ক্যাপ্টেন মুরাখতিনের ভাগ্য: রুশ–সিরীয়–হিজবুল্লাহ জোট ও তুর্কি–তুর্কমেন জোটের মধ্যবর্তী প্রতিযোগিতা
বিধ্বস্ত ‘সু–২৪এম’ থেকে অবতরণের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভ ও ক্যাপ্টেন মুরাখতিন দুজনেই ‘সুরিয়ে তুর্কমেন ওর্দুসু’ মিলিট্যান্টদের গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হন। তাদের গুলিতে পেশকভ নিহত হন, কিন্তু মুরাখতিনের পায়ে গুলি লাগা সত্ত্বেও তিনি আহত অবস্থায় অবতরণ করতে সক্ষম হন। মুরাখতিন যে অঞ্চলে অবতরণ করেছিলেন, সেই পার্বত্য ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটি ছিল তুর্কি সীমান্ত থেকে প্রায় ১২ কি.মি. দূরে এবং তুর্কিপন্থী সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মুরাখতিন একটি জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করেন। মিলিট্যান্টরা বিধ্বস্ত ‘সু–২৪এম’ থেকে দুইজন বৈমানিককে অবতরণ করতে দেখেছিল এবং এজন্য তারা জীবিত বৈমানিকের (মুরাখতিনের) খোঁজে অঞ্চলটিতে তল্লাশি চালাতে শুরু করে।
অন্যদিকে, রুশরাও তাদের নিখোঁজ বৈমানিকের খোঁজে তল্লাশি চালাতে শুরু করে এবং এজন্য অঞ্চলটিতে ২টি রুশ ‘মিল মি–৮’ হেলিকপ্টার প্রেরণ করে। কিন্তু ‘সুরিয়ে তুর্কমেন ওর্দুসু’ মিলিট্যান্টরা হেলিকপ্টার দুটির ওপরেও প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে একটি হেলিকপ্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হেলিকপ্টারে থাকা আলেক্সান্দর পোজিনিচ নামক একজন মেরিন সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ফলে হেলিকপ্টারটি জরুরি অবতরণে বাধ্য হয় এবং অপর হেলিকপ্টারটি সেখান থেকে সরে পড়ে। সিরীয় সৈন্যদের সহযোগিতায় সেখান থেকে হেলিকপ্টারটির অবশিষ্ট ক্রুদের (এবং পোজিনিচের মৃতদেহ) হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়া হয়, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হেলিকপ্টারটি সেখানেই রয়ে যায়। পরবর্তীতে ‘আল–জায়শ আস–সুরি আল–হুর’ মিলিট্যান্ট জোটের অন্তর্ভুক্ত ‘১ম উপকূলীয় ডিভিশন/ফুরকাত আল–আওয়াল আস–সাহলি’ মিলিট্যান্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত ‘বিজিএম–৭১ টিওডব্লিউ’ ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে পরিত্যক্ত হেলিকপ্টারটি ধ্বংস করে দেয়।
এভাবে মুরাখতিনকে উদ্ধার করার জন্য রুশদের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। ইরানি সংবাদ সংস্থা ‘ফার্স নিউজ এজেন্সি’ এবং ইসরায়েলি অনলাইনভিত্তিক পত্রিকা ‘দ্য টাইমস অফ ইসরায়েল’–এর ভাষ্য অনুসারে, ইতোমধ্যে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর ‘স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ড/ওজেল কুভভেৎলের কোমুতানলিই’র (তুর্কি: Özel Kuvvetler Komutanlığı) সদস্যরা মিলিট্যান্টদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং মুরাখতিনকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু ‘সুরিয়ে তুর্কমেন ওর্দুসু’র সদস্যদের সঙ্গে তাদের মতানৈক্য দেখা দেয়। তুর্কি কমান্ডোরা মুরাখতিনকে বন্দি করে তুরস্কে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল, যাতে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার সময় তার মুক্তির বিষয়টিকে ‘তুরুপের তাস’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে, সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টরা রুশ বোমাবর্ষণের ফলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে রুশদের ওপর মারাত্মক ক্ষিপ্ত ছিল এবং এজন্য মুরাখতিনকে ‘জর্দানীয় বৈমানিকে’র পরিণতি প্রদান করতে ইচ্ছুক ছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর সিরীয় ভূখণ্ডে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে আইএসবিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় জর্দানীয় বিমানবাহিনীর একটি ‘লকহিড মার্টিন