভিযান সফল হলেও মধ্য লিবিয়ায় তাদের আক্রমণাভিযান ব্যর্থ হয়।
২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে এবং উক্ত যুদ্ধে আজারবাইজানি বিজয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এসময় আর্মেনীয়রা (এবং আর্মেনিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যরা) রুশ–নির্মিত এয়ার ডিফেন্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের সাহায্যে অন্তত ১৫টি তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে তুর্কি–সমর্থিত আজারবাইজান বিজয়ী হয়, কিন্তু আর্মেনীয়–সমর্থিত আর্তসাখকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে আজারবাইজানিরা ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধের শেষে আজারবাইজান আর্তসাখে রুশ সৈন্য মোতায়েনের অনুমতি দেয়, যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ ‘প্রক্সি’র সামরিক পরাজয় কার্যত রুশ কূটনৈতিক বিজয়ে রূপ নেয়। অর্থাৎ, তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই কার্যকরী, কিন্তু একে ধ্বংস করা সম্ভব এবং এর ব্যবহারকারী স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধে বিজয়ী হবে, এরকম কোনো সম্ভাবনা নেই।
বারানেৎস উল্লেখ করেছেন, সুইডেনভিত্তিক ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে অন্তত ৪৭টি তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস হয়েছে। এমতাবস্থায় বারানেৎস ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ ড্রোনবহরকে ‘অপরাজেয়’ বিবেচনা করছেন না, এবং তার মতে, দনেৎস্ক ও লুহানস্কের পক্ষে ইউক্রেনীয় ড্রোন স্ট্রাইক প্রতিহত করা সক্ষম। ইতিপূর্বে দনেৎস্ক ও লুহানস্ক সৈন্যরা বিভিন্ন ধরনের ইউক্রেনীয় ড্রোন (যেগুলো প্রযুক্তিগতভাবে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ ড্রোনের চেয়ে অনুন্নত ছিল) ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে, এবং আধুনিক এয়ার ডিফেন্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এবং আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে তারা তুর্কি–নির্মিত ইউক্রেনীয় ড্রোনগুলোও ধ্বংস করতে পারবে।
ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতামত
দনেৎস্কের ওপর পরিচালিত ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণের প্রসঙ্গে পশ্চিমা সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত রুশ বিশ্লেষকদের মতামত থেকে বহুলাংশে ভিন্ন। রুশ বিশ্লেষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্যের ব্যাপারে সন্দিহান। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দনবাসের রুশ–সমর্থিত প্রজাতন্ত্রগুলোর কেবল যে ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য রয়েছে তা-ই নয়, দনবাসে চলমান যুদ্ধ বিস্তৃত হলে সেটির ফলে রাশিয়া লাভবান হবে এবং ইউক্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইউক্রেনীয় সামরিক বিশ্লেষক ও “ইউক্রেনিয়ান সেন্টার ফর গ্লোবাল স্টাডিজ ‘স্ট্র্যাটেজি টুয়েন্টি-ওয়ান'” থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সামরিক প্রকল্পসমূহের প্রধান পাভেল লাকিচুক ‘বিবিসি রাশান সার্ভিসে’র কাছে মন্তব্য করেছেন যে, ‘মিনস্ক প্রোটোকল’ বা ‘মিনস্ক ২’ চুক্তির কোথাও ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে ড্রোন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। তার মতে, দনেৎস্ক ও লুহানস্কের তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করার সামর্থ্য রয়েছে এবং সোভিয়েত–নির্মিত ‘জেডএসইউ–২৩–৪ শিলকা’ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা ও এর চেয়ে নিম্নস্তরের সিস্টেমের সাহায্যেও তুর্কি–নির্মিত ড্রোনগুলো ভূপাতিত করা সম্ভব। তিনি মনে করেন, রুশরা যদি ইউক্রেন কর্তৃক ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ ড্রোন ব্যবহারের কারণ দেখিয়ে দনবাসে বিস্তৃত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম স্থাপনের কথা বলে, সেটি হবে ‘মিথ্যে’ কথা, কারণ দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ইতোমধ্যেই তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করার সামর্থ্য রয়েছে।
