২০২০ সালের প্রথমার্ধে কোভিড–১৯ মহামারীর বিশ্বব্যাপী বিস্তারের ফলে যে শকের সৃষ্টি হয়েছিল, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সেটি বহুলাংশেই স্তিমিত হয়ে আসে। কার্যত ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন অনেক জটিল অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে, এবং এর ফলে বর্তমান বিশ্ব জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
২০২০ সালের ১ জুলাই রাশিয়ায় সংবিধান পরিবর্তনের জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন দেশটির সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেন, যেগুলোর মধ্যে ছিল – কোনো প্রার্থীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মেয়াদ তুলে নেয়া (যার ফলে পুতিন ২০২৪ সালে পুনরায় রুশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন); রাশিয়াকে আংশিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে (welfare state) পরিণত করা; সমকামী বিয়ের (same-sex marriage) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; শিক্ষাব্যবস্থায় দেশপ্রেমিক চিন্তাধারার সম্প্রসারণ করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর রুশ আইনকে প্রাধান্য প্রদান করা। রুশ জনসাধারণের সিংহভাগ সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে ভোটদান করে, এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ওপর পুতিনের নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় হয়।
১০ জুলাই তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ইস্তাম্বুলে অবস্থিত ‘আয়া সোফিয়া’কে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। উল্লেখ্য, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সময়ে আয়া সোফিয়া ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গির্জা। ওসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক ইস্তাম্বুল জয়ের পর একে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়, কিন্তু প্রথম তুর্কি রাষ্ট্রপতি কামাল আতাতুর্ক একে জাদুঘরে পরিণত করেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরিত করার পেছনে এরদোয়ানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তুর্কি জনসাধারণের রক্ষণশীল অংশের জনসমর্থন আদায় করা, এবং মুসলিম বিশ্বে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করা। অবশ্য তুর্কি বিরোধী দলগুলো এবং কিছু কিছু রাষ্ট্র তার এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।
১২ জুলাই দক্ষিণ ককেশাসের রাষ্ট্র আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ আরম্ভ হয়, এবং ৪ দিনব্যাপী এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। এই সংক্ষিপ্ত সংঘাতের ফলে আজারবাইজানে আর্মেনীয়বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করে (যেটির আসলে কখনোই কমতি ছিল না), এবং আজারবাইজানি জনসাধারণ বিক্ষোভ করে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দাবি জানায়। এই সংঘর্ষের পর জুলাইয়ের শেষদিকে আজারবাইজানের মাটিতে তুরস্ক ও আজারবাইজান যৌথ মহড়া শুরু করে, যেটি আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। এসময় কার্যত তুরস্ক ও আজারবাইজান আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যেটি বহুলাংশে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়।
৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুতের একটি গুদামে মজুদকৃত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরিত হয়, এবং এর ফলে বৈরুত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২২০ জন নিহত ও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়, এবং প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তদুপরি, এই দুর্ঘটনার ফলে লেবাননের প্রায় ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়। লেবানিজ জনসাধারণ এর আগে থেকেই তাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছিল, এবং এই বিস্ফোরণের জন্য তারা লেবানিজ সরকারের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করে। ফলশ্রুতিতে লেবানিজ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে ৫ আগস্ট মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেক্স অ্যাজার তাইওয়ান সফর করেন। বিগত ৪১ বছরের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কোনো মার্কিন কর্মকর্তার তাইওয়ান সফর। এর পেছনে থাকা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝতে চীনাদের অসুবিধা হয়নি, এবং চীনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। বস্তুত সম্প্রতি তাইওয়ান বৃহৎ একটি সামরিকায়ন কর্মসূচি শুরু করেছে, যেটির লক্ষ্য সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ প্রতিহত করা। চীন যেহেতু তাইওয়ানকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে, সেহেতু এই অঞ্চলেও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
