“আমি জেফকে ১৫ বছর ধরে চিনি। দারুণ লোক। সে অনেক মজা করতে পারে। আমার মতো সে-ও সুন্দরী নারীসঙ্গী পছন্দ করে। এদের মধ্যে অনেকেই তরুণী। জেফ তার সামাজিক জীবন খুব উপভোগ করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
-ডোনাল্ড ট্রাম্প (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট)
“জেফরি একইসাথে সফল অর্থ ব্যবস্থাপক ও প্রতিশ্রুতিশীল সমাজসেবক। বৈশ্বিক বাজার সম্পর্কে তার প্রখর জ্ঞান আছে। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার গভীর জ্ঞান। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকা সফরে গণতন্ত্রায়ন, দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন, নাগরিক সেবা ও এইডসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার যে অন্তর্দৃষ্টি ও উদারতা দেখেছি, তার তারিফ করতে হয়।”
-বিল ক্লিনটন (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট)
আমেরিকার দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট যার প্রশংসা করে উক্তিগুলো করেছেন, তিনি হচ্ছেন সাবেক অর্থ ব্যবস্থাপক জেফরি এপস্টেইন। ২০০২ সালে নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে তাদের এ রকম প্রশংসা করতে দেখা যায়।
প্রশংসা শুনলে মনে হবে এপস্টেইন নিশ্চয়ই বড় বুদ্ধিজীবী কোনো ব্যক্তি হবেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নারী পাচারের অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট তাকে ম্যানহাটনের একটি কারাগারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃতদেহ পরীক্ষা করে জানা যায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
প্রচারের আড়ালে থাকা এ দুর্ধর্ষ ব্যক্তির ছিল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তারকাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এগুলোকে কাজে লাগিয়েই তার যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেন।
এপস্টেইনের সাথে বিল গেটস বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখায় তার সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসও নাখোশ ছিলেন। তাই জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যখন ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ আনা শুরু করেন, তখন তিনি কেবল একাই খাদে পড়েননি, তার সাথে জড়িয়ে পড়ে অনেক বড় বড় নাম। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে তিনি অনেক বড় বড় বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ আর বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করলেও তার কোনো বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি ছিল না।
১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া ও কনি আইল্যান্ডে বড় হওয়া জেফরি এপস্টেইন পড়াশোনা করেন লাফিয়াত হাই স্কুলে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কুপার ইউনিয়নে পদার্থ বিজ্ঞান পড়েছেন। ১৯৭১ সালে কুপার ইউনিয়ন ছেড়ে দেন এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কউরেন্ট ইন্সটিটিউটে ম্যাথমেটিকেল ফিজিওলজি অব হার্ট বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো ডিগ্রি ছাড়াই বের হয়ে আসেন।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালে ডালটন স্কুলে ক্যালকুলাস ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকতা করেছিলেন। সেখানে তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে এক ছাত্রের অভিভাবক যিনি ওয়ালস্ট্রিটে চাকরি করতেন, তিনি এপস্টেইনকে বলেছিলেন, “আপনি ডালটনে বসে অঙ্ক শিখিয়ে কী করছেন? আপনার উচিত ওয়ালস্ট্রিটে আসা। আমার বন্ধু এইস গ্রিনবার্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।”
গ্রিনবার্গ ছিলেন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বিয়ার স্টিয়ার্নসের সে সময়ের একজন সিনিয়র অংশীদার। তিনি দরিদ্র, চতুর ও ধনী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা ব্যক্তিদের স্টিয়ার্নসে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এপস্টেইন ছিলেন তার কাঙ্ক্ষিতদের একজন। তাই ১৯৭৬ সালে তিনি ডালটনে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং স্টিয়ার্নসের আমেরিকান স্টক এক্সচেঞ্জে একজন ফ্লোর ট্রেডারের জুনিয়র এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তার ক্যারিয়ারে দ্রুত উন্নতি হতে থাকে।