এফ–১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ যুদ্ধবিমান আইএস মিলিট্যান্টদের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে (কিংবা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে) বিধ্বস্ত হয় এবং বৈমানিক ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট মুয়াদ আল–কাসাসিবাহ প্যারাশুটের সাহায্যে বিধ্বস্ত বিমানটি থেকে আইএস–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে অবতরণ করেন। মার্কিন সৈন্যরা তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং আল–কাসাসিবাহ আইএস মিলিট্যান্টদের হাতে বন্দি হন। আইএস মিলিট্যান্টরা ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি বন্দি আল–কাসাসিবাহকে একটি খাঁচার মধ্যে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে খুন করে এবং সেটির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টরা অনুরূপভাবে মুরাখতিনের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিল।
কিন্তু তুর্কি কমান্ডো ও সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তারা তাদের তল্লাশি কার্যক্রম সমন্বয় করেনি এবং এর ফলে রাশিয়া ও তাদের মিত্ররা মুরাখতিনকে উদ্ধার করার জন্য আরেকটি অভিযান পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। ইরানি ‘ইসলামিক রেভোলিউশিনারি গার্ড কোরে’র অন্তর্গত অপ্রচলিত যুদ্ধ (unconventional warfare) ও সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রম সংক্রান্ত শাখা ‘কুদস ফোর্সে’র তদানীন্তন অধিনায়ক মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানি সেসময় সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন এবং কয়েকদিন আগেই আলেপ্পোর কাছে এক সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন। রুশ বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর তিনি রুশদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মুরাখতিনকে উদ্ধার করার জন্য তাদের সহায়তা করার প্রস্তাব করেন। রুশরা তার প্রস্তাব গ্রহণ করে।
মেজর জেনারেল সুলেইমানি ১৮ জন সিরীয় সৈন্য ও ৬ জন হিজবুল্লাহ যোদ্ধার সমন্বয়ে একটি উদ্ধারকারী দল গঠন করেন। সিরীয় সৈন্যদের মধ্যে ছিল সিরীয় ‘এয়ারফোর্স ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট/ইদারাত আল–মুখাবারাত আল–জাওয়িয়াহ’–এর (আরবি: إدارة المخابرات الجوية) অধীনস্থ ‘টাইগার ফোর্সেস/কুওওয়াত আল–নিমর’–এর (আরবি: قُوَّات النِّمْر) ১৭ জন সদস্য এবং একজন রুশভাষী অনুবাদক। মুরাখতিন যে অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন, সেই অঞ্চলের পরিবেশ–পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বিস্তৃত জ্ঞান ছিল। মুরাখতিনকে উদ্ধার করার জন্য দলটিকে মিলিট্যান্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের ৪.৫ থেকে ৬ কি.মি. গভীরে অনুপ্রবেশ করতে হয়েছিল। তাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে রুশ বিমানবাহিনী অঞ্চলটিতে মিলিট্যান্টদের অবস্থানগুলোর ওপর ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে এবং তাদেরকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। রুশরা ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে’র (জিপিএস) সাহায্যে মুরাখতিনের অবস্থান নির্ধারণ করে এবং এর ভিত্তিতে সিরীয় ও হিজবুল্লাহ কমান্ডোরা তাকে খুঁজে বের করে।
