চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত খুব কম সংখ্যক বাংলাদেশিই রুশ দার্শনিক, ভূরাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ আলেক্সান্দর দুগিন সম্পর্কে জানতেন। চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর কিছু কিছু বাংলাদেশি ফেসবুক গ্রুপে এরকম একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছিল যে, দুগিন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই যুদ্ধ শুরুর পশ্চাতে দুগিন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশিরা নিজেরা এই তত্ত্ব তৈরি করেনি। বিভিন্ন পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে এই ধরনের কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এবং কোনো বাংলাদেশি সেখান থেকে বিষয়টি জেনে এই তত্ত্বটি বাংলাদেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
গত ২০ আগস্ট রাশিয়ার মস্কো প্রদেশের বলশিয়ে ভিয়াজিয়োমিতে রুশ সাংবাদিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক কর্মী দারিয়া দুগিনা গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন, এবং এর মধ্য দিয়ে দুগিনের নাম পুনরায় বাংলাদেশি প্রচারমাধ্যমে চলে আসে। কারণ, দারিয়া দুগিনা ছিলেন আলেক্সান্দর দুগিনের মেয়ে।
পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের অনুকরণে বাংলাদেশি প্রচারমাধ্যম দুগিনকে ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’, ‘পুতিনের আধ্যাত্মিক গুরু’ এবং ‘পুতিনের রাসপুতিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু তাদের প্রদত্ত এই বিবরণ বাস্তবতার সঙ্গে ঠিক কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? এটি জেনে নেয়ার আগে দুগিনের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নেয়া যাক।
আলেক্সান্দর গেলায়েভিচ দুগিন ১৯৬২ সালের ৭ জানুয়ারি তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল গেলিই দুগিন ছিলেন সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’র একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। দুগিন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় আদর্শ কমিউনিজমের বিরোধী ছিলেন, এবং বিভিন্ন ডানপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুগিন মস্কো এভিয়েশন ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে দুগিন রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘ন্যাশনাল–প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট পামিয়াৎ’–এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৯০–এর দশকের প্রথমদিকে তিনি ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ দ্য রাশান ফেডারেশন’–এর রাজনৈতিক ইশতেহার রচনায় সহায়তা করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ‘ন্যাশনাল বলশেভিক পার্টি’ এবং ‘ইউরেশিয়া পার্টি’র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি মস্কোকেন্দ্রিক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউরেশিয়ান মুভমেন্ট’–এর নেতা পদে অধিষ্ঠিত, এবং বিশ্বের ২৯টি রাষ্ট্রে সংগঠনটির শাখা রয়েছে। রাজনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে দুগিন বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, প্রকাশনা সংস্থা, রেডিও প্রোগ্রাম, টেলিভিশন চ্যানেল এবং বেসরকারি সংগঠনে কাজ করেছেন।
দুগিন একজন দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ভূরাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তার লেখা কয়েক ডজন বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বইগুলো হচ্ছে ‘The Foundations of Geopolitics’, ‘The Fourth Political Theory’ এবং ‘Last War of the World-Island’। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম দুগিনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, কিন্তু দুগিন তার রাজনৈতিক মতাদর্শকে ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ (Fourth Political Theory) হিসেবে আখ্যায়িত করেন, এবং তিনি পুঁজিবাদভিত্তিক উদার গণতন্ত্র, কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদ তিনটি মতাদর্শকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দুগিন ইউরেশিয়ানিজমের সমর্থক, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে ইউরেশিয়ায় অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করার মাধ্যমে একটি ‘ইউরেশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের পক্ষপাতী।
দুগিন ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রুশ আইনসভার নিম্নকক্ষ ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র সভাপতি গেন্নাদি সেলেজনিয়োভের একজন উপদেষ্টা ছিলেন, এবং ২০১০–এর দশকে রাষ্ট্রীয় দুমার সভাপতি সের্গেই নারিশকিনের অধীনস্থ বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। এর বাইরে রুশ সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দুগিনের কোনো সংশ্রব ছিল না এবং এখনও নেই। দুগিন কখনোই রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম বহু আগে থেকেই দুগিনকে ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’, ‘পুতিনের আধ্যাত্মিক গুরু’, ‘পুতিনের রাসপুতিন’ প্রভৃতি বর্ণাঢ্য অভিধায় অভিষিক্ত করে আসছে। এরকমটা কেন ঘটলো?
