পরিবেশ বিপর্যয় এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে সারা বিশ্বই আজ খুবই সচেতন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমরাই মূলত বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে, কারণে-অকারণে কিংবা সজ্ঞানে-অজ্ঞানে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলি। হয়তো রাস্তা দিয়ে চিপস খেতে খেতে যাওয়ার সময় চিপসের প্যাকেটটা রাস্তার উপর ফেলে আসি, কিংবা কোক-পেপসির বোতলটা ফেলে দেই নর্দমার মধ্যে।
হয়তো আমরা ভাবি যে, একটা চিপসের প্যাকেট বা পেপসির বোতলে কী-ই বা হবে? চিন্তা করুন, আমার আপনার মতো আরো অনেকেই কিন্তু এভাবে প্লাস্টিকের আবর্জনা ফেলছে এবং আমাদের মতোই চিন্তা-ভাবনা করছে। ফলে ফলাফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, এসব আবর্জনা এক এক করে একত্র হয়ে তৈরি করছে বিশাল এক আবর্জনার স্তূপ।
পলিথিন, প্লাস্টিক বা এমন অপচনশীল আবর্জনা এরপর নর্দমায় আটকে যাচ্ছে, তৈরি করছে কৃত্রিম বন্যার। যেমনটা বর্ষাকালে ঢাকা শহরে হয়ে থাকে। আবার যদি নর্দমায় না-ও আটকায়, এসব বর্জ্য এরপর চলে যাচ্ছে নদীতে কিংবা শেষপর্যন্ত সমুদ্রে। বর্তমানে নদী বা সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে একদিকে যেমন জলজ পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, নদী বা সমুদ্রের প্রাণীজগতের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে সেটি পরোক্ষভাবে মানুষের জন্যেও ক্ষতির কারণ।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাতেই প্লাস্টিক বর্জ্য-আবর্জনার বৃহৎ স্তূপের সন্ধান পাওয়া যায়। বলা যায় এটি একপ্রকার বিশ্বব্যাপী সমস্যা। কারণ সারা পৃথিবীতেই পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়ে থাকে কম-বেশি। এটি সবাই ব্যবহার করছে ঠিকই। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যবহারের পর এই প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে প্রতিদিন। অপচনশীল হওয়ায় তা আরো ক্ষতি করছে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। পরিবেশকে বাঁচাতে পলিথিন বা প্লাস্টিকের আবিষ্কার হলেও, সেটিই এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১.১৫ থেকে ২.৪১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী থেকে সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় অর্ধেকেরই ঘনত্ব পানির থেকে কম। এর মানে হচ্ছে, এসব কম ঘনত্বের প্লাস্টিক পানিতে ভেসে থাকবে, ডুবে যাবে না কখনো। তবে এই প্লাস্টিক বর্জ্যসমূহ সূর্যের উত্তাপ, সামুদ্রিক স্রোত এবং সামুদ্রিক নোনা পরিবেশের কারণে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়।
ভাসমান এসব প্লাস্টিকের মধ্যে শক্তিশালী প্লাস্টিকগুলো সামুদ্রিক পরিবেশে খুবই প্রতিরোধী। অর্থাৎ সামুদ্রিক পরিবেশ এদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। ফলে এরা সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে বা জোয়ারের কারণে ভাসতে ভাসতে একসময় উপকূলে এসে জমা হয়। যখন একবার এসব বর্জ্য উপকূলে এসে জমা হয়, এরা খুব সহজে আর উপকূল থেকে সরে যেতে পারে না। এভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য উপকূলে জমা হয়ে তৈরী করে একেকটি ‘প্যাচ’ (Patch) বা আবর্জনার আস্তাকুঁড়ের।
পৃথিবীতে এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের এরকম বড়সড় প্যাচ আছে ৫টি। এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্যাচ-টিকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারব্যাজ প্যাচ’ (The Great Pacific Garbage Patch)। একে ‘প্যাসিফিক ট্রাশ ভর্টেক্স’ (Pacific Trash Vortex)-ও বলা হয়ে থাকে। এই প্যাচের আয়তন প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার যা টেক্সাসের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ বা ফ্রান্সের আয়তনের তিনগুণ।
