পৃথিবীর সবচেয়ে দুধর্ষ অপারেশনাল ইউনিটগুলোর মধ্যে একটি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর সিল টিম সিক্স। মার্কিন সরকার যেকোনো অপারেশনের শতভাগ সফলতার জন্য এই ইউনিটকে ব্যবহার করে থাকে। জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধার, সন্ত্রাসী নেতাদের হত্যা ইত্যাদির জন্য পরিচালিত অপারেশনের ক্ষেত্রে এই ইউনিট পৃথিবীর মধ্যে সেরা। আগের পর্বে সিল টিম সিক্স প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, নামকরণের পেছনের কাহিনী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি শেষ পর্ব।
সিল টিম সিক্সে নিয়োগের ব্যাপারটিতে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। মার্কিন নৌবাহিনীর সাধারণ সিল টিমেই সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। আর সিল টিম সিক্সের মতো অভিজাত অপারেশনাল ইউনিটে জায়গা করে নেয়া কতটা কঠিন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অসংখ্য মার্কিন তরুণ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে সিল টিমের সদস্য হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে আসে, কিন্তু অধিকাংশকেই খালি হাতে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। যদি কোনো মার্কিন তরুণ নিজেকে সিল টিম সিক্সে দেখতে চায়, তবে তাকে আগে পাঁচ বছর মার্কিন নৌবাহিনীর সাধারণ অপারেশনাল সিল টিমগুলোতে ভালো দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়। ন্যূনতম পাঁচ বছর সাধারণ সিল টিমে কাজ করার আগপর্যন্ত কেউ সিল টিম সিক্সে যোগ দেয়ার টেস্টে আবেদনই করতে পারে না।
মার্কিন নৌবাহিনীর সাধারণ সিল টিমে পাঁচ বছর কাটানোর পর সিল টিম সিক্সে নিয়োগের জন্য তিন দিনের পিটি টেস্টে (PT Test) অংশগ্রহণ করতে হয়। এই টেস্টের সময় পিএসটি (Physical Screening Test) নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়। এতে শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের যে ন্যূনতম শর্তগুলো রয়েছে, তা পূরণ করতে তো হয়ই, এর পাশাপাশি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজেকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখার কাজটিও ভালোভাবে শেষ করতে হয়।
তিন দিনের শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য পিটি টেস্টে সুন্দরভাবে উত্তীর্ণ হলে এবার ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। ছয় সদস্যবিশিষ্ট ইন্টারভিউ প্যানেলের প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারলে সিল টিম সিক্সের স্বপ্ন দেখা যুবককে ছয় থেকে আট মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ‘গ্রিন টিম’এ পাঠানো হয়। গ্রিন টিম হচ্ছে আগ্রহীদের মূল্যায়ন করার জন্য একটি বিশেষ ইউনিট, যারা তিন দিনের পিটি টেস্ট ও ইন্টারভিউ পার করে আসা মার্কিন যুবকদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়। এর পাশাপাশি একজন সম্ভাব্য সিল সিক্স টিমের সদস্য হিসেবে ‘কিল হাউজ’-এ দীর্ঘ সময় রাখা হয়, শত্রুপক্ষের খুব কাছাকাছি যুদ্ধ করার কৌশল (Close Quarters Battle) রপ্ত করাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সিল টিম সিক্সে জায়গা করে নিতে সর্বশেষ প্রশিক্ষণেও অধিকাংশ তরুণকে বাদ পড়তে হয়। কারণ গ্রিন টিম যেসব প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে সেগুলো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, ভয়াবহ রকমের শারীরিক ক্লান্তি সহ্য করতে হয় প্রশিক্ষণরত যুবকদের। মার্কিন নৌবাহিনীর সিল টিমে পাঁচ বছর পার করার পর পিটি টেস্ট উৎরে আসা যুবকদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ তরুণকে গ্রিন টিমের প্রশিক্ষণ থেকে বাদ দেয়া হয়! একটু চিন্তা করুন, যে মার্কিন যুবক নৌবাহিনীর সাধারণ সিল টিমে পাঁচ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছে, শরীর গঠন করেছে, এরপর সিল টিম সিক্সে যোগ দেয়ার জন্য পিটি টেস্টের মতো তিন দিনের শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাকেও গ্রিন টিমের প্রশিক্ষণে বাদ পড়তে হচ্ছে। তাহলে গ্রিন টিমের প্রশিক্ষণ ঠিক কতটা ভয়াবহ রকমের কষ্টসাধ্য! গ্রিন টিম থেকে বাদ পড়লে একজন মার্কিন নৌসেনাকে আবার তার আগের কর্মস্থল তথা সাধারণ সিল টিমে ফিরে যেতে হয়। পরবর্তীতে আবার সে সিল টিম সিক্সে নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারে।
সিল টিম সিক্সের আত্মপ্রকাশের মূল কারণ ছিল যেকোনো বৈশ্বিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম (যেমন জিম্মি কিংবা অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার, যেকোনো গণবিরোধী বোমাহামলা) রুখে দেয়া। ১৯৮১ সালের পর থেকে শুরু করে ২০০১ সালের আগপর্যন্ত সিল টিম সিক্সের খুব বেশি ব্যস্ততা ছিল না। ২০০১ সালে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা বিশ্বজুড়ে ওয়ার অন টেরর শুরু করে। এর ফলে সিল টিম সিক্সের অপারেশনের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি করে বাড়তে শুরু করে। একজন সাবেক সিল টিম সিক্স অপারেটরের দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে সিল টিম সিক্স ইউনিট হাজারেরও বেশি অপারেশন চালিয়েছে।
