সুমেরু অঞ্চল; বরফ-স্নিগ্ধ হিমশীতল প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা এস্কিমো জনগোষ্ঠীর এক রহস্যময় জনপদ। জমাটবদ্ধ জলরাশি, কনকনে ঠাণ্ডা পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়ার এমন রোমাঞ্চকর স্থান পৃথিবীর রহস্যময়তাকে যেন আরও বাড়িয়ে তোলে। কল্পকাহিনীর গল্পকেও হার মানায় এখানে বসবাসরত বাসিন্দাদের জীবনধারা।
জনপদের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা রহস্য, প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম, টিকে থাকার লড়াই ও বেঁচে থাকার এক অমোঘ যুদ্ধে লিপ্ত এস্কিমোরা। এভাবেই শতবছর ধরে তারা রচনা করছে নিজেদের বিচিত্র জীবনগাঁথা। গড়ে তুলেছে বৈচিত্র্যময় জনপদ ও অদম্য সাহসী বংশপরম্পরা। আজকের এ লেখায় চলুন জেনে আসা যাক বৈরী পরিবেশের বৈচিত্র্যময় এস্কিমোদেরই রোমাঞ্চকর সাত জীবনাচারের কাহিনী।
১. কুকুরটানা গাড়ি
নর্থ আলাস্কা, কানাডা ও সাইবেরিয়ার বৈরী পরিবেশে উন্নত যাতায়াতব্যবস্থা কল্পনা করাও কঠিন। যেখানে টিকে থাকাই এক জীবন্ত রহস্য, সেখানে যাতায়াতের জন্য পিচঢালা সড়কপথ যেন এক বিমূর্ত কল্পনা। তবে প্রয়োজনের তাগিদে, খাদ্যের খোঁজে কিংবা বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে পাড়ি জমানোর প্রয়োজন পড়েছে এস্কিমোদের। তারই সুবাদে একসময় তারা গড়ে তুলেছে নিজস্ব যাতায়াতব্যবস্থা। শৈল্পিক এ মানুষগুলোর বিচিত্র মেধায় সৃষ্টি করেছে এক অনন্য বাহন কুকুরের গাড়ি!
এসব বাহনে একত্রে জুড়ে দেওয়া হয় গোটাদশেক কুকুর। মনিবের প্রতি এসব কুকুরের অপরিসীম বিশ্বাস বিরূপ পরিস্থিতিতেও নিরাপদ দিগন্তের পানে অভিগমনের সাহস যোগায়। এস্কিমো ভাষায় এসব কুকুরের গাড়িকে বলা হয় কামুতিক। জমাটবাঁধা পিচ্ছিল বরফের উপর দিয়ে খুবই দ্রুতবেগে চলতে পারে এ গাড়ি। এছাড়াও স্বল্পপাল্লার যাতায়াতে কায়াক নামক ছোট ছোট নৌকাও ব্যবহার করে তারা।
২. বরফের তৈরি ইগলু ঘর
মেরু অঞ্চলে সূর্যালোকের অভাবে গাছপালার অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। যেগুলো আছে সেগুলোও কেবল ব্যবহৃত হয় রান্নাবান্না ও অন্যান্য জ্বালানি কাজে। আর তাই গাছশূন্য সে স্থানে গাছ কেটে গৃহনির্মাণ যেন বিলাসিতা। তবে, এরূপ পরিস্থিতিতেও এস্কিমোরা দেখিয়েছে চমকপ্রদ সৃজনশীলতা। অবারিত বরফের রাজ্যে নান্দনিক পদ্ধতিতে তারা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের বাসস্থান বরফের ইগলু ঘর!
বিশালাকার বরফের মজবুত খন্ডাংশ সংগ্রহ করে তৈরি করা হয় এ ঘর। জীবনধারণের জন্য এসব ঘরের উচ্চতা হয় সর্বোচ্চ ৫-৬ ফুট। তবে, কিছু কিছু ঘরের উচ্চতা হয় এর চেয়েও কম। ফলে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় সেসবে। দেখে মনে হয় যেন সাদা বিরানভূমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট বরফের গুহা। অবশ্য শীতের শেষে গ্রীষ্ম এলে এসব ঘর গলে যায়, মিশে যায় বরফের নদীর অববাহিকায়। এসময় এস্কিমোরা খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করে। এসব তাঁবুর ছাদ তৈরিতে তারা ব্যবহার করে চামড়া আর দেয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয় পশুর হাড় ও তিমি মাছের বিশালাকার কাঁটা। রাতের বেলা এসব ঘরে সিল মাছের চর্বি দিয়ে জ্বালানো হয় উষ্ণ তেলের প্রদীপ।
৩. বসতির নিচে সমুদ্রতল
উত্তর মেরু যেন এক বরফের শুভ্র নির্মল চাদর। এ চাদরের নিচে বইছে শান্ত-স্নিগ্ধ সমুদ্র। যেন সাগরের বুকে ভাসমান জনপদ। সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বিচিত্র সব প্রাণীর বসবাস। রয়েছে সুস্বাদু সব মাছ ও নাম না জানা রূপসী সব উদ্ভিদের সমাহার। সাগরতলে তাদের ভাসমান দৃশ্যপট এক চোখধাঁধানো অপরূপ সৌন্দর্যের আধার৷
বরফের এমন সুবিশার আবরণের শেষ নেই। তবে, মাঝে মাঝেই একচিলতে খালি জায়গায় দেখা মিলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি আইসবার্গ। গ্রীষ্মকালে হিমশীতল জলের অল্প স্রোতে তারা ভেসে বেড়ায় বিভিন্ন স্থানে।এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়ায় আর্কটিক জুড়ে। বরফগুলোর ধূসর সাদা গাত্রবর্ণ চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও বরফের নিচে থাকা সমুদ্রের জলও বেশ বিশুদ্ধ। তবে, অতিরিক্ত লবণাক্ততা জলের স্বাভাবিক ব্যবহারে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আর তাই খাবার জল উনুনে ফুটিয়ে রাখতে হয় আগেভাগেই।
৪. শূন্য ডিগ্রি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
এ অঞ্চলে সাধারণ দুটি ঋতু বিদ্যমান- শীত ও গ্রীষ্ম। তবে, দুই ঋতুর পরিচিতি থাকলেও গ্রীষ্মকালের স্থায়িত্ব হয় খুবই অল্প সময়। এসময় অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় কেবল শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। আর শীতের আগমন সঙ্গে করে নিয়ে আসে বিবর্ণ ঠাণ্ডা আধার। এসময় বফরের আবরণে ঢাকা পড়ে পুরো আর্কটিক অঞ্চল। সমস্ত অঞ্চল আচ্ছাদিত থাকে কনকনে শীতের আবরণে।
বরফে ঘেরা সমুদ্র, তাই জলীয়বাষ্পও নেই। আকাশে মেঘও জমে না, তাই বৃষ্টিও হয় না। ফলে আকাশ থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার। যেন সাদা মরুর উপরে একটুকরো স্বচ্ছ নীল আয়না। তবে, কিছু কিছু স্থানে মাঝে মাঝেই ঘটে তুষারপাতের ঘটনা। অবশ্য সম্প্রতি পরিবেশবিদরা শীত-গ্রীষ্ম ছাড়াও শরৎ ও বসন্ত ঋতুরও সন্ধান পেয়েছেন সেখানে। তবে তাদের সময় খুবই সংক্ষিপ্ত।
৫. রোমাঞ্চকর শিকার অভিযান
