পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও ইউরোপের আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল অনেকটাই কৃষিনির্ভর। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আজ পুরো বিশ্বের কাছে যারা অনুকরণীয়, শিল্প বিপ্লবের আগেও তাদের জ্ঞানচর্চার অবস্থা এতটা উন্নত ছিল না।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর পুরো ইউরোপের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়, যার ফল আজকের আধুনিক ইউরোপ। মধ্যযুগেও ইউরোপে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিপ্লবের শুরুটা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পরেই।
বর্তমান ইউরোপ পুরো বিশ্বের শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এমন আগ্রহের কারণটাও অত্যন্ত পরিষ্কার; মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত আবাসন ব্যবস্থা এবং সেই সাথে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর শত বছরের সুনাম সহজেই আকৃষ্ট করে যেকোনো শিক্ষার্থীকে।
সুইজারল্যান্ডের এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট লি রোজি (Institute Le Rosey)। লি রোজিকে বলা হয় ‘স্কুল অফ কিংস (School of Kings)’ অর্থাৎ রাজাদের স্কুল। এমন বিশেষণের পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিকতাও রয়েছে। এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তালিকায় চোখ বুলিয়েই দেখতে পাবেন বিভিন্ন দেশের রাজপুত্র-রাজকন্যাদের নাম। এছাড়াও বিশ্বের সর্বাধিক ব্যয়বহুল স্কুল এটি। এই স্কুলের বার্ষিক টিউশন ফি এতটাই বেশি যা বহন করা অনেক বিত্তবানের পক্ষেও অসম্ভব, বাংলাদেশের হিসেবে বছরে যার পরিমাণ প্রায় ৯৬ লক্ষ ১৮ হাজার টাকা!
যদিও লি রোজি এই গ্রহের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুল, তবে বিশ্বখ্যাতির জন্য এটিই একমাত্র কারণ নয়। এই স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস, ভর্তি প্রক্রিয়াসহ সকল কার্যক্রমেই রয়েছে স্বাতন্ত্র্য, যার ফলে লি রোজি যেমন স্বনামধন্য, তেমনই বেশ আলোচিতও বটে।
শুরুর কথা
পল কার্নাল উত্তর সুইজারল্যান্ডে তার জন্মস্থান জুরা ছেড়ে চলে আসলেন রোলে শহরে। জেনেভা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সুইজারল্যান্ডের এই শহরে রয়েছে চতুর্দশ শতকে নির্মিত শ্যাতিও দ্যো রোজি নামের একটি ঐতিহাসিক দুর্গ।
কার্নাল ছিলেন একজন আগাগোড়া স্বপ্নবাজ মানুষ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুক্ত একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। সবসময় ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছে ছিল তার। তিনি চিন্তা করলেন ব্যক্তিমালিকানায় একটি স্কুল তৈরি করবেন। কিন্তু স্কুলে বিনিয়োগ করার মতো খুব বেশি আর্থিক সামর্থ্য তার ছিল না। এমন সময় শ্যাতিও রোজির একটি অংশ ভাড়া দেওয়া হবে শুনে মালিকের সাথে যোগাযোগ করেন, পেয়েও যান। এরপরই ১৮৮০ সালে শ্যাতিও দ্যো রোজির একটি অংশে গড়ে তোলেন, সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো প্রাইভেট স্কুল ইন্সটিটিউট লি রোজি।
অল্প জায়গায় স্কুল চালাতে বেশ অসুবিধায় হচ্ছিল, তাই কয়েক বছর পরেই শ্যাতিও দ্যো রোজিসহ প্রায় ২০ হেক্টর জমি কিনে নেন স্কুলের জন্য। ফলে ভীষণভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি, তবে থেমে যাননি। ঋণের বোঝা সামলে নিয়ে স্কুল চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯১২ সাল, পল কার্নালের ছেলে হেনরি কার্নাল স্কুলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হেনরির অসাধারণ দক্ষতা ও বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা লি রোজিকে বিখ্যাত করে তোলে। সুইজারল্যান্ড ছাড়িয়ে পাশের দেশগুলোতেও এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৬ সালে হেনরি কার্নাল লি রোজির জন্য সুইজারল্যান্ডের আরেক শহর জিস্টাডে নতুন একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলেন। জিস্টাড ক্যাম্পাসটি তৈরি করা হয় শুধুমাত্র শীতকালের জন্য। বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের সময়টায় স্কুলের প্রয়োজনীয় সবকিছু শীতকালীন ক্যাম্পাস স্থানান্তর করা হয়। শুরুর দিকে বছরে ৩ মাসের জন্য রিসোর্ট ভাড়া নিয়ে শীতকালীন ক্যাম্পাসটি করা হলেও বর্তমানে লি রোজির নিজস্ব মালিকানায় স্থায়ীভাবেই শীতকালীন ক্যাম্পাস রয়েছে।
লি রোজির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু থেকেই ছিল ভিন্ন। গতানুগতিক চাপ প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বাধ্য করা হতো না। পড়াশোনার সাথে খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, শীতকালীন ক্যাম্পাসে তিন মাস শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন, পর্বতারোহন, হাইকিং, ব্যাডমিন্টন, ড্রয়িং, গলফ, হকি, অশ্বচালনা, সাঁতার, ফুটবলসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তৎকালে লি রোজিকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করে তোলে।
