আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি এবং ককেশাসের ভূরাজনীতি || পর্ব–২

[প্রথম পর্বের পর]

বিশ্লেষকদের ধারণানুযায়ী, তুরস্ক আজারবাইজানের পাঁচটি অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। এই অঞ্চলগুলো হচ্ছে গাবালা, গাঞ্জা, লাঙ্কারান, নাখচিভান এবং আবশেরন উপদ্বীপ। আজারবাইজানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারলে এতদঞ্চলে তুরস্কের সামরিক ও ভূকৌশলগত সামর্থ্য বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং ককেশাস অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে।

তুরস্ক আজারবাইজানের যেসব অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গাবালা। গাবালায় একটি ‘দারিয়াল’ রাডার স্টেশন অবস্থিত এবং এটি প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমণ সতর্কতা ব্যবস্থা’র একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এর মাধ্যমে সোভিয়েতরা তাদের দক্ষিণ সীমান্তে ন্যাটোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করত এবং এটি দিয়ে ইরান ও ইরাক থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগরের জলসীমা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা যেত। ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়া এই ঘাঁটিটি পরিচালনা করত, কিন্তু এরপর তারা ঘাঁটিটি ত্যাগ করে এবং যাওয়ার সময় ঘাঁটিটির সমস্ত উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম সঙ্গে করে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ঘাঁটিটির ভূকৌশলগত গুরুত্বের কারণে ২০০০–এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ঘাঁটিটি অর্জনের চেষ্টা করেছিল।

তুরস্ক যদি গাবালায় ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ পায়, সেক্ষেত্রে সেখানকার রাডার স্টেশন ব্যবহার করে তারা ইরান থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তো বটেই, উত্তর দিকে অবস্থিত রাশিয়ার ওপরেও নজরদারি করতে পারবে। এই স্টেশনের মাধ্যমে রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলের চেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর ওপরেও নজরদারি করা সম্ভব। একই সঙ্গে এই স্টেশনের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগরীয় ও কাস্পিয়ান অঞ্চলে রুশদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করাও তুর্কিদের পক্ষে সম্ভব হবে।

অনুরূপভাবে, সোভিয়েত আমলে গাঞ্জায় একটি বৃহৎ বিমানঘাঁটি ছিল। একে ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধ চলাকালে ব্যবহৃত তুর্কি ড্রোনগুলোর নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আর্মেনীয়রা একে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকবার ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তুরস্ক এই বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে, এরকম সম্ভাবনার কথা বহু আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এই ঘাঁটি অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

একটি যৌথ মহড়ার সময় আজারবাইজানের গাঞ্জা বিমানঘাঁটিতে তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা; Source: Tony via Twitter

অন্যদিকে, লাঙ্কারানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলে ইরানের বিরুদ্ধে তুর্কিদের অবস্থান শক্তিশালী হবে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনমাফিক ইরানে আক্রমণ চালানো তাদের জন্য সহজতর হবে। এই অঞ্চলে ড্রোন ঘাঁটি ও রাডার স্টেশন স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইরান ও কাস্পিয়ান অঞ্চলে তুর্কি প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধ চলাকালে ইরানি আজারবাইজানের জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং যুদ্ধের পর বাকুতে অনুষ্ঠিত প্যারেডে এরদোয়ান এমন একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন, যেটিতে দুই আজারবাইজানের একত্রীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, আঙ্কারা অন্তত পরোক্ষভাবে ইরানি আজারবাইজানকে নিজেদের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।

আজারবাইজানের ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’ দেশটির মূল মূখণ্ড থেকে স্থলপথে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। আজারবাইজানি মূল ভূখণ্ড ও নাখচিভানের মধ্যে আর্মেনিয়ার সিউনিক প্রদেশ অবস্থিত এবং আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে আজারবাইজানিরা নাখচিভানে যাতায়াত করতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে নাখচিভানের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে অঞ্চলটিতে তুরস্কের প্রভাব এমনিতেই ব্যাপক। নাখচিভানে অবস্থিত আজারবাইজানি সামরিক ঘাঁটিগুলোকে তুরস্ক প্রচুর সহায়তা প্রদান করে থাকে। তুরস্ক দীর্ঘদিন যাবৎ নাখচিভানে নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চাচ্ছে, এই মর্মে প্রচারমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। বাকু যদি এই অঞ্চলে তুর্কিদের ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়, সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলটি ক্রমশ কার্যত তুরস্কের ‘আশ্রিত রাষ্ট্রে’ পরিণত হবে এবং এই অঞ্চলে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার মধ্য দিয়ে তুর্কিরা নিকটবর্তী ইরানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে পারবে।