৯ আগস্ট বেলারুশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং দেশটির ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো নির্বাচনে বিজয়ী হন। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন, এবং বেলারুশ জুড়ে লুকাশেঙ্কোর পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষত পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া, লুকাশেঙ্কোর বিরোধীদের সমর্থন দিতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে বেলারুশের ওপর নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন, এবং বিগত বছরগুলোতে রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া তাকে সহায়তা করতে সম্মত হয়। রাশিয়া বেলারুশকে বিরাট অঙ্কের ঋণ প্রদান করে এবং প্রয়োজনে বেলারুশে হস্তক্ষেপ করার জন্য রুশ নিরাপত্তারক্ষীদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে, যদিও তাদেরকে শেষ পর্যন্ত বেলারুশে মোতায়েন করতে হয়নি। এখনো বেলারুশে বিক্ষোভের অবসান ঘটেনি, কিন্তু পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত বেলারুশীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
১১ আগস্ট রাশিয়া বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের তৈরি কোভিড–১৯ এর ভ্যাক্সিন ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করে, যেটির বাণিজ্যিক নাম ‘স্পুৎনিক ফাইভ’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা যুদ্ধ শুরু হয় এবং রুশ ভ্যাক্সিনকে অকার্যকর ও ক্ষতিকর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীতে চীন, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ কতিপয় রাষ্ট্র নিজেদের তৈরি ভ্যাক্সিন ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। কার্যত বর্তমানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্যাক্সিন বিক্রি তথা বাজার দখল নিয়ে অনেকটা স্থূলভাবেই প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে।
১৩ আগস্ট ইমারাত আরব বিশ্বের তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেটি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ (Abraham Accords) নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইমারাত (ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্র) ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, এবং এই চুক্তি সেটিরই বাহ্যিক নিদর্শন। ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বই ইসরায়েলের সঙ্গে নৈকট্য স্থাপনের পিছনে তাদেরকে উৎসাহিত করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে, ইমারাতি–ইসরায়েলি চুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে, এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইমারাতের কাছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র (যেগুলোর মধ্যে রয়েছে এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান ও ড্রোন) বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে।
১৮ আগস্ট মালিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে। প্রায় এক দশক ধরে মালিতে গৃহযুদ্ধ চলছে, যেখানে তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। মালির সরকারকে সহায়তা করার জন্য ফ্রান্স দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, যদিও মালির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই ফ্রান্সের প্রকৃত উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়। এই পরিস্থিতিতে মালিতে অভ্যুত্থানের পরপরই তুরস্ক দেশটির নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে তুর্কি–ফরাসি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মালিতে এবং বৃহত্তর সাব–সাহারান আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
২৮ আগস্ট জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অসুস্থতাজনিত কারণে পদত্যাগ করেন। আবে ছিলেন জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে ইয়োশিহিদে সুগা জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য ধারণা করা হচ্ছে, সুগা সাধারণভাবে তার পূর্বসূরী আবের নীতিই অনুসরণ করবেন, এবং এখন পর্যন্ত কার্যত এটিই হয়েছে।
৪ সেপ্টেম্বর অর্থোডক্স সার্ব–অধ্যুষিত সার্বিয়া ও মুসলিম আলবেনীয়–অধ্যুষিত কসোভোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ‘অর্থনৈতিক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দুইটি এতদিন যাবৎ পরস্পরের বিরুদ্ধে যে নীরব কূটনৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছিল, সেটি বন্ধ রাখার জন্য একমত হয়। অবশ্য এর পাশাপাশি রাষ্ট্র দুটি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে ও সেখানে নিজেদের দূতাবাস স্থানান্তর করতেও সম্মত হয়, এবং ইরানি–সমর্থিত হিজবুল্লাহকে একটি ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করে। একই দিনে বাহরাইন চতুর্থ আরব রাষ্ট্র হিসেবে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে’র আওতায় মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
২৭ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়, যেটি পূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেয়। তুর্কি স্পেশাল ফোর্স, সামরিক উপদেষ্টা ও ড্রোন অপারেটর এবং সিরীয় মার্সেনারিদের সহায়তায় অত্যাধুনিক রুশ, তুর্কি ও ইসরায়েলি অস্ত্র ব্যবহার করে আজারবাইজানিরা পুরনো সোভিয়েত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আর্মেনীয়দের পরাস্ত করে। রাশিয়া ও আর্মেনিয়া পরস্পরের সামরিক মিত্র, কিন্তু ২০১৮ সালে আর্মেনিয়ায় পশ্চিমা–সমর্থিত ‘রঙিন বিপ্লবে’র মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেটিকে সহায়তা করা থেকে রুশরা বিরত থাকে। ১০ নভেম্বর রুশ মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়, এবং প্রথম নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের (১৯৮৮–১৯৯৪) সময় আজারবাইজানের কাছ থেকে দখলকৃত ৭টি জেলা ও নাগর্নো–কারাবাখের অংশবিশেষ আর্মেনিয়া আজারবাইজানের নিকট সমর্পণ করে।