জার্মান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘সায়েন্স অ্যান্ড পলিটিক্স ফাউন্ডেশনে’র সামরিক বিশ্লেষক কর্নেল ভল্ফগ্যাং রিখটারের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে ড্রোনের ব্যবহার দনবাস সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর লঙ্ঘন এবং এটি অঞ্চলটির পরিস্থিতিতে অবনতি ঘটাতে পারে, কারণ ইউক্রেনের প্রতিপক্ষ সামরিকভাবে এর জবাব দিতে পারে। রিখটারের মতে, বহিঃশক্তিগুলোর উচিত দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিরত থাকা, কারণ এক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহ ‘নিবারক’ (deterrent) হিসেবে ভূমিকা পালনের পরিবর্তে যুদ্ধকে আরো উস্কে দেয়।
ব্রিটিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘চ্যাথাম হাউজে’র সামরিক বিশ্লেষক ম্যাথিউ বুলেগের ভাষ্যমতে, দনবাসে ইউক্রেন কর্তৃক কমব্যাট ড্রোন ব্যবহারের ফলে দনবাসে বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু উক্ত ড্রোনগুলো দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে চাপে রাখার জন্য পরিচালিত ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর বিচ্ছিন্ন অভিযানগুলোতে সহায়তা করবে। তিনি যোগ করেছেন, রাশিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে চাপে রাখার জন্য ইউক্রেনের এই কৌশল যথেষ্ট নয়, কিন্তু ইউক্রেনের সীমিত আর্থিক ও অন্যান্য সামর্থ্যের প্রেক্ষাপটে তাদের পক্ষে এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ‘নিবারক’ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের কাছে থাকা ড্রোনের সংখ্যা খুবই সীমিত, এবং ইউক্রেন কর্তৃক দনবাসে কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহার মূলত তাদের রুশবিরোধী প্রচারণা যুদ্ধের একটি অংশ।
বুলেগ এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে, ইউক্রেন সাম্প্রতিক আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজান কর্তৃক তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন ব্যবহারের অনুকরণ করতে আগ্রহী এবং ভবিষ্যতে দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা তুর্কি–নির্মিত ড্রোনবহর ব্যবহার করবে। কিন্তু বুলেগের মতে, আজারবাইজান উক্ত যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের বিরুদ্ধে তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ব্যবহার করে যেরকম সাফল্য পেয়েছে, ইউক্রেন সেরকম সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে প্রতীয়মান হয় না। তার ধারণা, ইউক্রেন রাশিয়াকে মাত্রাতিরিক্ত উস্কানি দিয়ে শক্তিশালী রুশ প্রত্যুত্তর পেতে বা আরো ভূখণ্ড হারাতে ইচ্ছুক নয়।
ইউরোপীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে’র বিশ্লেষক গুস্টাভ গ্রেসেলের ভাষ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে দনবাস সংঘাত নিরসন সম্পর্কিত কূটনৈতিক কাঠামো ‘ত্রিপক্ষীয় সংযোগ গ্রুপ’ কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে যুধ্যমান পক্ষগুলো কর্তৃক ড্রোনসহ কোনো ধরনের আকাশযান ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং সেই হিসেবে দনবাসে পরিচালিত ইউক্রেনীয় ড্রোন স্ট্রাইক উক্ত চুক্তির লঙ্ঘন। দনেৎস্ক ও লুহানস্কের সশস্ত্রবাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে তারা ইউক্রেনীয় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের কাছে তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন থাকলেও দনবাসে রুশ প্রতি–আক্রমণের ক্ষেত্রে ইউক্রেন খুবই দুর্বল অবস্থানে পতিত হবে।
সামগ্রিকভাবে, রুশ ও পশ্চিমা সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দনবাসে ইউক্রেন কর্তৃক তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহারকে বহুলাংশে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছেন এবং এর চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে ভিন্ন উপসংহারে পৌঁছেছেন।