কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি শুনতে পান পৃথিবীতে আর দূষণ নামের কোনো শব্দ নেই, হারিয়ে গেছে গ্রিন হাউজ এফেক্টের চোখ রাঙানি। কিংবা পত্রিকা খুলে যদি দেখেন, কোথাও আর ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর নেই। কেমন হবে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুল পরিচিত গল্পটার উল্টো ঘটলে? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয় মানুষকেই। নিজেদের স্বার্থে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করে যাচ্ছি কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই৷ আমাদের আচরণ কিংবা মনোভাব যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত আশঙ্কা বদলাবে না কখনও। আশার কথা হচ্ছে, প্রকৃতিরই আরেক মহামারিতে মানুষকে তার আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করে প্রকৃতি তার চেনা রূপে ফিরছে।
কোভিড-১৯ নামে পরিচিত চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৭০টিরও বেশি দেশে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে লাখ তিনেকেরও বেশি মানুষ। একইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। দিন যত যাচ্ছে দেশ থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে, স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনীতি, ঘর-বন্দি (কোয়ারান্টাইন) থাকতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। প্রভাব পড়ছে আমাদের চির পরিচিত পরিবেশের উপরেও। এই ভাইরাস নিয়ে মানুষের মাঝে যেমন ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ডানা মেলছে নানান বিভ্রান্তিকর তথ্যও।
ভাইরাসটি প্রথম ছড়িয়েছে চীনের উহান শহরে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি বাজার থেকে। সেখানে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংস ছাড়াও জীবন্ত মুরগী, সাপ, খরগোশ, বাদুড়- এসব প্রাণী বিক্রি হতো। এর যে কোনো একটি এই ভাইরাস সংক্রমণের উৎস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মত বৈশ্বিক সমস্যা করোনাভাইরাস সংক্রমণকে প্রভাবিত করছে কি না এমন প্রশ্নে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট, হেলথ এবং গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টের অন্তর্বর্তী পরিচালক ডাঃ অ্যারন বার্নস্টেইন বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বনাঞ্চল এবং সমুদ্রের বড় এবং ছোট প্রাণীগুলি উত্তাপ থেকে বাঁচতে মেরুর দিকে এগিয়ে যায়। প্রাণীগুলো তাদের স্বভাব বদলে অন্যান্য প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করে এবং এটি রোগজীবাণুদের জন্য নতুন হোস্টে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে। বার্ণস্টেইন মনে করেন, মহামারীর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াটা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম মূল কারণ। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রাণীরা তাদের আবাসস্থল বদলাতে বাধ্য হচ্ছে৷ তার মতে, নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে প্রাণীরা খাপ খাওয়াতে গিয়ে স্থানীয় প্রাণীদের সংস্পর্শে আসছে, ছড়াচ্ছে ভাইরাস, সংক্রমিত হচ্ছে প্রাণী থেকে মানুষে।
চীনে প্রায় ৮২ হাজার জনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা পৌঁছেছে তিন হাজারে। তবে মতভেদ আছে মৃতের সঠিক সংখ্যাটি নিয়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা’র জিইওএস আর্থ সিস্টেম মডেল থেকে পাওয়া ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল উহানের কাছের একটি জায়গার স্যাটেলাইট ইমেজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ইমেজটিতে সেখানকার বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছিল। সংবাদ মাধ্যমে এর কারণ হিসেবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষদের পুড়িয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছিল। যদিও সালফার ডাই অক্সাইড সাধারণত কারখানা বা পোড়া কাঠ কয়লা থেকেই বাতাসে নির্গত হয়। নাসাও বলছে, এটি জায়গাটির বাস্তব চিত্র নয়, ইমেজটি তৈরিতে অতীত ইতিহাস এবং আবহাওয়ার বিভিন্ন অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা বা এড়াতে মানুষ তাদের প্রতিদিনের আচরণ এবং স্বভাবসুলভ কাজগুলোতে পরিবর্তন আনছে, এতে করে পরিবেশের ওপর কিছু সূক্ষ্ম প্রভাব পড়ছে।
বিভিন্ন দেশে লকডাউন অবস্থা জারির ফলে স্কুল, কলেজ, কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে সাময়িকভাবে, ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন হার কমেছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ওয়েবসাইট কার্বন ব্রিফের এক প্রতিবেদন বলছে, সম্প্রতি চীনে প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমেছে। প্রায় একই চিত্র এখন যুক্তরাষ্ট্রেরও। দেশটিতে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় পরিবহন খাতকে। স্কুল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে পড়ার ফলে মানুষ সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘর-বন্দি থাকছে, ফলে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এতে করে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গণ-পরিবহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য আরেক অভিশাপ। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের বিরাট একটি অংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। এসব মোটরযান থেকে ক্ষতিকর বস্তুকণা (কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং ওজোন) নির্গত হয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীর বরাবরই স্বল্প দূরত্বে গণ-পরিবহন ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে বাইসাইকেলের মত পরিবেশ বান্ধব যানবাহন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট ট্রান্সপোর্টেশন বিভাগের সাম্প্রতিক এক তথ্য পরিবেশবিজ্ঞানীদের সেই পরামর্শটিকেই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। তথ্য বলছে, এই মাসে (মার্চ) নিউইয়র্ক শহরে ব্রিজগুলোর উপরে বাইসাইকেল চলাচলকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এটি পরিবেশের কথা ভেবে করছে না কেউ, তবু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে চলাচলে এটাই কার্যকর যান বলে মানুষ বেছে নিচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে পরিবেশেরই উপকার করছে।
তবে পরিবেশের এই সাময়িক উপকার উদযাপনের কোনো উপলক্ষ হওয়া উচিত নয়, ইতিহাস বলছে, এমন অবস্থা কেটে যাওয়ার পর কার্বন নিঃসরণের হার তার আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময়ক্ষেপণ করেনি। তবে মহামারিটি মানুষকে তার আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করায় তার সূক্ষ্ম প্রভাব পড়ছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো পরিবেশ বাঁচানোর পদক্ষেপগুলোয়। এমন নয় যে এমন পরিস্থিতি আগে আসেনি, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হরহামেশাই ঘটছে, প্রাণহানি ঘটছে সেসবেও। কিন্তু আমরা সচেতন হইনি তবুও। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে মানুষ আবার তার নিয়মিত জীবনে ফিরবে, কার্বন নিঃসরণের নিম্নমুখী হার আবার উপরে উঠতে সময় লাগবে না, যদি না আমরা শিক্ষা নিতে পারি করোনা ভাইরাসের এই দুঃসময়টা থেকে। খুব কম সময়ের ব্যবধানে মানুষের ভেতর আমূল পরিবর্তন কতদিন স্থায়ী হবে সেটা এখন বড় প্রশ্ন? পরিবেশ সচেতন হওয়ার কিংবা পরিবেশ নিয়ে ভাবার নতুন এই সুযোগ আমরা আদৌ কাজে লাগাতে পারবো নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার অপেক্ষায় থাকবো সময়ের কাছে থাকুক এই প্রশ্ন।