এই প্যাচের আয়তন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেলেও এর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা অতটা সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ হচ্ছে যে, জোয়ার-ভাটা, ঋতুভিত্তিক তারতম্য, কিংবা বাতাসের গতিবিধির পরিবর্তনের ফলে এর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। তবে বলা যায় যে, এটি হাওয়াই এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝামাঝি অবস্থিত।
উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে বৃত্তাকার অঞ্চল জুড়ে এর অবস্থান, যাকে বলা হয় ‘নর্থ প্যাসিফিক জায়ার’ (North Pacific Gyre)। জায়ার বলতে মূলত ঘূর্ণায়মান সামুদ্রিক স্রোত বা ঢেউকে বোঝায়। এই এলাকার ঘূর্ণায়মান অঞ্চল চারটি স্রোত এলাকা নিয়ে গঠিত; ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাহ, উত্তর নিরক্ষীয় প্রবাহ, কুরোশিও প্রবাহ এবং উত্তর প্যাসিফিক প্রবাহ।
ঋতুভিত্তিক প্রভাব বা ঢেউয়ের কারণে এই প্যাচ বৃত্তাকার পথে দক্ষিণ থেকে উত্তরে এবং বিপরীতক্রমে ভ্রমণ করে। ধারাবাহিক ঢেউয়ের কারণে মূলত এই বৃত্তাকার অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে এবং চারপাশের এই ঢেউয়ের কারণেই প্লাস্টিক বর্জ্য এখানে এসে জমা হচ্ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, মাছধরা জাল, কাপড়-চোপড়, লাইটার সহ আরো নানা প্রকার মনুষ্য সৃষ্ট ও ব্যবহৃত আবর্জনা।
এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এই প্যাচে কী পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য আছে এবং সেটা কতটা বিপদজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে এই প্যাচে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরা আছে যার আনুমানিক ওজন হতে পারে ৮০,০০০ টন। পূর্বের হিসাব-নিকাশ থেকে এই ওজন প্রায় ৪-১৬ গুণ। প্রায় ৫০০টি জাম্বো জেট-এর ওজন একত্রে ৮০,০০০ টন হতে পারে। তাহলে একবার ভাবুন কি পরিমাণ বর্জ্য ভাসছে এই প্যাচে।
তবে গবেষণার সময় কেবল এই প্যাচের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে স্যাম্পলিং করা হয়েছিলো। কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্লাস্টিকের ঘনত্ব বেশি এবং আস্তে আস্তে পরিধির দিকে সেটা কমতে শুরু করেছে। তো কেবল কেন্দ্র নিয়ে হিসাব করেই পাওয়া গেছে ৮০,০০০ টন। যদি পরিধির দিকের কম ঘনত্বের অঞ্চলও গণনায় আনা হয় তবে তা ১,০০,০০০ টন ছাড়িয়ে যাবে সন্দেহ নেই।
প্লাস্টিকের বর্জ্যের মধ্যে এই প্যাচ অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায় পলিইথিলিন, পলিপ্রোপিলিন এবং কিছু পরিমান নাইলনের তৈরি সামগ্রী। এসব প্লাস্টিক টুকরাকে আকারের দিক থেকে চারভাগে ভাগ করা যায়; মাইক্রোপ্লাস্টিক (০.০৫ – ০.৫ সে.মি.), মেসোপ্লাস্টিক (০.৫ – ৫ সে.মি.), ম্যাক্রোপ্লাস্টিক (৫ – ৫০ সে.মি.) এবং মেগাপ্লাস্টিক (৫০ সে.মি. এর বেশি)।
ওজনের ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় যে, এই প্যাচের প্রায় ৯২% প্লাস্টিক টুকরাই ০.৫ সে.মি. থেকে বড় এবং চারভাগের তিনভাগই ম্যাক্রো ও মেগাপ্লাস্টিক। আবার পানির উপরে এদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে হিসাব করলে দেখা যায় যে, প্রায় ৯৪%-ই হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই অঞ্চলকে গবেষকরা ‘প্লাস্টিকের স্যুপ’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।