উভয় পক্ষের মধ্যে যাতে নতুন করে যুদ্ধ আরম্ভ না হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্ট আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়। এরপর রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী দেশ দুইটি নাগর্নো–কারাবাখের যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য আজারবাইজানে একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে তারা নাগর্নো–কারাবাখের সমীকরণ থেকে অপসারণ করেছে। অবশ্য এই যুদ্ধে আজারবাইজানি বিজয়ের ফলে ইরানে বসবাসকারী আজারবাইজানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ঘটেছে, যেটিকে ইরান নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
৫ অক্টোবর কিরগিজস্তানে অনুষ্ঠিত আইনসভা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে এবং দেশটির জনসাধারণ সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে কিরগিজ রাষ্ট্রপতি সুরুনবে জিনবেকভ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, এবং বিরোধী দলীয় নেতা সাদির জাপারভ দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এটিও একটি ‘রঙিন বিপ্লব’, কিন্তু কিরগিজস্তান সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এজন্য কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় রাশিয়া সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
২৩ অক্টোবর আরব বিশ্বের পঞ্চম রাষ্ট্র হিসেবে সুদান মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অবশ্য ২০১৯ সালে সুদানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সুদানি রাষ্ট্রপতি ওমর আল–বশির সৌদি ও ইমারাতি–সমর্থিত একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সুদানের সুসম্পর্ক গড়ে উঠছিল। এই চুক্তির বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবাদে সহায়তা প্রদানকারী’ রাষ্ট্রগুলোর তালিকা থেকে সুদানের নাম অপসারণ করেছে, যার ফলে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সুদান এখন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবে।
৪ নভেম্বর ইথিওপিয়ার তিগ্রাই অঞ্চলের আঞ্চলিক সরকার ইথিওপীয় সশস্ত্রবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং প্রত্যুত্তরে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তিগ্রাইয়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ২০১৮ সালে তিগ্রাইভিত্তিক দল টিপিএলএফ ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারায়, এবং তখন থেকেই ইথিওপীয় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব চলছিল, যা সম্প্রতি চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে। তিগ্রাহ থেকে হাজার হাজার শরণার্থী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র সুদানে আশ্রয় নিয়েছে এবং সম্প্রতি সুদানের সঙ্গেও ইথিওপিয়ার সীমান্ত সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছে। নীলনদের ওপর ইথিওপিয়া কর্তৃক বাঁধ নির্মাণের জের ধরে বেশ কিছুদিন ধরেই সুদান ও মিসরের সঙ্গে ইথিওপিয়ার দ্বন্দ্ব চলছে, এবং এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে আরো গুরুতর রূপ ধারণ করতে পারে।
এদিকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এবং এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী জোসেফ বাইডেন বিজয়ী হয়েছেন। কোভিড–১৯ মোকাবিলায় ব্যর্থতা, জর্জ ফ্লয়েড বিক্ষোভ, মার্কিন প্রচারমাধ্যমে ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণা এবং বিশেষত রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের গোপন সম্পর্ক থাকার অভিযোগ প্রভৃতি কারণ ট্রাম্পের পরাজয়ের জন্য দায়ী। অবশ্য ট্রাম্প এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, কিন্তু মার্কিন আদালত নির্বাচনে কারচুপি সংক্রান্ত তার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্প যে আংশিক ‘বিচ্ছিন্নতা’র নীতি অনুসরণ করেছেন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেন এই নীতিতে পরিবর্তন আনবেন এবং যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বিশ্বব্যাপী সক্রিয় হবে।
১৭ নভেম্বর চীন এশিয়া–প্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একটি বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে। ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত ‘রেজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’ (আরসিইপি) নামে পরিচিত এই চুক্তিটি এতদঞ্চলে একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্লকের সৃষ্টি করেছে। চীনের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো (যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) এই ব্লকের বাইরে রয়েছে, এবং এই চুক্তি সম্পাদনকে চীনের একটি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিশ্লেষকরা বিবেচনা করছেন।
২২/২৩ নভেম্বর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সৌদি আরব সফর করেছেন এবং সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, যদিও সৌদি আরব এই সংবাদ অস্বীকার করেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও ইসরায়েল পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। অবশ্য অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মতো সৌদি আরবের পক্ষে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করা এতটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