১৯৮২ সালে নিজেই কোম্পানি খুলেন জে এপস্টেইন অ্যান্ড কোং নামে। এখানে তার সার্ভিস নিতে হলে ক্লায়েন্টদের এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক হতে হতো। তিনি তাদের বিনিয়োগের পরামর্শ দিতেন। নিজেকে দেখতেন বিলিয়নিয়ারদের অর্থ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্থপতি হিসেবে। তিনি শুধু বিনিয়োগের ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না, তাদের সমাজসেবা ও কর সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়েও আশ্বস্ত করতেন। এভাবেই ক্ষমতাধরদের সাথে তার পরিচয় হতে থাকে।
১৯৯২ সালে তিনি ম্যানহাটনের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত বাড়ির মালিক হন। কর সংক্রান্ত কারণে তিনি অন্তত ১৯৯৬ সাল থেকে তার ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন সেন্ট টমাস দ্বীপ থেকে। ওই দ্বীপের কাছে লিটল সেন্ট জেমস দ্বীপটি কিনে ফেলেন তিনি। এ দ্বীপ থেকে তিনি তার ফাউন্ডেশনের কাজও করতেন, যার নাম ছিল ‘জেফরি এপস্টেইন সিক্স ফাউন্ডেশন’। তার ফাউন্ডেশনটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬.৫ মিলিয়ন ডলার ডোনেশন দিয়েছিল।
শূন্য দশকের শুরুর দিকে বিল ক্লিনটনের সাথে পরিচয় তাকে তারকা খ্যাতি এনে দেয়। বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনের আফ্রিকা সফরের এইডস প্রতিরোধ প্রজেক্টে তার ব্যক্তিগত ৭২৭ বিমান ব্যবহার করতে দেন। সেখানে তিনি ও বিল ক্লিনটনসহ হলিউড অভিনেতা কেভিন স্পেসি ও কমেডিয়ান ক্রিস টাকারও যোগ দেন। ২০০২ ও ২০০৩ সালের মধ্যে এপস্টেইনের ব্যক্তিগত বিমানে ক্লিনটন একাধিকবার ভ্রমণ করেন।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সাথেও সু-সসম্পর্ক রাখতেন। তাদের মোটা অঙ্কের ফান্ড দিতেন। এভাবে নিজেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বলয়ে নিয়ে আসেন। এটা তাকে পরবর্তীতে আজীবন সাজা পাওয়ার মতো অপরাধেও লঘু দণ্ড পেতে সাহায্য করেছিল।
সমাজে তার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও এর আড়ালে তার ছিল অন্ধকার জীবন। তার নারীসঙ্গের ব্যাপারটা গোপন ছিল না। তবে তিনি অপ্রাপ্তবয়স্কদের তার দ্বীপে কিংবা ম্যানহাটনের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। তাদের দিয়ে শরীর মালিশ করাতেন। তখন তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করতেন। এরপর হস্তমৈথুন করতেন কিংবা তাদের সাথেই যৌন সম্পর্ক করতেন। এভাবে অনেককেই ধর্ষণ করেছেন।
তিনি আবার এসবের বিনিময়ে পারিশ্রমিকও দিতেন। ৩০০ ডলার থেকে ১,০০০ ডলার পর্যন্ত হতো পরিমাণ। আমেরিকার বাইরে থেকেও অল্পবয়সী তরুণীদের ধরে আনতেন। তাদের বলতেন তাকে আরো মেয়ে এনে দিতে। তার চাহিদা ছিল কম বয়সী তরুণী। এভাবে তিনি একটা ‘সেক্সুয়াল পিরামিড স্কিম’ তৈরি করেন। কেউ অভিযোগ করতে চাইলে প্রভাবশালী আইনজীবী কিংবা গোয়েন্দাদের দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করাতেন।
২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে এক নারী অভিযোগ করেন, তার মেয়েকে এক মধ্যবয়সী পুরুষ যৌন হয়রানি করেছে। পাম বিচের গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে একাধিক তরুণীর সাক্ষ্যে প্রমাণ পান, এপস্টেইন তাদেরকে যৌন হয়রানি করেছেন। এ মামলাটি তখন এফবিআইয়ের কাছে চলে যায়। ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে তাকে সাজা দেওয়া হয়। মায়ামি হেরাল্ডের সাংবাদিক জুলি ব্রাউন ৮০ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ পান। এফবিআইও ৪০ জনের প্রমাণ পেয়েছিল।