সর্বশেষ, আবশেরন উপদ্বীপে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত এই উপদ্বীপটিতে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু অবস্থিত এবং অঞ্চলটি আজারবাইজানি হাইড্রোকার্বন সম্পদের অন্যতম প্রধান ধারক। এই অঞ্চলে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপন হাইড্রোকার্বন–সমৃদ্ধ অঞ্চলটিতে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি আজারবাইজানি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তুর্কিদের পরোক্ষ প্রভাব বৃদ্ধি করবে এবং কাস্পিয়ান সাগরের অপর তীরে তুর্কমেনিস্তান ও অন্যান্য বৃহত্তর তুর্কি রাষ্ট্রে তুর্কি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেবে।

অর্থাৎ, তুরস্ক যদি নিজেদের মর্জি মোতাবেক আজারবাইজানের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে, সেক্ষেত্রে ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক–রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এই ঘাঁটিগুলো পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে তুর্কি প্রভাব বিস্তারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত বিজয়সূচক প্যারেডে তুর্কি সৈন্যদল; Source: Public Defense via YouTube

স্বাভাবিকভাবেই, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন সম্পর্কে এরদোয়ানের মন্তব্য রুশ পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও ধরন সামগ্রিকভাবে দুই ধরনের রূপ নিয়েছে। রুশ পর্যবেক্ষকদের একাংশ আজারবাইজানে সম্ভাব্য তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনকে ‘অবশ্যম্ভাবী ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এটিকে রাশিয়ার স্বার্থের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে, রুশ পর্যবেক্ষকদের আরেক অংশ নিকট ভবিষ্যতে আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা সীমিত বলে বিবেচনা করছেন।

রুশ রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ মন্তব্য করেছেন, আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনাকে রাশিয়া ‘বিশেষ গুরুত্ব সহকারে’ পর্যবেক্ষণ করছে এবং এতদঞ্চলে রুশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রুশ আইনসভা ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র প্রতিরক্ষা কমিটির প্রথম উপসভাপতি আলেক্সান্দর শেরিনের ভাষ্যমতে, আজারবাইজানে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন কার্যত ন্যাটোতে আজারবাইজানের পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির ইঙ্গিত বহন করছে। তার মতে, ২০২০ সালে আজারবাইজান ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সক্রিয় সহায়তায় রুশ–নেতৃত্বাধীন জোট ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’র সদস্য আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তখন থেকেই আজারবাইজানকে কার্যত ‘ন্যাটোর সদস্য’ হিসেবে ধরে নেয়া চলে। দুমা প্রতিরক্ষা কমিটির উপসভাপতি ভিক্তর জাভার্জিনও এটিকে আজারবাইজানে ন্যাটোর সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ডক্টর অফ মিলিটারি সায়েন্সেস ও ‘অ্যাকাডেমি অফ জিওপলিটিক্যাল প্রব্লেমসে’র ভাইস–প্রেসিডেন্ট কনস্তান্তিন সিভকভ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকিস্বরূপ, কারণ এটি রাশিয়ার মুসলিম–অধ্যুষিত উত্তর ককেশাস অঞ্চলে নতুন করে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে পারে। তুরস্ক ইতোমধ্যে জর্জিয়ার বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত আদজারা অঞ্চলকে একটি ‘অর্থনৈতিক উপনিবেশে’ পরিণত করেছে এবং তুরস্ক ও ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে বর্তমান মতবিরোধ সত্ত্বেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যাটো তুরস্ককে সমর্থন করবে। সিভকভের মতে, আজারবাইজান রাশিয়ার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নয় এবং সেখানে আগে হোক আর পরে হোক, তুর্কি ঘাঁটি স্থাপিত হবেই। তার ভাষ্যমতে, এই অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের ‘বৃহত্তর তুরান’ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার অংশ এবং রাশিয়ার বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তুর্কি ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ অবশ্যম্ভাবী।

