উত্তর কোরিয়া বহির্বিশ্ব থেকে খুবই বিচ্ছিন্ন একটা দেশ। দেশটি সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে, এখানে কিম পরিবারের কর্তৃত্ববাদী শাসন চলে আসছে প্রায় ৮০ বছর ধরে। দেশটির জনগণ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে আর বিভিন্নভাবে সরকার তথা কিম পরিবারের নির্যাতনের শিকার হয়। দেশটা যদি এতই গোপনীয়তার মধ্যে থাকে, তাহলে এসব তথ্য আমাদের কাছে আসে কী করে? সেখানে তো চাইলেই বাইরের দেশের মিডিয়া গিয়ে সবকিছু নিয়ে প্রতিবেদন করতে পারে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটও নেই। তাহলে আমরা কীভাবে জানি দেশটির এত সমস্যার কথা?
এগুলো আসলে আমরা জানতে পারি দেশটি থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের কাছ থেকে। তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা জানতে পারি উত্তর কোরিয়ার প্রকৃত অবস্থা। আমরা বুঝতে পারি উত্তর কোরিয়ার মিডিয়া থেকে যেসব খবর প্রকাশ করা হয় কিংবা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যেসব বিবৃতি দেন, সেগুলো আসলে প্রোপাগান্ডা ছাড়া কিছু না।
কিন্তু উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকরা কিংবা ডিফেক্টররা যেসব সত্য তথ্য দিচ্ছেন, তা আমরা কীভাবে বুঝি? সেটা কী আমাদের জানার উপায় আছে? অনেক সময়ই দেখা যায় তাদের সব কথার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না। কারণ এগুলো খুবই সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। তাই দেখা যায় তাদের মুখের কথার ওপরই ভরসা করতে হয়। এমনকি উত্তর কোরিয়া নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বা জাতিসংঘের নীতিমালা তৈরিতেও তাদের বক্তব্য ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু উত্তর কোরিয়া যেভাবে দেশটিতে আমেরিকা বা দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালায়, একইভাবে এই দুই দেশও কি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতে পারে না? বাস্তবে আসলে সেরকমই ঘটছে। আমেরিকা আর দক্ষিণ কোরিয়াও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কম প্রোপাগান্ডামূলক কার্যক্রম চালায়নি। এসব কার্যক্রমে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয় উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ডিফেক্টরদের। তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আর অর্থের দেওয়ার বিনিময়ে আমেরিকা আর দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মতো করে উত্তর কোরিয়া বিরোধী জনমত গড়ে তোলার প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ডিফেক্টরদের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ চার গুণ বৃদ্ধি করে। আবার এসব ডিফেক্টররাও নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো অনেকটাই বাড়িয়ে বলার চেষ্টা করে থাকেন। এ রকম কয়েকজনের উদাহরণ দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের মধ্যে তারকা খ্যাতি পাওয়া ডিফেক্টরদের একজন ছিলেন শিন দং হিউক। তার পালানোর গল্প নিয়ে লেখা বেস্টসেলার বই এস্কেপ ফ্রম ক্যাম্প ১৪ বইটা প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি তারকা খ্যাতি পেয়ে যান। এই বইয়ে তিনি দাবি করেন, উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারাগার থেকে পালিয়ে এসেছেন। তাকে মনে করা হতো সম্পূর্ণ সুরক্ষা বলয় থেকে পালিয়ে আসা প্রথম ব্যক্তি।
তার জন্ম এই প্রিজন ক্যাম্পেই। এই ক্যাম্পকে মনে করা হতো মাও সে তুং কিংবা স্ট্যালিনের আমলের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো। তার চাচা উত্তর কোরিয়া থেকে পালানোর চেষ্টা করায় পুরো পরিবারকে এনে জেলে ভরা হয়। ১৩ বছর বয়সে জানতে পারেন তার মা আর ভাই জেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা করছে। তিনি সেটা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। তখন তার মা আর ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
একসময় তিনি পালিয়ে আসেন বিদ্যুতের কাঁটাতারে মরে পড়ে থাকা আরেক ব্যক্তির ওপর দিয়ে হেঁটে। এরপর পালিয়ে চীন হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করেন। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথেও দেখা করেন। জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে তদন্তে তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৪ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া শিনকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সেখানে ভিডিওতে তার বাবাকে বলতে দেখা যায়, শিনের দেওয়া সব তথ্যই মিথ্যা। শিন দং হিউক আসলে ক্যাম্প ১৪-এ ছিলেন না। তার মা আর ভাই একটা খুনের আসামী ছিলেন, যার কারণে উত্তর কোরিয়ার আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হয়েছে। ওই ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, উত্তর কোরিয়া থেকে যেসব ডিফেক্টররা পালিয়ে যান, তারা আসলে বিভিন্ন অপরাধের আসামী। তাদের কথার ওপর ভিত্তি করে আমেরিকা ও জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়া নিয়ে তাদের নীতিমালা তৈরি করে; এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
শিন দং হিউক দাবি করেন কারাগারে তাকে নির্যাতন করে ডান হাতের মধ্যমা কেটে ফেলা হয়। কিন্তু ওই ডকুমেন্টারিতে তার এক কয়লার খনির সহকর্মী জানান, এটা খনিতে কাজ করতে গিয়ে এক দুর্ঘটনার কারণে হয়। শিনের বিরুদ্ধে সহকর্মীদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস চুরির অভিযোগ করা হয়। এমনকি ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগও করা হয়।
শিনের বিরুদ্ধে ডকুমেন্টারিতে দেওয়া সব তথ্য সত্য কিনা তা যাচাই করে দেখার সুযোগ না থাকলেও তিনি যে তার অতীত জীবন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তার বাবাকে দেখে উত্তর কোরিয়ার আরেক ডিফেক্টর চিনতে পারেন। তিনি জানান, তারা আসলে ক্যাম্প-১৪ তে নয়, বরং ক্যাম্প-১৮ প্রিজন ক্যাম্পে ছিলেন। ক্যাম্প-১৮ পুলিশ বাহিনীর দ্বারাই পরিচালিত হতো। এখানে আলাদা কোনো বাহিনী ছিল না। তার মা আর ভাইকে খুনের আসামী হিসাবেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
শিনের গল্প শুনে অনেক ডিফেক্টর তাকে শুরু থেকেই অবিশ্বাস করে আসছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি কাঁটাতারে যে ব্যক্তির আটকা পড়ার কথা বলছিলেন, ওই লোক আসলে এক খনির দুর্ঘটনায় মারা যায়। শিন আদৌ ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। তাকে হয়তো ক্যাম্প থেকেই মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দেশ থেকে পালিয়ে তিনি এমন গল্প তৈরি করেছেন।
ওই ডকুমেন্টারি প্রকাশ হওয়ার পর তিনি প্রচারের আড়ালে চলে যান। তিনি তার বইয়ের লেখকের মাধ্যমে জানান, তার গল্পের বেশ কিছু অংশ পরিবর্তন করছেন। তার মিথ্যা তথ্য দেওয়ার বিষয় স্বীকার করে নেন।
উত্তর কোরিয়ার আরেক তারকা ডিফেক্টর ইওনমি পার্ক। তার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেখানে তিনি উত্তর কোরিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেন। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে নিয়মিতই সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন। জো রোগান, জর্ডান পিটারসনের পডকাস্টেও ডাক পড়ে তার। উত্তর কোরিয়ার জীবন ও সেখান থেকে পালিয়ে আসার গল্প নিয়ে ‘ইন অর্ডার টু লিভ’ নামে একটি বইও লিখেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত করে বলেন। এমনকি তার অতীত জীবন সম্পর্কে দেওয়া বিভিন্ন সময়ের তথ্যের মধ্যেও গড়মিল রয়েছে।
তিনি ২০০৭ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে তার মায়ের সাথে পালিয়ে আসেন। তার বইয়ে ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, তার ছোটবেলা কেটেছে অনেক দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার এক টিভি শো নাউ অন মাই ওয়ে টু মিট ইউ এর আর্কাইভ ঘাঁটলে দেখা যায় তার পরিবারের অনেক ছবি, যেখানে তাদেরকে বিদেশ থেকে আমদানি করা দামি দামি জামা-কাপড়, হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করতে। তারা ধনী পরিবারের না হলে উত্তর কোরিয়ায় এমন জীবনযাপন করা সম্ভব ছিল না।
তিনি দাবি করেন, তার যখন নয় বছর বয়স, তখন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মাকে উত্তর কোরিয়ার হাইস্যান শহরের এক স্টেডিয়ামে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে উত্তর কোরিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু হাইস্যান শহর থেকে পালিয়ে আসা অন্য ডিফেক্টরদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো শহরের বাইরে, বেশিরভাগ সময় বিমানবন্দরে। কিন্তু স্টেডিয়াম বা রাস্তায় কখনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি। তার যখন নয় বছর, তখন ছিল ২০০২ সাল। কিন্তু কেউই ২০০০ পরবর্তী সময়ে এমন জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা মনে করতে পারেন না। সর্বশেষ তারা মনে করতে পারেন ১৯৯৯ সালে ১০-১১ জনকে একসাথে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা।
এমনকি মৃত্যুদণ্ডের কারণ নিয়েও একেক সময় একেক তথ্য দিয়েছেন। কখনো বলেছেন, তিনি হলিউডের জেমস বন্ডের সিনেমা দেখার কারণে শাস্তি পেয়েছেন; কখনো বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রামা দেখার কারণে। কিন্তু অন্যান্য ডিফেক্টররা জানিয়েছেন, হাইস্যানে সে সময়ে ড্রামা বা হলিউড সিনেমা দেখার জন্য ৩-৭ বছরের কারাদণ্ড হয়ে থাকতে পারে, মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটা সত্য নয়।
তার বাবা ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি চোরাচালানের ব্যবসা করতেন। ২০০৩ সালে তার কারাদণ্ড হয়। কিন্তু কত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল, তা নিয়ে মা-মেয়ের তথ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। পার্ক বলেন, তার বাবার ১৭-১৮ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তার মা বলেন, শুরুতে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে সেটা ১০ বছরে নিয়ে যাওয়া হয়।
পার্কের মা’ও অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকায় তাকেও বিভিন্ন সময় জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়। তাকেও একসময় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পার্ক বলেন ওই সময়টায় তাকে ও তার বোনকে না খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু তার মা এক দক্ষিণ কোরিয়ার ওই টিভি শোতে বলেন, তাদেরকে এতটা খারাপ অবস্থায় থাকতে হয়নি। তারা কখনো না খেয়ে থাকেননি। পার্ক অবশ্য দাবি করেন, তার ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে অনেক সময় সাংবাদিকদের ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। সাংবাদিকদের সব কথা যাচাই করাও তার জন্য সম্ভবপর ছিল না।
শুধু পার্ক বা শিনই নন, এমন অভিযোগ আরো ডিফেক্টরদের বিরুদ্ধে আছে। ২০০৪ সালে লি সুন ওক নামের আরেক ডিফেক্টর যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সামনে উত্তর কোরিয়ার এক রাজনৈতিক কারাগার সম্পর্কে বিবৃতি দেন। তিনি দাবি করেন, সেই কারাগারে খ্রিষ্টান বন্দীদের গরম গলিত লোহার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু লিয়ের সাক্ষ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন সিউলে থাকা উত্তর কোরিয়ার ডিফেক্টর এসোসিয়েশনের তখনকার প্রধান চ্যাং ইন সুক। তিনি বলেন, লি কখনোই রাজনৈতিক বন্দী ব্যক্তি ছিলেন না। অন্যান্য সাবেক উত্তর কোরিয়ার নাগরিকও একমত হন যে লিয়ের বক্তব্য সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।
একইভাবে ২০০৪ সালে আমেরিকান কংগ্রেসকে আরেক ডিফেক্টর কুওন হিউক বলেন, তিনি বেইজিংয়ে থাকা উত্তর কোরিয়ার অ্যাম্বেসিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করতেন। তিনি দেখেছেন রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর উত্তর কোরিয়া বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালায়। তার বক্তব্য ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় উত্তর কোরিয়া মানবাধিকার রক্ষা আইন পাস করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই বছরে বিবিসি ডকুমেন্টারিতে তিনি পুনরায় বক্তব্যগুলো পেশ করেন। তখন দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইওনহ্যাপ সন্দেহ প্রকাশ করে তার আসলেই গোপন তথ্য পাওয়ার মতো অনুমতি ছিল কিনা। এর কয়েক বছর পর কুওন জনসম্মুখের আড়ালে চলে যান।
এটা সত্য উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের সাথে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হয়। কিন্তু একইসাথে এটাও সত্য যে, তারা অনেক কিছু অতিরঞ্জিত করে বলেন। শুধুমাত্র তাদের বক্তব্যকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
তাহলে তারা ভুল তথ্য কেন দেন? এর পেছনে আছে ব্যবসা, প্রোপাগান্ডা আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করে নেওয়া। উত্তর কোরিয়ার শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিনিময়ে তাদেরকে পারিশ্রমিক দেওয়া অনেক বছর ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। নব্বই দশকের শেষের দিকে এর অঙ্ক ছিল ঘণ্টায় ৩০ মার্কিন ডলার। এগুলো সাধারণত দেওয়া হতো তাদের যাতায়াত আর খাওয়ার খরচের জন্য।
২০১৪ সালে তাদের পারিশ্রমিক গিয়ে দাঁড়ায় ঘণ্টায় ২০০ মার্কিন ডলার। তাদের পারিশ্রমিক তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে ৫০-৫০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। পারিশ্রমিকের এমন চর্চার কারণে মুখরোচক খবরের চাহিদা বাড়তে থাকে। ডিফেক্টরদের গল্প যত আলাদা, বেদনাদায়ক বা আবেগপ্রবণতার সাথে প্রকাশ করা যাবে তত তাদের ফি বেশি হবে।
ডিফেক্টররাও জানেন তাদের প্রশ্নকর্তারা কেমন তথ্য শুনতে চান। জাতিসংঘ, কংগ্রেস কিংবা পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় তাদের সাধারণ কিছুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তারা কেন উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করে এসেছেন? সেখানকার জীবনযাত্রা কতটা সংগ্রামের? ২০১০ এর পর থেকে পালিয়ে আসা তরুণ ডিফেক্টরদের মর্মস্পর্শী, আবেগী আর নাটকীয় গল্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
মিডিয়ার চাহিদাই থাকে এমন গল্প বেশি করে শোনানোর। অনেক ডিফেক্টরকেই চাপ দেওয়া হয় অতিরঞ্জিত করে গল্প শোনানোর জন্য। দক্ষিণ কোরিয়ার নাউ অন মাই ওয়ে টু মিট ইউ টিভি শোতে মাসে চারটি করে এপিসোড প্রচার করা হতো। প্রতিদিন দুটি করে এপিসোডের শ্যুটিং করা হতো। এর জন্য ডিফেক্টরদের দেওয়া হতো ২,০০০ মার্কিন ডলার। তারা অর্থের জন্য কিংবা অনুষ্ঠানের প্রযোজকদের চাপে তাদের দেওয়া স্ক্রিপ্টের মতো করে গল্প বলতেন। তারা উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে অনেক তথ্যই দিতেন, যা আসলে সত্য ছিল না। এগুলো নিয়ে অন্য ডিফেক্টররাও ক্ষিপ্ত ছিলেন।
অনেক সংস্থা উত্তর কোরিয়া বিরোধী মনোভাব প্রচার করার জন্য ডিফেক্টরদের স্পন্সর করে থাকে। ইওনমি পার্ককে দক্ষিণ কোরিয়ার ডানপন্থী সংস্থা ফ্রিডম ফ্যাক্টরি ও আমেরিকান আরেক এনজিও অ্যাটলাস নেটওয়ার্ক স্পন্সর করে জনসম্মুখে তার গল্প বলার জন্য। এসব সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা ডিফেক্টরদের ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করছে। ডিফেক্টররা অভিযোগ করেন, দক্ষিণ কোরিয়া আর আমেরিকা, উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে দেশটি সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে জনসাধারণের মনে।
তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের অপহরণ করে নিয়ে আসার। নিয়ম অনুযায়ী ডিফেক্টররা দক্ষিণ কোরিয়ার ভূখণ্ডে আসলে তাদের পরিচয় যাচাই করার জন্য এক সপ্তাহ থেকে এক মাস জিজ্ঞাসাবাদ করে এনএসআই। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত তিন মাসের বেশি যারা থাকে, তাদেরকেই গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা হয় উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার করার জন্য। তাদের বদ্ধ ঘরে নির্যাতন করতে করতে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় যে, তারা তখন গোয়েন্দাদের কথা মতোই সব মেনে চলে।
২০১৬ সালে চীনে এক রেস্টুরেন্টে কাজ করা ১২ জন উত্তর কোরীয় তরুণীকে ওই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের মাধ্যমে কৌশলে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে আসে এনএসআই। এটা নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই ১২ জন স্বেচ্ছায়ই দক্ষিণ কোরিয়ায় এসেছেন। এসব অপহরণ করে আনা ডিফেক্টরদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়া। পুরো বিষয়েই আসলে এক তরফা উত্তর কোরিয়া একা খলনায়ক নয়। এখানে ডিফেক্টররা এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা মিডিয়া সব পক্ষই নিজেদের মতো করে সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
উত্তর কোরিয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ডিফেক্টররা যেভাবে খ্যাতি, অর্থ কিংবা চাপে পড়ে যেভাবে অতিরঞ্জিত গল্প বলে যাচ্ছেন, তাতে যারা প্রকৃতপক্ষেই নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে এসেছেন, তাদের বক্তব্যও বিশ্বাস করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠবে। তারা নিজেদের সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ঘটনা গোপন করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্যও দেন। তাই শুধুমাত্র তাদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে উত্তর কোরিয়া বিরোধী কোনো অবস্থান নেওয়া হবে বিরাট ভুল।