বছরের পর বছর ধরে শীতল সম্পর্ক থাকার পর ২০১৫ সালের দিকে আমেরিকা ও প্রতিবেশী দেশ কিউবার কূটনৈতিক সম্পর্কের কিছুটা উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরের জন্য এক অদ্ভুত ও রহস্যময় কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আবার শীতল হয়ে পড়ে, মার্কিনিরা কিউবার রাজধানী হাভানা থেকে দূতাবাস থেকে সরে আসতে শুরু করে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কথা। কিছু বিশেষজ্ঞ বলতে শুরু করেছিলেন, কিউবার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একটি অংশ মার্কিন-কিউবান সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে ছিলেন না কখনোই। তাই যখন আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়ে গেল কিউবার, তখন এই নেতৃবৃন্দ এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন, যাতে করে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে যায়। ধারণা করা হয়, মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ নিক্ষেপ করা হয়েছিল কিউবার গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে, যেটা থেকে ‘হাভানা সিনড্রোম’ তৈরি হয়েছিল। তবে মূল কথা হচ্ছে, যথাযথ প্রমাণ না থাকায় এই ধরনের বক্তব্য পরবর্তীতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
সম্প্রতি আমেরিকার কূটনৈতিক পরিমন্ডলে ‘হাভানা সিনড্রোম’ এক অজানা আতঙ্কের নাম। এই সিনড্রোম হানা দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসগুলোতে। ২০১৬ সালে এই সিনড্রোমের উপস্থিতি আবিষ্কার করার পর থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক কেইস পাওয়া গিয়েছে, যেখানে মার্কিন কূটনীতিক ও অসংখ্য গোয়েন্দা কর্মকর্তা ‘অজানা’ কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হয়ে পড়া অনেকের ভাষ্যে জানা গিয়েছে, তারা হঠাৎ করে মাথার ভেতর ‘হাতুড়ি দিয়ে ধাতব জিনিসে জোরে আঘাত করা’র মতো কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেতেন, অনেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা অনুভব করতেন, অনেকের আবার বমি বমি ভাব তৈরি হতো। একজন মার্কিন নারী কর্মকর্তা, যিনি এই হাভানা সিনড্রোমের শিকার হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন- এই সিনড্রোমের সময় তার মাথার খুলিতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হতো। শত শত কর্মকর্তা ও কূটনীতিক তাদের কর্মক্ষেত্রে থেকে চলে এসেছেন নিজেদের শরীরের কথা ভেবে। ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর করেছে এই ‘হাভানা সিনড্রোম’।
আমেরিকার চিকিৎসক, বিজ্ঞানী কিংবা বাইরের দেশে বিভিন্ন মিশনের জন্য বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কিন্তু এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে, অনেকে বলছেন স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার জন্য সবচেয়ে বড় ‘চ্যালেঞ্জ’ হাভানা সিনড্রোমের রহস্য উদঘাটন করা। সাম্প্রতিক সময়ে কিউবার রাজধানী হাভানা এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার হাভানা সিনড্রোমের প্রায় চব্বিশটি কেইসের তদন্ত করা হয়েছে সিআইএ-র পক্ষ থেকে। তবে তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব স্বাক্ষ্য-প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আমেরিকার বড় বড় শত্রুদেশ, যেমন- রাশিয়া কিংবা চীনের হাত নেই এসবের পেছনে। সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম জে. বার্নস এই তদন্তের অগ্রগতি ও হাভানা সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতা সম্পর্কে বলেছেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (রাশিয়া ও চীনের সংযুক্তি না থাকা) পেয়েছি। কিন্তু আমাদের তদন্ত কার্যক্রম এখানেই শেষ নয়। এই ঘটনাগুলোর কারণ উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত এগিয়ে যাবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের যাদের প্রয়োজন হবে, বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হবে।”
একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুটি দেশই অত্যাধুনিক আবিষ্কারের জন্য বিশাল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্রকল্পে। স্বয়ং আমেরিকা এমন কিছু গোপন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, যে প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল হাজার হাজার মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের মতো অস্ত্র আবিষ্কার করা। আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ‘এলএসডি’ নামের একটি মাদক। এই মাদক তৈরি হয়েছিল আমেরিকার সেই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণকারী অস্ত্রের উদ্ভাবনের প্রকল্পেই। এমনকি এই ধরনের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে যে, এলএসডির কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য আমেরিকার বিজ্ঞানীরা তাদেরই এক সহকর্মীর উপর এলএসডি প্রয়োগ করেছিলেন, যিনি পরবর্তীতে এই ভয়ংকর মাদকের জন্য নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে এই বিজ্ঞানী নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলের নয় তলার রুমের জানালা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে মতামত দিয়েছেন, বাইরে থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে যদি মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ প্রেরণ করা যায়, তাহলে মাথার ভেতরে একধরনের শব্দ অনুভূত হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন রাডারের মাধ্যমে তরঙ্গ নিক্ষেপণ করা হতো, তখন রাডারের আশেপাশে অবস্থান করা ব্যক্তিরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তারা একধরনের অস্বস্তিকর শব্দ শুনতে পান। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস লিন এ ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ তৈরিকারী যন্ত্রের অ্যান্টেনা মাথার পেছনের দিকে স্থাপন করেন। এরপর তার একজন সহকর্মীকে নির্দেশ দেন, যেন একটু পর পর কয়েকবার মাইক্রোওয়েব তরঙ্গ প্রেরণ করা হয়। তার নির্দেশ অনুযায়ী মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ প্রেরণ করা হলে তিনি মাথার ভেতরে শব্দের অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন। তার মনে হচ্ছিল বাইরের কোনো উৎস থেকে নয়, বরং মাথার ভেতরেই শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। তার মতে, বাইরে থেকে প্রেরণ করা এসব তরঙ্গ সফট ব্রেইন টিস্যুগুলো শুষে নেয়, এরপর মস্তিষ্ক এসব তরঙ্গকে ‘শব্দ’ হিসেবে ধরে নেয়।
হাভানা সিনড্রোম কেন ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিদের জন্য ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করেছে, তা একটু জানা যাক। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কিংবা কূটনীতিকরা অনেক গোপন স্পর্শকাতর তথ্য মার্কিন নীতিনির্ধারকদের হাতে পৌঁছে দেন, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। স্পর্শকাতর তথ্য সন্ধানে প্রায় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রায়ই বিভিন্ন অভিযানে যেতে হয়। কখনও যদি এরকম হতে শুরু করে যে, অভিযানে যাওয়ার একপর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা গণহারে হাভানা সিনড্রোমে ভুগতে শুরু করেছেন, তখন এসব অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, এর পাশাপাশি ছদ্মবেশী গোয়েন্দাদের পরিচয় ফাঁস হয়ে পড়লে মার্কিন ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে। যেসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, সেগুলো তথ্যই যদি হাতে না আসে, তাহলে এটা বেশ শঙ্কার ব্যাপার। কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে এসব অসুস্থতা যদি খুব বেশি সমস্যা তৈরি করতে শুরু করে, তাহলে হয়তো একসময় মেধাবী মার্কিন তরুণেরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এখনও পর্যন্ত হাভানা সিনড্রোমের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ, যেমন: দীর্ঘকাল কাজ করার ক্লান্তি কিংবা অনেকদিন থেকে বিরূপ আবহাওয়ায় থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখানো হলেও এই সিনড্রোমের আক্রান্ত ব্যক্তিরা আরও অধিকতর তদন্ত-পরীক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেন। হাভানা সিনড্রোম এত ব্যাপক আকারে হানা দিচ্ছে যে, ২০১৬ সালের পর থেকে এক হাজারেরও বেশি কেইস পাওয়া গিয়েছে, যেখানে আক্রান্তদের হাভানা সিনড্রোমের লক্ষণগুলো পাওয়া গিয়েছে। ছয় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এই সিনড্রোমের পেছনে প্রকৃত কারণ আবিষ্কার করতে না পারা একপ্রকার ব্যর্থতাই বলা যায়।