সংগ্রামী মানুষদের জীবন্ত উদাহরণ এই এস্কিমোরা। বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকা তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আর তাই এমন পরিবেশে খাদ্য সংগ্রহ ও ধূর্ত পশু শিকার মোটেই সহজ কথা নয়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাদের সঙ্গে অভিযোজন করে টিকে থাকা পশুদেরই শিকার করে তারা। ক্ষুধা মেটায় পশুর মাংসের সুস্বাদু ভোজনে। এসব পশুর মধ্যে রয়েছে বল্গা হরিণ, বন্য খরগোশ, মেরু ভাল্লুক, উড়ন্ত হাঁস, শিকারি পাখি ও পেঙ্গুইন। মাছের মধ্যে সিল ও তিমি মাছও বেশ পছন্দের আহার তাদের।
এসব প্রাণী শিকারে ব্যবহৃত হয় পূর্বে শিকার করা প্রাণীদেরই হিংস্র দাঁত ও সূচালো হাড় দিয়ে তৈরি করা বিশেষ ধরনের বর্শা। গ্রীষ্মকালের উষ্ণ মৌসুমে পরিচালিত হয় এসব শিকারের বেশিরভাগ অভিযান। এসময় সংগৃহীত মাংস ও অন্যান্য খাবারের একটা নির্দিষ্ট অংশ শীতকালের জন্য তোলে রাখে তারা। নিম্ন তাপমাত্রার সুবিধার্তে এসব কাঁচা খাবারও অনায়াসে টিকে থাকে দিনের পর দিন।
৬. পশুর চামড়ার গাত্রাবরণ
শিকারকৃত পশুর চামড়া দিয়ে এস্কিমোরা তৈরি করে একপ্রকার উষ্ণ পোশাক। এসব পোশাক তৈরিতে তারা ব্যবহার করে মেরু ভাল্লুক, বল্গা হরিণ ও শিয়ালসহ অন্যান্য প্রাণীর মোটা চামড়া। তৈরিকৃত এসব পোশাকের নাম ক্যারিবো ফারস। জবুথবু ঠাণ্ডায় একমাত্র এই পোশাকই সুরক্ষা প্রদান করে তাদের।
শিকারকৃত পশুর চামড়াকে শরীর থেকে আলাদা করার পর কিছুদিনের জন্য বরফের পাতলা আবরণের নিচে রেখে দেওয়া হয়। অতঃপর, শুরু হয় পোশাক তৈরির অনন্য প্রক্রিয়া। প্রথমেই চামড়ায় লেপ্টে থাকা মাংসসমূহ ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেয় তারা। ঠাণ্ডা পানিতে ধৌত করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকাতে দেওয়া হয়। এভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা এসব চামড়া। চামড়া দিয়ে তৈরি হওয়া এসব পোশাকও টেকসই হয় বছরের পর বছর। তাই একজন এস্কিমোর খুব বেশি কাপড়ের প্রয়োজন পড়ে না।
৭. ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত
পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে অবস্থান করছে এই আর্কটিক অঞ্চল। তাই প্রকৃতির খেয়ালিপনায় সেখানে সূর্য যেন অমাবস্যার চাঁদ! ফলস্বরূপ, থাকে ছয় মাস দিন, বাকি ছয় মাস রাত। অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে যদি একটানা রাত থাকে, তখন দক্ষিণ গোলার্ধে একটানা দিন। একটানা এই রাতকে বলা হয় পোলার নাইট বা মেরু রাত্রি। যার জন্য বছরে কেবল একবারই পুরোপুরি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায় সেখানে।
গ্রীষ্মকালের স্থায়িত্ব হয় টানা ১৮৭ দিন, এ সময় সূর্যের কিরণ সার্বক্ষণিক আকাশে মিলে বলে এসময়কে একটানা দিন বলা হয়। গ্রীষ্মের পর আসে শীতকাল, যার স্থায়িত্ব হয় অবশিষ্ট ১৭৮ দিন। এসময় আকাশে সূর্যের দেখা মেলে না বলে এসময়কে বলা হয় একটানা রাত।