২৬ নভেম্বর ভারতীয় আইনসভা কর্তৃক কৃষকদের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে ভারতীয় কৃষকরা তীব্র আন্দোলন শুরু করেছে এবং রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এটি এখন পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাসের বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শিখ হওয়ায় ভারতীয় সরকার এই আন্দোলনকে ‘খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের দ্বারা প্রভাবিত হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে, প্রায় অর্ধশত কৃষক নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে, এবং আন্দোলন এখনও অব্যাহত রয়েছে।
২৭ নভেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানের নিকটে ইরানি পরমাণু প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই খুনের সঙ্গে জড়িত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন (যেটি থেকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন) এবং এক্ষেত্রে ইরানের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। এজন্য ফাখরিজাদেকে খুন করে ইসরায়েল ইরানকে বেপরোয়া কোনো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উস্কে দিতে চেয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধাবস্থা দেখা দেয় এবং বাইডেনের পক্ষে ইরানের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য ইরান এখন পর্যন্ত এরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন ও ইসরায়েলি নৌবাহিনী ইরানি জলসীমার কাছ দিয়ে ঘুরে গেছে, এবং এটিকে তারা ইরানের প্রতি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
১০ ডিসেম্বর ষষ্ঠ আরব রাষ্ট্র হিসেবে মরক্কো মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অবশ্য মরক্কো ১৯৫০–এর দশক থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন কিন্তু বিস্তৃত সম্পর্ক বজায় রেখেছে। অবশ্য ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের বিনিময়ে মরক্কো একটি বিশেষ সুবিধা পেয়েছে – পশ্চিম সাহারাকে (যেটির অধিবাসীরা বহু আগে থেকে স্বাধীনতা দাবি করে আসছে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং সেখানে একটি কনস্যুলেট খুলতে সম্মত হয়েছে। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অস্ত্র বিক্রি করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র ভুটানও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সম্মত হয়েছে, যেটি ভারতীয়–ইসরায়েলি সম্পর্কের ক্রমোন্নতির একটি পরিচায়ক (যেহেতু ভুটান কার্যত ভারতের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র)।
১৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের আনুষ্ঠানিক কারণ হচ্ছে মার্কিন আপত্তি সত্ত্বেও তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস–৪০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় এবং সেটির পরীক্ষণ। এই সিস্টেমটি পরিত্যাগ করলেই কেবল তুরস্কের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা, তুরস্কের সাম্প্রতিক স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে, এবং তুরস্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেশটিকে চাপ প্রদান করতে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। অবশ্য তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করত্র আগ্রহী নয়, এবং এজন্য তারা সম্প্রতি রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে আংশিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে তুরস্কের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নমনীয় করার চেষ্টা করছে।
২০/২১ ডিসেম্বর মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া দেশটিতে কয়েক শত সৈন্য প্রেরণ করেছে। এর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী রুয়ান্ডাও দেশটিতে সৈন্য প্রেরণ করেছে। প্রায় এক দশক ধরে মধ্য আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ চলছে, এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী দলকে দমন করার জন্য রাশিয়া মধ্য আফ্রিকাকে সামরিক সরঞ্জাম ও মার্সেনারি সরবরাহ করছে। অবশ্য প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্স নিজেকে এই অঞ্চলের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে, এবং এই প্রেক্ষাপটে মধ্য আফ্রিকা ও আফ্রিকার অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে সূক্ষ্ম ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
৩০ ডিসেম্বর সিরিয়ার দেইর ইয–যর অঞ্চলে ‘আইএস’ মিলিট্যান্টদের আক্রমণে কয়েক ডজন সিরীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, নিকট ভবিষ্যতে সিরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে তুরস্ক ইদলিবে সিরীয় সৈন্যরা যেসব তুর্কি সামরিক ঘাঁটি ঘিরে রেখেছিল, সেগুলো থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং মার্কিন–সমর্থিত সিরীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘এসডিএফ’–এর ওপর চাপ বৃদ্ধি করছে। অন্যদিকে, রাশিয়া এসডিএফকে চাপ দিচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল সিরীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য।
সবশেষে, ইসরায়েলি সরকার জানিয়েছে যে, এই বছরে কোভিড–১৯ মহামারীর মধ্যেই তারা হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজা ভূখণ্ডে ৩০০টি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সুতরাং, আগামী বছর ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই’য়ের যে পরিণতিই হোক না কেন, মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই যে বন্ধ হবে না, এটি নিশ্চিত।