এর মূল কারণ হচ্ছে, বর্তমানে খুব কম সংখ্যক রুশ দার্শনিক ও ভূরাজনৈতিক তাত্ত্বিক রাশিয়ার বাইরে পরিচিত। এক্ষেত্রে দুগিন ব্যতিক্রম, কারণ তিনি প্রচারমাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে নিজেকে রাশিয়ার বাইরে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছেন। দুগিন তুরস্ক, ইরান, সার্বিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র সফর করেছেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের পণ্ডিতদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, ফলে তিনি পরিচিতি অর্জন করেছেন। রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, ইরান, সার্বিয়া, জার্মানি প্রভৃতি নানাবিধ রাষ্ট্রে দুগিনের রাজনৈতিক মতাদর্শের বেশ কিছু অনুরাগী রয়েছে। দুগিনের ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও রাশিয়ার বাইরে তার প্রভাবের কারণে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম তাকেই ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বসেছে।
কিন্তু দুগিনের রাজনৈতিক অনুরাগীর সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে দুগিনের রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম যেরকম প্রচারণাই চালাক না কেন, পুতিনের ওপর দুগিনের কোনো সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
প্রথমত, পুতিন আর দুগিনের কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছে, এরকম কোনো প্রমাণ নেই। ইন্টারনেটে সার্চ করলে পুতিন আর দুগিনের একসঙ্গে কোনো ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। দুগিন সত্যিই পুতিনের রাজনৈতিক গুরু হলে এরকম হতো না।
দ্বিতীয়ত, পুতিন কখনো তার কোনো বক্তব্যে দুগিনের রাজনৈতিক আদর্শ ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বে’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি, এবং দুগিনের মতাদর্শের সঙ্গে পুতিনের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির আকাশ–পাতাল তফাৎ রয়েছে।
তৃতীয়ত, দুগিন ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমাজতত্ত্ব’ বিভাগের প্রধান ছিলেন, কিন্তু ২০১৪ সালে দুগিনকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই পদ থেকে অপসারিত করা হয়। দুগিন যদি সত্যিই পুতিনের রাজনৈতিক গুরু হতেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই রুশ সরকার তার পৃষ্ঠপোষকতা করতো এবং দুগিনকে এই পদ থেকে অপসারণ করা সম্ভব হতো না।
চতুর্থত, দুগিনের মেয়ে দারিয়া দুগিনার হত্যাকাণ্ড এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দুগিন এবং পুতিনের মধ্যে কোনো সরাসরি সংযোগ নেই। দুগিন বা তার মেয়েকে রুশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনোরকম নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। দুগিন সত্যিই পুতিনের ‘মস্তিষ্ক’ হলে তিনি ও তার পরিবার এরকম অরক্ষিত থাকত না।
সর্বোপরি, বহুসংখ্যক রুশ ও পশ্চিমা পণ্ডিত এই বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন যে, রুশ সরকার ও পুতিনের ওপর দুগিনের রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত এবং পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম দুগিনের প্রভাবকে ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেছে। উক্ত পণ্ডিতদের মধ্যে রয়েছেন রুশ সাংবাদিক আনাতোলি কারলিন ও লিওনিদ রাগোজিন, রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক দিমিত্রি বাবিচ, রুশ অনলাইন জার্নাল ‘রিডল রাশা’র প্রধান সম্পাদক আন্তন বারবাশিন, ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ ও ইউরেশিয়া বিশেষজ্ঞ মার্লিন লারুয়েল, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক স্যামুয়েল রামানি এবং ব্রিটিশ লেখক ও রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মার্ক গালিওটি।
সামগ্রিকভাবে, আলেক্সান্দর দুগিন রুশ রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ভূরাজনীতির একজন কৌতূহলোদ্দীপক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু রুশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর দুগিনের কার্যত কোনো প্রভাব রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সুতরাং, দুগিনকে ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’, ‘পুতিনের আধ্যাত্মিক গুরু’, ‘পুতিনের রাসপুতিন’ প্রভৃতি বর্ণাঢ্য অভিধায় অভিষিক্ত করাটা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।