৫ হাজার দিনের অপেক্ষায় প্রাপ্তি ৬৯ মিলিয়ন ডলার!

১ মে ২০০৭; মাইক উইংকেলম্যান অনলাইনে একটি ডিজিটাল আর্ট আপলোড করেন। পরের দিনও করেন, তারপরের দিনও করেন… এভাবে প্রতিদিনই একটি করে ব্র্যান্ড নিউ ডিজিটাল আর্ট আপলোড করতে থাকেন তিনি, যার নাম দেন ‘Everydays‘। 

টানা প্রায় সাড়ে ১৩ বছর ধরে প্রতিদিনই নতুন ছবি আপলোড করেছেন তিনি। এই প্রতিটি ছবি একত্র করেই এখন তৈরি করা হয়েছে ‘EVERYDAYS: THE FIRST 5000 DAYS‘ নামক এক ডিজিটাল ছবি, যা ডিজিটাল আর্টের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলারের রেকর্ড মূল্যে। ডিজিটাল অকশন হাউজ ক্রিস্টি এই আর্ট নিলামে তোলে।

মাইক উইঙ্কেলম্যান; Image source: Christie’s Images Limited 2020

ডিজিটাল আর্ট কী?

চিত্রশিল্পী বলতেই আমরা বুঝি ক্যানভাসে রংতুলি নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকে যে মানুষ। কিন্তু বর্তমানে যেমন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব, তেমনি ছবি আঁকতে এখন রংতুলি না হলেও চলে। অনেক চিত্রশিল্পীই এখন কম্পিউটার, ভিডিও টেকনোলজি, গ্রাফিক্স ব্যবহার করে আঁকছেন অসাধারণ সব ছবি। এগুলোই হলো ডিজিটাল আর্ট। 

ডিজিটাল আর্ট তৈরি করা হয় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, আর প্রকাশও হয় ডিজিটাল মাধ্যমেই। পুরোপুরি কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করেই তৈরি করা যায় এসব ডিজিটাল আর্ট, কিংবা হাতে আঁকা ছবি স্ক্যান করে অ্যাডোব ইলাস্ট্রেটরের মতো বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমেও ফিনিশিং দেওয়া যায়। অ্যানিমেশন এবং ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল প্রযুক্তিও একধরনের ডিজিটাল আর্ট।

শুরুর কথা 

কম্পিউটার ছাড়া ডিজিটাল আর্টের কথা চিন্তাই করা যায় না। আজকের সহজলভ্য এই কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪০ এর দিকে যখন Electronic Numerical Integrator and Computer অর্থাৎ ENIAC তৈরি করা হয় সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য। ‘৬০ এর দশকের শুরুর দিকে কম্পিউটার ব্যবহার করে আর্ট বা চিত্র তৈরির চেষ্টা চালান শিল্পীরা।

প্রথম পরীক্ষামূলক ছবি তৈরি হয় ১৯৬৫ সালে যখন জার্মান শিল্পী এবং গণিতবিদ নেইক কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বিভিন্ন ছবি আঁকতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে আমেরিকান শিল্পী কেনেথ নোল্টন এবং লিউন হারমন প্রথমবারের মতো ক্যামেরায় তোলা একটি ছবিকে কম্পিউটার কম্পোজ করে পিক্সেলে রূপান্তরিত করেন।

তবে ডিজিটাল আর্ট শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৮০ সালে, যখন কম্পিউটার প্রকৌশলীরা একটি নতুন প্রোগ্রাম তৈরি করেন যেখানে ছবি স্ক্যান করে বা ট্যাবলেট গ্রাফিক্স ব্যবহার করে ডিজিটাল আর্ট তৈরি করা যাবে। হ্যারল্ড কোহেন নামক এক শিল্পী প্রথম এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি ছবি আঁকেন যার নাম ‘অ্যারন’। 

অ্যারন; Image source: Tate

এরপর থেকে ডিজিটাল আর্টের ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। বর্তমান সময়ে এর মূল ব্যবহার দেখা যায় মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল আর্টের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সেটা হোক ডিজিটাল মার্কেটিং কিংবা নানামুখী কন্টেন্ট।

ডিজিটাল আর্টিস্টদের আনাগোনাও বেড়েছে বহুগুণে। নতুন নতুন সব চিন্তাভাবনা ফুটে উঠছে ডিজিটাল আর্টে। দিন দিন গ্রাফিক্সের যত উন্নতি হচ্ছে তত উন্নত মানের ডিজিটাল আর্ট তৈরি হচ্ছে।