আগেই বলা হয়েছে, সামুদ্রিক পরিবেশ এসব প্লাস্টিক পদার্থের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এবং এরা পচনশীলও নয়। তবে সূর্যের আলো ও উত্তাপে এবং সামদ্রিক নোনা পরিবেশের কারণে প্লাস্টিক পদার্থ ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আলোকবিশ্লেষণ’ (Photodegradation)। এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা অপসারণ করা সবচেয়ে বেশি দুরূহ। এসব কণার মধ্যে কিছু আবার পানির উপরে ভেসে থাকে, কিছু ভেসে থাকে পানির উপরিতল থেকে কয়েক সেন্টিমিটার নিচে এবং অল্প পরিমাণ চলে যায় একেবারে পানির নিচের তলে।
প্লাস্টিক স্থলজ পরিবেশে যেমন ক্ষতিকর, সামুদ্রিক পরিবেশে বেশি ছাড়া কম ক্ষতিকর নয়। সমুদ্রে ভাসমান বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা নানাভাবে জলজ পরিবেশ এবং জলজ প্রানীদের জন্যে ক্ষতির কারণ। এদের আকার এবং বর্ণের কারণে অধিকাংশ জলজ প্রাণী এদের খাদ্য হিসেবে বেছে নেয়ার মতো ভুল করে থাকে। আবার অনেক প্রাণী এসব আবর্জনার মধ্যে আটকে যায় কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৭০০ প্রজাতির জলজ প্রাণী সামুদ্রিক বর্জ্য দ্বারা আক্রান্ত হয় যাদের মধ্যে ৯২%-ই আক্রান্ত হয় প্লাস্টিকের কারণে। সমুদ্রের উপরিভাগে যেহেতু এই বর্জ্যের আধিক্য বেশি তাই উপরিভাগে চলাচল করা প্রাণিদের ক্ষেত্রে এটি সবথেকে বেশি ক্ষতিকর। যেমন, যেসব প্রাণী উপরিভাগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাংকটন ভক্ষণ করে, এরা খাবার গ্রহণের সময় ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণা খাবারের সাথে পেটে চলে যায়।
আবার কচ্ছপ উপরিভাগে ভেসে বেড়ায়। এরা প্রায়শই উপরিভাগে ভাসমান মাছধরা জাল, কিংবা দড়িতে আটকে যায়। কচ্ছপের প্রিয় খাদ্যের মধ্যে আছে সামদ্রিক জেলিফিশ। অনেক সময় এরা প্লাস্টিককে জেলিফিশ হিসেবে মনে করে খেয়ে ফেলে। আবার কেবল সামুদ্রিক জলজ প্রাণীই নয়, এই এলাকায় বসবাসকারী পাখিরাও এসব বর্জ্য দ্বারা আক্রান্ত হয়। আলবাট্রস নামক পাখি সমুদ্রে ভাসমান রেজিন কণাকে মাছের ডিম মনে করে এবং বাসায় নিয়ে যায় বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। এর ফলাফল হয় অনাহার কিংবা অঙ্গহানির কারণে বাচ্চাদের মৃত্যু।
প্লাস্টিকের কারণে সামদ্রিক পরিবেশে খাদ্যশৃঙ্খলেও আসে নানা পরিবর্তন। পানির উপরিভাগে প্লাস্টিকের আস্তরণের কারণে সূর্যের আলো পানির নিচে পৌঁছাতে পারে না। ফলে সূর্যের আলোর অভাবে প্লাংকটন এবং সামুদ্রিক শৈবাল জন্মাতে পারে না। এগুলো হচ্ছে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক। ফলে এদের অভাবে খাদ্যশৃঙ্খলে সমূহ পরিবর্তন আসতে পারে।
সামদ্রিক বর্জ্য কেবল সামদ্রিক পরিবেশেরই ক্ষতি করবে না। এর ফলাফল পড়বে মানুষের উপরেও। উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা এর বাইরেও মানুষ সামুদ্রিক মাছ ধরে থাকে এবং খেয়ে থাকে। সামুদ্রিক মাছের শরীরে ‘জৈবসঞ্চিতি’ (Bioaccumulation)-র কারণে প্লাস্টিকের কণা এবং এর থেকে তৈরি হওয়া রাসায়নিক পদার্থ জমা থাকে। মানুষ এদের খাবার হিসেবে গ্রহণের ফলে এসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে। এর প্রভাব অর্থনীতিতেও কম নয়। উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা দ্বীপ অঞ্চলে পর্যটকদের ভ্রমণ কমে যাবে যদি সেখানে প্লাস্টিকের বর্জ্য ভেসে বেড়ায় চারদিকে। আবার সামুদ্রিক মাছ শিকার করে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্থলজ পরিবেশই হোক আর সামুদ্রিক পরিবেশই হোক, প্লাস্টিক বর্জ্য সবসময় ক্ষতির কারণ আমাদের জন্য। প্লাস্টিকের ব্যবহার তাই যতটা সম্ভব কমানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া উচিত। আর যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে যত্রতত্র না ফেলে সঠিক স্থানে ফেলা উচিত। কেবল আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সচেতনতাই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সৃষ্ট সমস্যা থেকে আমাদের এবং পরিবেশকে বাঁচাতে পারবে।