আজকের লি রোজি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুল এমনি এমনি হয়নি। শুরু থেকেই স্কুলটির প্রায় সব শিক্ষার্থীই ছিল অভিজাত পরিবার থেকে আসা। ইরানের শাহ, মোনাকোর প্রিন্স রেইনার, বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় অ্যালবার্ট, করিম আগা খান, যুগোস্লাভিয়ার প্রিন্স আলেক্সান্ডার, গ্রিসের রাজকন্যা পিয়া গেটি, মিশরের রাজা দ্বিতীয় ফুয়াদও পড়াশোনা করেছেন এখানে।
প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম
রোজেনদের একজন হতে চাইলে অবশ্যই প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নজর রাখতে হবে। রোজেন কী? লি রোজির ছাত্র-ছাত্রীদের বলা হয় রোজেন।
ওয়েবসাইট থেকে ভর্তি ফর্মে আবেদনের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেক প্রার্থীকে তাদের ক্যাম্পাসে ডাকা হয়। এতে করে ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি চমৎকার ক্যাম্পাসটিও ঘুরে দেখার সুযোগ মেলে।
লি রোজির প্রথম ধাপে রয়েছে প্রাথমিক দ্বি-ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম। দ্বি-ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম কী? এই কোর্সে ৮-১১ বছর বয়সীদের ভর্তি করা হয়, এবং তাদের শেখানো হয় ফরাসি ও ইংরেজি ভাষা। প্রথম ধাপের শিক্ষা কার্যক্রম এই দুটি ভাষাতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম কোর্স শেষ হবার পর শুরু হয় মাধ্যমিক কোর্স।
মাধ্যমিকে আরেকটি ভাষা যুক্ত করা হয়। আবার কোনো শিক্ষার্থী যদি লি রোজিতে প্রথম ধাপটি শেষ না করে সরাসরি মাধ্যমিক কোর্সে ভর্তি হতে চায়, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষা বুঝতে হবে। সেই সাথে বয়স হতে হবে ১২-১৫ বছর। লি রোজির শেষ ধাপে রয়েছে ফরাসি ও আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমানুসারে বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা করার সুযোগ।
যদিও ৭০টি ভিন্ন জাতীয়তার শিক্ষার্থী লি রোজির ক্লাসরুমে শিক্ষাগ্রহণ করে, কিন্তু ভাষা শিখে উঠতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কেননা এখানকার প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর জন্য বিষয়ভিত্তিক একজন করে শিক্ষক থাকেন, যারা নিরলসভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সময় দিয়ে থাকেন।
স্কুলটির শিক্ষা-কার্যক্রম এতটাই মানসম্মত যে, এখান থেকে ডিপ্লোমা শেষে শতকরা ৩০ ভাগ রোজেন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে সেরা ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়।
পল এন্ড হেনরি কার্নাল হল
বর্তমানে লি রোজির পৃথক তিনটি ক্যাম্পাস রয়েছে। প্রথম এবং মূল ক্যাম্পাসটি সুইজারল্যান্ডের রোলে শহরে। মূল ক্যাম্পাসের পাশেই রয়েছে লা কোম্বে। এটি ১৯৭৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েদের ক্যাম্পাস। আর তৃতীয় ক্যাম্পাসটি জিস্টাডে, শীতকালীন তিন মাসের জন্য। মূলত সুইজারল্যান্ডের রোলে শহরকেই লি রোজির শেকড় বলা যেতে পারে। তাই স্কুলটির গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনাও গড়ে উঠেছে এই শহরেই।
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুল লি রোজি, অথচ এর ক্যাম্পাস নান্দনিক হবে না তা কী করে হয়! ২০১৪ সালে স্কুলটি নির্মাণ করে পল এন্ড হেনরি কার্নাল হল। এটি যেন লি রোজির জ্ঞানচর্চা ও আভিজাত্যের নিদর্শন।
পল এন্ড হেনরি কার্নাল হলে রয়েছে মোট ৩টি অংশ। একটি অংশ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য, যার নাম কালচার। এখানে ৯০০-১,০০০ আসনের একটি কনসার্ট হল রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে পারফর্ম করে থাকে। এখানে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন কনফারেন্সের। সেই সাথে বিশ্বের নামি-দামি মিউজিক আর্টিস্টরাও এখানে আসেন, পারফর্ম করেন। ফলে কার্নাল হলের কালচার অংশে শিক্ষার্থীরা তাদের সাংস্কৃতিক মেধাচর্চার পাশাপাশি বৈশ্বিক মিশ্র সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারে।
আরেকটি অংশ শিল্পকলার জন্য। হলের এই অংশটির নাম আর্টস। এখানে রয়েছে একটি বৃহৎ মিউজিক্যাল স্টুডিও, যেখানে সঙ্গীতচর্চার করার প্রচুর সরঞ্জাম রয়েছে। ড্রয়িং, থ্রিডি পেইন্টিংসহ নানা রকমের সৃষ্টিশীল কাজের জন্য রয়েছে আলাদা অনেক স্টুডিও যেন পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
হলটির সর্বশেষ অংশকে বলা হয় কমিউনিকেশন সেক্টর, যেখানে যথাযথ নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা জানা-অজানা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। এতে করে ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতির শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক বন্ধন গড়ে তোলে, যা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দিক থেকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যই ইন্সটিটিউট লি রোজিকে গত ১৪০ বছর ধরে এক অনন্য উচ্চতায় ধরে রাখতে পেরেছে।যদিও স্কুলটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তবে তাদের শিক্ষা-কার্যক্রম নিঃসন্দেহে পৃথিবীর যেকোনো দেশ বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয়। লি রোজির মতো ভিন্নতা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকলে হয়তো শিক্ষার্থীরা কখনোই স্কুলবিমুখ হতো না, বরং আনন্দ-উৎসাহের সাথে নিজেদের যোগ্যতার সবটুকু প্রমাণ করতে পারত।