পুলিশ শব্দটি শুনলেই প্রথম যে কয়টি জিনিস আমাদের কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বন্দুক। এই বন্দুকই তো সমাজের সাধারণ মানুষের থেকে পুলিশকে অসাধারণ করে তোলে। বিভিন্ন প্রয়োজনে পুলিশকে অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করতে হয় বটে, তবে সবচেয়ে প্রচলিত হলো বন্দুক। বন্দুক ছাড়া আবার পুলিশ হয় নাকি, এরকম ধারণাও রয়েছে অনেকের মাঝে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, পুলিশ হলেই যে সাথে বন্দুক বা অন্য কোনো আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে হবে, এমন ধারণা সর্বৈব ভুল। বিশ্বের বেশ কিছু দেশের পুলিশই সাথে বন্দুক বহন করে না। এখন আপনাদেরকে শোনানো হবে সেরকমই কিছু দেশের কাহিনী।
আইসল্যান্ড
ছোট্ট এই দেশটির পুলিশ অফিসাররা সকলেই আগ্নেয়াস্ত্র চালনার ব্যাপারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বটে, কিন্তু সাধারণত তারা তাদের সাথে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রই রাখেন না। কেবল টহল পুলিশের গাড়িতে সামান্য কিছু আগ্নেয়াস্ত্র থাকে।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০১৩ সালে যখন দেশটিতে পুলিশের গুলিতে একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলো, দেশটির ইতিহাসে সেটিই ছিল প্রথম দৃষ্টান্ত যে পুলিশ তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। অবশ্য আপনাদের বিস্ময়বোধ কিছুটা হলেও কমবে, যখন জানতে পারবেন, দেশটির জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৪০ হাজারেরও কম।
দেশটির পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না বটে, তবে সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই শিকারের জন্য রাইফেল ও শটগান ব্যবহার করে থাকে, যা দেশটিকে পরিণত করেছে জনপ্রতি সর্বোচ্চ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের ১৫তম দেশ। কিন্তু তারপরও, দেশটিতে অপরাধপ্রবণতা খুবই কম।
আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ড পুলিশের ব্যাপারে যে তথ্যটি শুনবেন, তা আরো বেশি বিস্ময়কর। আইসল্যান্ডের পুলিশ অফিসাররা তো তা-ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর ব্যবহারবিধি জানেন, কিন্তু আয়ারল্যান্ডের পুলিশ অফিসাররা সেটিও জানেন না। তাই কোনো কারণে যদি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে আয়ারল্যান্ড পুলিশের উপর সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালাচ্ছে, তখনো পুলিশের বেশিরভাগ সদস্যকেই নিরুপায় হয়ে থাকতে হবে।
জাতিসংঘের অর্থায়নে গড়ে ওঠা গবেষণা বিষয়ক ওয়েবসাইট গান পলিসি ডট অর্গের তথ্যমতে, আইরিশ পুলিশ অফিসারদের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আগ্নেয়াস্ত্র পরিচালনায় দক্ষ। পিপার স্প্রে কিংবা ব্যাটনের সাহায্যে তারা কাজ চালান। কিন্তু তারপরও, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায়ই আয়ারল্যান্ডে অপরাধের হার খুবই কম।
আয়ারল্যান্ডে অপরাধপ্রবণতা কম হওয়া এবং পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র পরিচালনার প্রয়োজন না হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো, দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন খুবই কঠোর। দেশটিতে চাইলেই যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে না।
নরওয়ে
এখানে টহল পুলিশ চাইলে তাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারে, কিন্তু কোনো পুলিশকে তাদের বেল্টে করে বন্দুক বহন করতে দেখা যায় না। সরাসরি কোনো সদস্যের হাতে বন্দুক তুলে দেয়ার বদলে, নরওয়েজিয়ান পুলিশ তাদের অস্ত্রশস্ত্র পেট্রোল কারে কিংবা পুলিশ স্টেশনের অস্ত্রাগারে আনলোডেড এবং সিল মারা অবস্থায় রেখে দেয়াকেই সুবিধাজনক বলে মনে করে।
প্রয়োজনের সময় নরওয়েজিয়ান পুলিশ অস্ত্র ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাদের পূর্বানুমতির প্রয়োজন পড়ে। যদি অস্ত্র ব্যবহার ছাড়া আর কোনো উপায় খোলা না থাকে, তাহলেও একজন পুলিশ অফিসারকে আগে তার চিফের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।
অস্ত্র ব্যবহারের এমন কড়াকড়ি ইতিমধ্যেই দেশটিকে একবার বড় ধরনের ট্র্যাজেডির সম্মুখীন করেছে। ২০১১ সালে কট্টর ডানপন্থী অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক নরওয়ের অসলোতে প্রথমে বোমা হামলা, এবং এরপর ইউটোয়া দ্বীপের একটি গ্রীষ্মকালীন ইয়ুথ ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এতে মোট ৭৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো ২৪২ জন।
অনেকেরই বিশ্বাস, সেদিন পুলিশ যদি সাথে সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের তৎপরতা শুরু করত, তাহলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হতো। আর তাই দেশটিতে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের উপর যে মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি, তার কঠোর সমালোচনা হয়। কিন্তু তারপরও এখনো সেখানে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারে একই রকম জটিলতাই বিদ্যমান রয়েছে।
নিউজিল্যান্ড
হ্যাঁ, সদ্যই এক হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টের আক্রমণে ৪৯ জন মুসলিমের মৃত্যু হয়েছে যেই নিউজিল্যান্ডে, সেখানকার পুলিশও সাধারণত তাদের সাথে বন্দুক বহন করে না। এতটাই শান্তিপ্রিয় এই দেশটি!