সিল টিম সিক্সের বড় শক্তি হচ্ছে, এটি যেকোনো সামরিক অপারেশন পরিচালনার আগে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরিচালনা করার কারণে তাদের সাফল্যের হারও অনেক বেশি, ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম। আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে আল-কায়েদা ও তালেবানের বিভিন্ন নেতাকে হত্যা করার জন্য তারা আগে থেকেই তথ্য সংগ্রহ করে রাখতো। সেসব তথ্যের উপর ভিত্তি রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সেসব নেতা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যার মাধ্যমে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিআইএ-র সাথে তাদের যোগসূত্র রয়েছে।
দায়বদ্ধতা এড়ানোর দিক থেকে সিল টিম সিক্সের বড় ধরনের সুবিধা রয়েছে। সিল টিম সিক্স সরাসরি জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের (JSOC) নির্দেশে পরিচালিত হয়। ওয়ার অন টেররের সময় সিল টিম সিক্সের বিরুদ্ধে অনেকবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হয়েছে। আফগানিস্তানের অনেক সাধারণ মানুষ সিল টিম সিক্সের বিরুদ্ধে অত্যধিক বেসামরিক মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলেছে। এসব অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পড়েছিল জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের ঘাড়ে, যারা নিজেরাই সিল টিম সিক্স পরিচালনা করছে। স্বভাবতই এসব তদন্তে ভয়ংকর অপরাধগুলো গণনায় আনা হয়নি। তাছাড়া সিল টিম সিক্সের অপারেশন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ক্লাসিফাইড করে রাখা হয়, বাইরের কাউকে অপারেশন সম্পর্কে জানতে দেয়া হয় না। এজন্য সিল টিম সিক্সের পক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধ সহজেই এড়ানো সম্ভব।
সিল টিম সিক্সের সবচেয়ে বিখ্যাত অপারেশন, যেটি বিশ্বমিডিয়া কাভার করতে পেরেছে, সেটি সম্ভবত অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে সিল টিম সিক্স বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে, নিজেদের সামরিক সক্ষমতার জন্য বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ধারণা করা হয়, বিন লাদেনকে হত্যার সেই মিশনে ২২/২৩ সিল টিম সিক্সের সদস্য অংশ নিয়েছিলেন। লাদের হত্যার অপারেশন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে জিম্মি হওয়া মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারে কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকা ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করে সিল টিম সিক্স নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
নৌ কমান্ডার রিচার্ড মার্সিনকো সিল টিম সিক্সের মতো দুধর্ষ অপারেশনাল ইউনিট প্রতিষ্ঠা করলেও পরবর্তীতে ঘুষ নেয়া ও কারচুপির অভিযোগে তদন্তের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে বিচারের পর তাকে দুই বছরের জেল খাটার শাস্তিও প্রদান করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ১৯৯০ সালের পর থেকে বিভিন্ন কারণে সিল টিম সিক্সের নাম বদলে দিয়ে নেভাল স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ (Naval Special Warfare DEVelopment GRoUp বা DEVGRU) করা হয়, যাদের কাজ হলো বিভিন্ন অপারেশনের জন্য সামরিক কৌশল কিংবা মারণাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানো। কিন্তু সিল টিম সিক্স সম্পর্কে সবকিছু ক্লাসিফাইড করা থাকায় এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এখনও এই অপারেশনাল ইউনিটকে সিল টিম সিক্স হিসেবেই আখ্যায়িত করে।
সিল টিম সিক্সের কার্যক্রম গোপন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। হোয়াইট হাউস কিংবা মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কখনোই সিল টিম সিক্স সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেনি। এজন্য এখন পর্যন্ত হাজারের উপরে অপারেশন চালালেও অল্প কিছু অপারেশন সম্পর্কেই আমরা মিডিয়ার কাছ থেকে জানতে পারি। এখন পর্যন্ত মার্কিন অভিজাত সামরিক অপারেশনাল ইউনিটগুলো মধ্যে সিল টিম সিক্সই সবচেয়ে দুধর্ষ ইউনিট হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছে। আমেরিকার কাছে এই ইউনিটের প্রত্যাশা অনেক, এবং সিল টিম সিক্স সেসব প্রত্যাশার ষোল আনা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে, জিম্মি উদ্ধারে বা চিহ্নিত শত্রুদের হত্যা করতে শুধু আমেরিকা কেন, যেকোনো দেশই এরকম একটি ভয়াবহ অপারেশনাল ইউনিট রাখতে চাইবে।