২০২১ সালের জুনে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর সামিটে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ এরদোয়ান এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেন; Source: Business Insider

‘আর্সেনাল অফ দ্য ফাদারল্যান্ড’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক আলেক্সেই লিওনকভের ভাষ্য অনুযায়ী, আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপিত হলে সেটি হবে কার্যত ন্যাটোর একটি ঘাঁটি এবং এটি রুশ নিরাপত্তাকে গুরুতরভাবে বিঘ্নিত করবে, কারণ এর ফলে দক্ষিণ দিক থেকে রাশিয়াকে লক্ষ্য করে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপের সময় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। এজন্য ইউক্রেনে ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপন রাশিয়ার জন্য যতটা মারাত্মক, আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনকে রাশিয়ার জন্য ততটাই মারাত্মক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। লিওনকভের মতে, সম্প্রতি রুশ নৌবাহিনী যে তাদের ঘাঁটি আস্ত্রাখান থেকে কাস্পিয়স্কে সরিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আজারবাইজানি ভূখণ্ডকে নিজেদের নজরদারির সীমানায় নিয়ে আসা এবং সেখানে স্থাপিত তুর্কি (বা ন্যাটো) ঘাঁটিকে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা। রুশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রাক্তন কর্নেল–জেনারেল লিওনিদ ইভাশভের মতে, আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের ফলে কার্যত কাস্পিয়ান অঞ্চল বরাবর ন্যাটোর একটি করিডোর প্রতিষ্ঠিত হবে।

অর্থাৎ, রুশ রাজনীতিবিদ ও সামরিক বিশ্লেষকদের একাংশ আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনকে রাশিয়ার দক্ষিণে ন্যাটোর সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং একে রাশিয়ার নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু অন্যান্য রুশ রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক এই ব্যাপারকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেছেন, তিনি কোনো ‘গুজব’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে আগ্রহী নন। ‘মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে’র ‘ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে’র অধ্যাপক নিকোলাই সিলায়েভের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, কারণ ইতিপূর্বে কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনকেও ন্যাটোর সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। তদুপরি, ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে আজারবাইজানি সরকার এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করে নি। অবশ্য আজারবাইজানে ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে তুরস্ক যদি রাশিয়ার প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করে, সেক্ষেত্রে রাশিয়া এর জবাব দিতে সক্ষম।

‘রাশান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসে’র ‘ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে’র সদস্য আমুর হাজিয়েভের ভাষ্যমতে, আজারবাইজানি পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ তুর্কিমুখী নয়, বরং বহুমুখী এবং এজন্য আজারবাইজান রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বিদ্যমান সম্পর্ককে নষ্ট করতে চাইবে না। তদুপরি, তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্ক জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে গঠিত। এজন্য ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে তুরস্ক যেমন ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, আজারবাইজানকে তারা সেভাবে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইবে না এবং এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানে নিজেদেরকে ‘ন্যাটোর প্রতিনিধি’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইবে না। রুশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ভালদাই ক্লাবে’র সদস্য স্তানিস্লাভ ৎকাচেঙ্কোর বক্তব্য অনুযায়ী, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যকার সম্পর্ক পূর্ণ মৈত্রীতে রূপ নেবে ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে আজারবাইজানে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তুরস্কের পাশাপাশি রাশিয়ার কার্যক্রমও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কার্যত রাশিয়া এই অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থে তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতাও করতে পারে।

আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত একটি উয়েফা ফুটবল ম্যাচে আজারবাইজানি ফুটবলপ্রেমীরা তুর্কি জাতীয় ফুটবল দলের সমর্থনে তুর্কি পতাকা প্রদর্শন করছে; Source: Getty Images