বিখ্যাত কিছু ডিজিটাল আর্ট

Image source: davidmcleod.com
Image source: erikjo.com
Image source: instagram.com/combophoto/

EVERYDAY : FIRST 5000 DAYS 

আমেরিকান গ্রাফিক্স ডিজাইনার মাইক উইঙ্কেলম্যান ২০০৭ সালের মে মাসে তার চাচা জো-র একটি ছবি আঁকেন। উবার জে নাম দিয়ে ছবিটি তিনি অনলাইনে শেয়ার করেন। উল্লেখ্য, মাইককে তার চাচা জো, উবার জে নামে ডাকতেন। তারপরের দিনও নতুন একটি ছবি এঁকে শেয়ার করেন। এভাবে চলতেই থাকে প্রায় সাড়ে ১৩ বছর ধরে। ইন্সট্রাগ্রামে ‘beeple_crap‘ নামের একাউন্ট থেকে এই ছবিগুলো প্রকাশ করেছেন তিনি। এজন্য beeple নামেই মানুষের কাছে তিনি পরিচিত।

কিছুদিন কাজ করার পরই বেশ পরিচিতি পান মাইক। দক্ষ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান অ্যাপল, কোকা-কোলা, নাইক, লুইস ভুটনের মতো কোম্পানির সাথে। এছাড়া জাস্টিন বিবার আর কেটি পেরির জন্যও কাজ করেছেন তিনি।

Image source: CHRISTIE’S IMAGES LTD/BEEPLE

ফলে তার প্রসার আরো বেড়ে যায়। এর মাঝেই থ্রি-ডি টেকনোলজি আয়ত্ত করেন মাইক। এখন তার ‘Everydays‘ নামক সিরিজটি একটি কমিক বুকে পরিণত হয়েছে। নিত্যনতুন কনটেন্ট, আলাদা চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতার ন্যায় গুণাবলির জন্য ডিজিটাল আর্টের জগতে তিনি বেশ নাম কুড়িয়েছেন।

Image source: beeple_crap.com

করোনার এই সময়ে সবার মতো মাইকের ডিজাইন ব্যবসাতেও ভাটা পড়লো। তিনি নতুন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন এই অবস্থা কাটাতে। পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়েও ঘাটাতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, হাতে আঁকা চিত্রশিল্পের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতে এসব ডিজিটাল আর্টের চাহিদাও অনেক। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে একটি ডিজিটাল আর্টকে NFT (Non-fungible Tokens) থেকে ইউনিক হিসেবে স্বীকৃতি নিতে হবে।

এক্ষেত্রে NFT নিয়ে কিছু বলে রাখা ভাল। অর্থনীতিতে Fungible Asset বলতে বোঝায় যা বিনিময় করা যায় এমন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় টাকা। যেমন- একটি ১০ টাকার নোটকে পরিবর্তন বা এক্সচেঞ্জ করে দুটো ৫ টাকার নোট নেওয়া যায়। কিন্তু Non-fungible Asset-গুলোকে বিনিময় করা যায় না। সহজভাবে বলতে গেলে, NFT কর্তৃক স্বীকৃত প্রোডাক্ট মানেই ইউনিক এবং আসল। এর বহু কপি থাকতে পারে, কিন্তু সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত জিনিসই আসল।

মাইকের মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেল। ‘Everyday’ সিরিজের সবগুলো ছবিকে কোলাজ করে একটি ছবি বানালে কেমন হয়! যে-ই ভাবা সে-ই কাজ।

ক্রিস্টি নামক এক অকশন হাউজের সাথে চুক্তি করলেন মাইক। যদিও এর আগে এই অকশন হাউজ থেকে কখনো ডিজিটাল আর্ট বিক্রিই হয়নি। তাদের অকশন চললো দুই সপ্তাহ ধরে। বিডিং শুরু হয়েছিলো মাত্র ১০০ ডলার থেকে। তখন কি আর কেউ ভেবেছিল ডিজিটাল আর্টের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবে এই অকশন!

৬,৯৩,৪৬,২৫০ ডলারে বিক্রি হয় ৪৪০ মিলিয়ন পিক্সেলের ডিজিটাল এই আর্ট, যা শুধু ডিজিটাল আর্টের জগতে নয়, পুরো ভার্চুয়াল জগতের সবচেয়ে বড় কেনাবেচা! এই ডিজিটাল আর্টটি কিনেছেন দক্ষিণ ভারতের মেতাকোভান নামের এক যুবক। বিটকয়েন ব্যবসার সাথে জড়িত এই ব্যবসায়ী ভার্চুয়াল জগতের বিলিয়নিয়ার। 

Related Articles

Exit mobile version