কথিত আছে, শান্তিপ্রিয় এই দেশটিতে নাকি পুলিশ হওয়ার চেয়ে কৃষক হওয়া ঢের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তো টহল পুলিশ অফিসাররা তাদের সাথে বন্দুক রাখেন না। এমনকি অনেকে তো জরুরি দরকারে কাজে লাগানোর জন্য তাদের গাড়িতেও বন্দুক রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। অবশ্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এবং বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশকে সাথে বন্দুক রাখতেই হয়।
নিউজিল্যান্ডের কিছু নির্দিষ্ট পুলিশ অফিসার- সার্জেন্ট এবং অন্যান্য সুপারভাইজার, কে-নাইন ইউনিট বা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, তাদের সাথে অস্ত্র বহন করার ক্ষমতা রাখেন। তবে সেসব অস্ত্র পেট্রোল যানের নির্দিষ্ট তালাবদ্ধ ক্যাবিনেটে রাখা থাকবে, এবং খুব প্রয়োজন পড়লেই কেবল অফিসার অন্য আরেকজন কমান্ডিং অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে নিজে সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন, এবং অন্যান্য সদস্যের মাঝেও তা বিতরণ করতে পারবেন।
গ্রেট ব্রিটেন
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমনকি ব্রিটেনের ৮২ শতাংশ পুলিশও সশস্ত্র অবস্থায় থাকার পক্ষপাতী নয়। তাদের বিশ্বাস, পুলিশ হলো সাধারণ মানুষের অভিভাবক। তাই পুলিশের উচিৎ যথাসম্ভব সাধারণ অবস্থায় থাকা, যাতে করে প্রয়োজনে যে কেউ তাদের কাছে এসে সাহায্য চাইতে পারে। তাই তো নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড বাদে ব্রিটেনে অন্য সকল স্থানের পুলিশই অস্ত্রহীন অবস্থায় থাকে। কেবল নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ‘রুটিনমাফিক’ তাদের সাথে বন্দুক বহন করে।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে যুক্তরাজ্যের পুলিশ অফিসাররা একেবারেই প্রতিরোধহীন। সাথে বন্দুক না থাকলেও তারা অন্যান্য প্রচলিত পুলিশ গ্যাজেট যেমন ব্যাটন, পিপার স্প্রে, হ্যান্ডকাফ ইত্যাদি ঠিকই সাথে রাখে।
এবং যখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে ভারি অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া উপায় নেই, তখন গ্রেট ব্রিটেন এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের পুলিশ অনুমোদিত ফায়ারআর্ম অফিসারদের সাহায্য নিতে পারে। এই অফিসাররা বিশেষভাবে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, এবং সবসময়ই তারা প্রস্তুত থাকেন সাধারণ পুলিশের ডাকে সাড়া দিতে।
শেষ কথা
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই যেখানে পুলিশবাহিনীকে সর্বোচ্চ সশস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করা হচ্ছে, সেখানে উপর্যুক্ত পাঁচটি দেশের পুলিশ এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্র ছাড়াই নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, এ ব্যাপারটি সত্যিই অভাবনীয়। তবে যেহেতু এই পাঁচটির দেশের প্রতিটিই অত্যন্ত নিরাপদ ও শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত, তাই এতদিন তৃতীয় বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় উন্নতবিশ্বের দেশগুলোর মতো এসব দেশের পুলিশকে অস্ত্র ব্যবহারে খুব বেশি সক্রিয় হতে হয়নি।
কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে গোটা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদ অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। বাদ যায়নি নিরাপদ ও শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত এসব দেশও। নরওয়েতে ২০১১ সালে যেমন ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, ঠিক তেমনই গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে গ্রেট ব্রিটেনেও। আর সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের হামলা তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল, পৃথিবীর কোনো প্রান্তই এখন আর নিরাপদ নয়।
তাই অদূর ভবিষ্যতে ব্রিটেন, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের পুলিশকেও যদি প্রতিনিয়ত অস্ত্র বহনে বাধ্য হতে হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/