‘ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে’র ‘সেন্টার ফর পোস্ট–সোভিয়েত স্টাডিজে’র সিনিয়র গবেষক স্তানিস্লাভ প্রিৎচিনের ভাষ্যমতে, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা সীমিত, কারণ ইতোমধ্যে আজারবাইজান আর্তসাখের অধিকাংশ ভূখণ্ড পুনর্দখল করে নিয়েছে এবং বিগত যুদ্ধে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, আর্মেনিয়ার ওপর আজারবাইজানের সামরিক আধিপত্য পরিপূর্ণ। এজন্য আজারবাইজানি সরকার নিজেদের ভূখণ্ডে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনকে নিজেদের জন্য ‘আবশ্যক’ হিসেবে বিবেচনা করবে না।

রুশ রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতো আজারবাইজানিদেরকেও এই ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত মনে হচ্ছে। যেমন: আজারবাইজানি আইনসভা ‘মিল্লি মজলিসে’র সদস্য রাসিম মুসাবায়ভের ভাষ্য অনুযায়ী, আর্মেনিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষার জন্য আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন জরুরি। অন্যদিকে, আজারবাইজানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ‘বাকু ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মাল্টিকালচারালিজমে’র সদস্য তোফিগ আব্বাসভের বক্তব্য অনুযায়ী, আর্মেনিয়া বা অন্য যেকোনো বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আজারবাইজানের যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে এবং এজন্য আজারবাইজানের ভূখণ্ডে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন নিষ্প্রয়োজন।

শুধু তা-ই নয়, আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনাকে ইরানও নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে। ধারণা করা হয়, ইরানের ওপর নজরদারি করার জন্য ইসরায়েল আজারবাইজানি ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে থাকে, যদিও আজারবাইজানি সরকার এই বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এই পরিস্থিতিতে যদি আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়, সেটিকে ইরানিরা নিজেদের জন্য নতুন একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করবে এবং এর ফলে ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কে নতুন করে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে।

উল্লেখ্য, এরদোয়ানের ঘাঁটি সংক্রান্ত মন্তব্যের পর আজারবাইজানি সরকার এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। শুধু তা-ই নয়, ‘শুশা মৈত্রী ঘোষণা’য় আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপন সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এর থেকে বিশ্লেষকরা আন্দাজ করছেন যে, সাম্প্রতিক সফরের সময় এরদোয়ান আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন, কিন্তু আলিয়েভ এই বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেননি।

আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন; Source: Vestnik Kavkaza

এটাও বিবেচ্য যে, রাশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে বিস্তৃত সামরিক–অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। আলিয়েভ প্রাক্তন সোভিয়েত উপপ্রধানমন্ত্রী ও কেজিবি কর্মকর্তা হায়দার আলিয়েভের ছেলে এবং তিনি মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে পড়াশোনা করেছেন। আজারবাইজানি অভিজাতশ্রেণি সাংস্কৃতিকভাবে রুশমুখী এবং ধর্মনিরপেক্ষ, অন্যদিকে তুরস্কে এরদোয়ান একধরনের ইসলামি জাতীয়তাবাদী ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়েছেন। অবশ্য আজারবাইজানি বিরোধী দলসমূহ ও জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তুরস্কের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতী, কিন্তু আলিয়েভ ও তার সহযোগীরা পুরোপুরিভাবে তুর্কিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে আগ্রহী নন। তাছাড়া, রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে আলিয়েভের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই উষ্ণ।

তদুপরি, ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেটি রুশ–আজারবাইজানি সম্পর্কের একটি অপ্রকাশিত দিক উন্মোচিত করেছে। যুদ্ধের পর ‘কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটসে’র (সিআইএস) রাষ্ট্রপ্রধানদের এক বৈঠকে আলিয়েভ যুদ্ধ চলাকালে পুতিনের ভূমিকা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভের আজারবাইজান সফরকালে আজারবাইজানি প্রধানমন্ত্রী আলী আসাদভ যুদ্ধে রাশিয়ার ‘ইতিবাচক’ ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।