এপস্টেইনের শিকার হওয়া নারীদের জীবন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এপস্টেইনের সাথে পরিচিত হওয়ার আগের সময় ও পরের সময়। তার যৌন নিপীড়নে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অনেকে নেশায় জড়িয়ে পড়ে। অত্যন্ত ক্ষমতাধর হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না তাদের। এপস্টেইন লক্ষ্যবস্তুও বানাতেন গরিব ও অসহায় নারীদের। তার এক ভুক্তভোগী নারী ছোট ছেলে সন্তান রেখে হিরোইন ওভারডোজে মারা যান।
এফবিআই ২০০৭ সালে তাকে নিয়ে ৫৩ পৃষ্ঠার এক অভিযোগপত্র প্রকাশ করে। সেখানে যে অভিযোগগুলো আসে, তাতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারত। কিন্তু এখানেও তার প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্ক থাকার সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন। মায়ামির তখনকার অ্যাটর্নি আলেকজান্ডার অ্যাকোস্তার সাথে চুক্তি করেন, যার ফলে মাত্র ১৮ মাসের সাজা হয়। তাও পুরো সাজা ভোগ করেননি, ১৩ মাস পরই ছাড়া পেয়ে যান। অ্যাকোস্তা পরবর্তীতে ট্রাম্প প্রশাসনের শ্রম মন্ত্রী হয়েছিলেন।
তার নাম যৌন অপরাধীদের তালিকায় উঠলেও কোনো ফেডারেল বা স্টেট প্রিজনে থাকেননি। বরং পাম কাউন্টি জেলের প্রাইভেট এক উইংয়ে ছিলেন। তিনি সেখানে দৈনিক ১২ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ছয় দিন ‘কর্মঘণ্টায়’ ছাড়া পাওয়ার সুবিধা ভোগ করেছেন। যদিও পাম বিচের শেরিফ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে যৌন নিপীড়নের জন্য সাজাভুক্তদের জন্য এ সুযোগ নিষিদ্ধ ছিল।
তার সাজা কম পাওয়া কিংবা প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্ক থাকায় অনেকে মনে করেন, এপস্টেইন তাদেরকেও নারী সরবরাহ করতেন। কারণ এপস্টেইনের ক্লায়েন্টদের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে ভালো দক্ষতা ছিল। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির তখনকার চেয়ারম্যান রিন্স প্রিবাস সন্দেহ করেন বিল ক্লিনটনও এপস্টেইনের অপকর্মের একজন সঙ্গী। তিনি বলেন, “আপনি যখন জেফরি এপস্টেইনের মতো ব্যক্তির সাথে একাধিকবার ঘুরে বেড়ান, তার প্লেনে চড়েন, উইকেন্ডে ঘুরেন, ভ্রমণে যান, এমন সব স্থানে অবস্থান করেন, যেখানে খুব বাজে কিছু ব্যাপার ঘটার অন্তত অভিযোগ এসেছে, তখন আমাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট কী করে বেড়াচ্ছেন তা অনুমান করা কঠিন কিছু না।”
তবে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে এমন কিছুর অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তিনিও বলেছেন, এপস্টেইনের সাথে সমাজ সেবার কাজে ঘুরে বেড়ালেও তার নারী কেলেঙ্কারির বিষয়ে জানতেন না।
এদিকে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও এক নারী অভিযোগ করেন, ১৯৯৪ সালে এপস্টেইন ও ট্রাম্প তাকে ধর্ষণ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। যদিও পরবর্তীতে মামলা তুলে নেন। ট্রাম্প এ ঘটনাকে অস্বীকার করেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে করেন। তিনি ২০০২ সালে এপস্টেইনের প্রশংসা করলেও ২০১৯ সালে বলেন, এপস্টেইনের সাথে ১৫ বছর ধরে তার যোগাযোগ নেই। তিনি কখনো এপস্টেইনের ‘ভক্ত’ ছিলেন না।
শুধু সাবেক প্রেসিডেন্টরাই নন, এপস্টেইনের বন্ধুদের তালিকায় ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যও। স্বয়ং প্রিন্স এন্ড্রুর নামেও অভিযোগ এসেছিল। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।
পরবর্তীতে ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হলে এপস্টেইনের নাম আবারো উঠে আসে। তার ভুক্তভোগী নারীরা আবারো অভিযোগ করতে শুরু করেন। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ফ্রান্স থেকে ভ্রমণ শেষে ফেরার সময় নিউ জার্সি বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নিউইয়র্কের ফেডারেল কোর্টে নারী পাচারের মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলা প্রমাণিত হলে তার ম্যানহাটনের বাড়ি বাজেয়াপ্ত হওয়াসহ ৪৫ বছরের জেল হতে পারত। তবে আগস্টে তার আত্মহত্যার পরও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে থাকে। জেফরি এপস্টেইনের ঘটনা বিশ্বকে আরো একবার প্রমাণ করে দিলো ক্ষমতাবানরা কীভাবে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে।