আগেকার দিনে বিশ্বভ্রমণের জন্য যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল স্থলপথে ঘোড়া এবং জলপথে জাহাজ। ধীরগতির এই বাহনে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করতে সময় লেগে যেত মাসের পর মাস। যাত্রাপথের এই সময় অনেক ক্ষেত্রে পৌঁছে যেত বছরে। বর্তমান আধুনিক যুগে সব কিছুর পাশাপাশি প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে যাত্রাপথেও। দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণের সময় কমিয়ে আনার জন্য বিজ্ঞানের সবচেয়ে অভূতপূর্ব আবিষ্কার হলো আকাশপথের বিমান। বিমানে চড়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চলে যাওয়া যায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। বিমান চলাচলের জন্য প্রত্যেক দেশেই রয়েছে একাধিক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আর এরই মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরগুলোর একটি নির্মিত হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর তুরস্কের ইস্তানবুলে।
কত নামেই না ডাকা যায় ইস্তানবুলকে। ইউরোপের প্রবেশদ্বার, আন্তঃমহাদেশীয় শহর, ইউরোপের বৃহত্তম শহর, রোমান, বাইজেন্টাইন এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইত্যাদি। কী নেই ইস্তানবুলে! একপাশে ইউরোপ, অপরপাশে এশিয়া। মাঝখানে কল কল রব তুলে বয়ে চলেছে বসফরাস প্রণালী। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্যে ঘেরা এই শহরটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন এবং প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। আন্তঃমহাদেশীয় শহর হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিকভাবে এ শহর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ইস্তানবুল শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত পর্যটক ছুটে আসেন।
ব্যস্ততম এই শহরেই নির্মিত হচ্ছে চমৎকার এই বিমানবন্দরটি। গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইস্তানবুলকে অনেকেই ট্রানজিট বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। দিন দিন এই বিমানবন্দরের কর্মব্যস্ততা বাড়ছে, সাথে বাড়ছে যাত্রীদের আনাগোনাও। ইস্তানবুলের এই বিশাল নতুন বিমানবন্দর তৈরি করতে প্রথম ধাপে খরচ হয়েছে ৫১০ কোটি ডলারের বেশি। ৭,৬৫,০০,০০০ বর্গ মিটারের এই বিমানবন্দরটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ছিল তুরস্কের প্রজাতন্ত্র দিবস। সেদিন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান ১৭ জন আমন্ত্রিত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের নিয়ে এই বিমানবন্দরটি উদ্বোধন করেন। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানী আঙ্কারার উদ্দেশ্যে টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি বিমান টিকে২১২৪ উড্ডয়নের মাধ্যমে এই বিমানবন্দর থেকে সর্বপ্রথম বিমান উড়াল দেয়।
এই বিমানবন্দর থেকে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল শুরু করেছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ও-৭ মোটরওয়ে ব্যবহার করে আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে সব সরঞ্জাম নতুন বিমানবন্দরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরটি সম্পূর্ণরূপে চালু হয়ে গেলে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হবে এবং আতাতুর্ক বিমানবন্দরের আইএটিএ কোড আইএসটি (IST) নতুন বিমানবন্দরে সরিয়ে আনা হবে।
বর্তমানে এই বিমানবন্দরের যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা রয়েছে বাৎসরিক ১৫ কোটি। পুরোদমে চালু হয়ে গেলে ২০২৫ সালে এর যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ কোটিতে। তখন যাত্রী পরিবহন ক্ষমতার দিক দিয়ে এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এটি সাবিহা গোকচেন বিমানবন্দর ও আতাতুর্ক বিমানবন্দরের পর ইস্তানবুলের তৃতীয় বিমানবন্দর এবং একে ইস্তানবুলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বিমানবন্দরটি ইস্তানবুল শহরের ইউরোপীয় অংশের অটালকা-গক্তির্ক-আরনাভুতকি অঞ্চলে অবস্থিত। তুরস্কের বিখ্যাত তাকসিম স্কয়ার থেকে এর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। বর্তমানে ১১০টি দেশের প্রায় ৩৫০টি গন্তব্যস্থলে বিমান চলাচল করছে। বিমানবন্দরটিতে মোট চারটি রানওয়ে রয়েছে। যার মধ্যে ৩টি চালু হয়েছে বাকি ১ শীঘ্রই কার্যকর হবে। এছাড়া ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ২টি রানওয়ে চালু হবে। সবমিলিয়ে এই বিমানবন্দরের রানওয়ে সংখ্যা হবে ৬টি।
এ বিমানবন্দরের পরিবেশগত সুবিধা, নিরাপত্তা এবং সৌন্দর্য যাত্রীদেরকে মুগ্ধ না করে পারে না। প্রত্যেকটি অংশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি করে সাজানো। অসাধারণ কারুশিল্প, ঝলমলে রঙিন আলো এবং কর্মীদের বিনয়ী ব্যবহার যাত্রীদের ভুলিয়ে দিচ্ছে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি। আন্তর্জাতিকভাবে তুরস্ক একটি জনপ্রিয় মাইগ্রেশন পয়েন্ট হওয়ায় এই বিমানবন্দর দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে এ বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া সত্ত্বেও তিন মহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
অসাধারণ ডিজাইনের মাধ্যমে বিমানবন্দরটির কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে, যা যেকোনো যাত্রীকে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করবে। ৫,০০০ বর্গ মিটার আয়তনের এই কন্ট্রোল টাওয়ারটি প্রায় ৯০ মিটার উঁচু। মূলত টিউলিপ ফুলের আদলে ব্যতিক্রমধর্মী এই দৃষ্টিনন্দন আইকনটি নির্মিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ইস্তানবুল বিমানবন্দরটি ইতোমধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া, পশ্চিম এবং পূর্বকে সংযুক্ত করে একটি বড় বিমানকেন্দ্র, এবং বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে।
বিমানবন্দরের ভেতরে থাকবে একাধিক বিলাসবহুল ও রাজকীয় সব হোটেল। তুরস্কের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির সমন্বয়ে হোটেলগুলো সাজানো হয়েছে। সেবার মানের দিক দিয়ে এ বিমানবন্দরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এখানকার গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থাকবে আধুনিক ব্যবস্থা। প্রায় ৪০ হাজার গাড়ি পার্কিং করে রাখা যাবে এর মাল্টিফ্লোর পার্কিং লটে। বিলাসবহুল এই বিমানবন্দরে রয়েছে ৪১টি বোর্ডিং পাস গেটস। এছাড়া রয়েছে ৫৬৬টি চেক ইন কান্ট্রিজ। সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় করমুক্ত শপিং কমপ্লেক্সে, যার আয়তন হবে ৫৫,০০০ বর্গ মিটার।
ইতিমধ্যে এ বিমানবন্দরের নকশা পুরস্কারও জিতেছে। ২০১৬ সালে বার্লিনে ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচারাল ফেস্টিভ্যালে ‘ফিউচার প্রজেক্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতেছে ইস্তানবুল বিমানবন্দর। মনে করা হচ্ছে, এটি হতে যাচ্ছে সবচেয়ে সাজানো গোছানো এবং অনন্য ডিজাইনের বিমানবন্দরও। ইস্তানবুলের এই বিমানবন্দরকে তুরস্কের পক্ষ থেকে গ্রিন বা সবুজ বিমানবন্দর বলা হচ্ছে। এই বিমানবন্দরে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ইস্তানবুলে এ বিশাল বিমানবন্দর তৈরি করাটা যেমন তুরস্কের কাছে খুব গর্বের বিষয়, তেমনি একে ঘিরে বেশ কিছু বিতর্কও রয়েছে। কারণ শ্রমিকেরা এখানে কাজ করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খারাপ মানের খাবারের পাশাপাশি আরও অনেক অত্যাচারও তাদের সহ্য করতে হয়েছে। ২৭ শ্রমিকের মৃত্যুও হয়েছে এই বিমানবন্দর তৈরি করতে গিয়ে, যদিও তুরস্ক সরকার এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছে।
১০ সহস্রাধিক লোক এ প্রকল্পে কাজ করেছে। তুরস্ক ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ২৫০ জন স্থপতি এবং পাঁচ শতাধিক প্রকৌশলী এই নির্মাণকাজে যুক্ত ছিলেন।
ইস্তানবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য থাকবে ২২,০০০ সিসিটিভি ক্যামেরা। এছাড়া ১০,০০০ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটিসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে। বিমানবন্দরটিতে কাজ করবে ২ লক্ষ ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এয়ার রিফুয়েলিং কিংবা এয়ার ট্রানজিটের জন্য দুবাই বিমানবন্দর এ অঞ্চলে সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক এই খাতে ভাগ বসানোর চেষ্টা করছে। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হওয়ায় তারা এয়ার রিফুয়েলিং ও এয়ার ট্রানজিট হিসেবে ইস্তানবুল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট গড়ে তুলছে।
এই এয়ারপোর্টটি শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টই নয়, এটি হতে চলেছে বিশ্বের সুন্দর এবং আকর্ষণীয় এয়ারপোর্টগুলোর মধ্যে অন্যতম। অসাধারণ নকশা, স্থাপত্যশিল্প, কারুকার্য, নিরাপত্তা এবং সেবার মান, সবকিছু মিলিয়ে এই বিমানবন্দরটি যাত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তাছাড়া ভৌগলিক অবস্থানের কারণে রয়েছে প্রকৃতির নির্মল হাওয়া এবং শহরের কোলাহল-বর্জিত নিরিবিলি পরিবেশ। এটি যেন হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, পরিবেশবান্ধব এবং যাত্রীবান্ধব বিমানবন্দর।