সম্প্রতি এই মর্মে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে, আর্মেনিয়া যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের বিরুদ্ধে রুশদের সরবরাহকৃত ‘ইস্কান্দার–এম’ ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এছাড়া, আর্তসাখের রাষ্ট্রপতি আরায়িক হারুতিউনিয়ান রাশিয়া সফর করেছেন এবং আর্তসাখে রুশ সৈন্যরা রাশিয়ার বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয়সূচক প্যারেডের আয়োজন করেছে। এর প্রতিটি ঘটনার ফলে আজারবাইজানি জনমত রাশিয়ার বিরুদ্ধে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও ক্ষিপ্ত হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর ফলে রুশ–আজারবাইজানি সম্পর্কে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। এর মধ্য দিয়ে মস্কো ও বাকুর মধ্যে অপ্রকাশিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই আভাস পাওয়া যায়।

২০২১ সালের এপ্রিলে রুশ বিজয় দিবসের আগে আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যরা একটি প্রস্তুতিমূলক প্যারেডে অংশ নিচ্ছে; Source: JAM News

সর্বোপরি, সম্প্রতি আর্মেনিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সের্ঝ সার্গসিয়ান আর্মেনীয় প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছেন, যেটিতে পাশিনিয়ান ২০১৮ সালের একটি সিআইএস সম্মেলনের বিবরণ দিয়েছেন। এই সম্মেলনে রাশিয়া, বেলারুশ ও কাজাখস্তান নাগর্নো–কারাবাখের আশেপাশের ৭টি জেলা আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আর্মেনিয়াকে চাপ দিয়েছিল, কিন্তু পাশিনিয়ান এই প্রস্তাবে রাজি হননি। পরবর্তীতে ২০২০ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে আজারবাইজান এই অঞ্চলগুলো অধিকার করে নেয় এবং রাশিয়া আর্মেনিয়ার মিত্র হওয়া সত্ত্বেও এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। এর ভিত্তিতে আজারবাইজানি বিরোধী দলগুলো ধারণা করছে, এই যুদ্ধ ছিল সিআইএস রাষ্ট্রগুলো ও আজারবাইজানের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত, এবং যদিও আজারবাইজান তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, যুদ্ধটির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রাশিয়া।

এমতাবস্থায় যুদ্ধের ফলে আলিয়েভ ও পুতিন উভয়েই লাভবান হয়েছেন। আর্তসাখের অধিকৃত সিংহভাগ ভূমি পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে আলিয়েভ আজারবাইজানের জন্য একটি ‘বিরাট বিজয়’ অর্জন করেছেন এবং আজারবাইজানি জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমাপন্থী পাশিনিয়ানের নেতৃত্বাধীন আর্মেনিয়ার ওপর রুশ প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আজারবাইজানি ভূখণ্ডে রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ, রুশ ও আজারবাইজানি সরকার নিজেদের মধ্যে একধরনের গোপন সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং এজন্য আজারবাইজানে তুরস্ককে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দিয়ে বাকু এই সম্পর্ক ধ্বংস করতে চাইবে বলে প্রতীয়মান হয় না।

অবশ্য রুশ সামরিক বিশ্লেষক আলেক্সেই ভালিউঝেনিচের মতে, আজারবাইজান একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়কেই সন্তুষ্ট রাখতে পারে। আজারবাইজানি ভূখণ্ডে সরাসরি তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়ার পরিবর্তে তারা আজারবাইজানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে তুর্কিদের সীমিত বা আংশিক বিস্তৃত প্রবেশাধিকার দিতে পারে। এর ফলে একদিকে আজারবাইজানে তুর্কি প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে না কিন্তু তুর্কিদের পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়িত হবে, অন্যদিকে রাশিয়া ও ইরান এই বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন থেকে বিরত থাকবে।

সামগ্রিকভাবে, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা ককেশাস অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে একটি নতুন সমীকরণ সংযোজিত করেছে এবং এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সুতরাং নিকট ভবিষ্যতে যে এই অঞ্চলে রুশ ও তুর্কি (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইরানি) হস্তক্ষেপ ব্যাপকভাবে বর্ধিত হবে, সেটি প্রায় নিশ্চিত।

Related Articles

Exit mobile version