মুরাখতিনকে খুঁজে পাওয়ার পর সিরীয় ও হিজবুল্লাহ কমান্ডোরা তাকে সেখান থেকে সিরীয় সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে তাকে বিমানযোগে হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টাব্যাপী এই উদ্ধার অভিযানের অবসান ঘটে। অভিযান চলাকালে সিরীয় ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের কেউ হতাহত হয়নি। অভিযান চলাকালে রুশ রাষ্ট্রপতির কার্যালয়কে অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছিল এবং প্রচারমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই অভিযানটির অগ্রগতি তত্ত্বাবধান করছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ‘আভিয়াদার্স্ত’ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মুরাখতিন ‘সেরা নেভিগেটর’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরকম একজন বৈমানিক মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হলে বা তুর্কিদের হাতে বন্দি হলে সেটি রাশিয়ার জন্য আরো অবমাননাকর হিসেবে বিবেচিত হত এবং এজন্য মুরাখতিনকে উদ্ধার করার ওপর রুশ সরকার এতটা জোর দিচ্ছিল।
অবশ্য তখনও পেশকভের মৃতদেহ সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের কাছে ছিল। তারা জানায় যে, সিরীয় সরকারের হাতে বন্দি মিলিট্যান্টদের মুক্তির বিনিময়ে তারা পেশকভের মৃতদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি। কিন্তু মস্কো বা দামেস্ক কেউই মিলিট্যান্টদের কোনো ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না, এবং পেশকভের মৃতদেহ উদ্ধার করার জন্য রুশরা তুরস্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এই পরিস্থিতিতে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন/মিল্লি ইস্তিহবারাত তেশকিলাতি’ (তুর্কি: Millî İstihbarat Teşkilatı, ‘MİT’) সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পেশকভের মৃতদেহকে বিমানযোগে তুর্কি ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর তুর্কি কর্তৃপক্ষ রুশ সামরিক অ্যাটাশে কর্নেল দোভগেরের কাছে পেশকভের মৃতদেহ সমর্পণ করে এবং তাকে বিমানযোগে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ২ ডিসেম্বর রাশিয়ার লিপেৎস্ক শহরের সমাধিক্ষেত্রে ১০,০০০–এর বেশি মানুষের উপস্থিতিতে পেশকভকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করা হয়।
রুশ সরকার পেশকভকে মরণোত্তর রাশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘রুশ ফেডারেশনের বীর’ (রুশ: Герой Российской Федерации, ‘গেরোয় রোসিস্কোয় ফেদেরাৎসি’) প্রদান করে। ক্যাপ্টেন মুরাখতিন ও নাবিক পোজিনিচকে (পোজিনিচের ক্ষেত্রে মরণোত্তর) বীরত্বসূচক পদক ‘অর্ডার অফ কারেজ’ (রুশ: Орден Мужества, ‘অর্দেন মুঝেস্তভা’) প্রদান করা হয়। হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে আহত মুরাখতিনের চিকিৎসা করা হয় এবং তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। প্রচারমাধ্যমকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মর্মে বক্তব্য প্রদান করেন যে, তার বিমান এক সেকেন্ডের জন্যও তুর্কি আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি এবং তুর্কিরা আক্রমণ পরিচালনার আগে কোনো সতর্কবার্তা প্রদান করেনি। অবশ্য তার এই বক্তব্য প্রদানের আগেই রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক ও প্রচারণা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
প্রাথমিক রুশ প্রতিক্রিয়া
যখন তুর্কিরা রুশ বোমারু বিমানটি ভূপাতিত করে এবং একজন রুশ বৈমানিক তুর্কি–সমর্থিত সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হন, তখন রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন রাশিয়ার কৃষ্ণসাগরীয় রিসোর্ট নগরী সোচিতে জর্দানীয় রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। তুর্কিরা রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে, এই সংবাদ পাওয়ার পর তিনি ঘটনাটিকে ‘রাশিয়ার পিঠে সন্ত্রাসবাদীদের সহযোগীদের ছুরিকাঘাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এই ঘটনার ফলে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে ‘গুরুতর প্রতিক্রিয়া’ দেখা দেবে বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে মস্কোয় তিনি সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন যে, তুরস্ককে তারা ‘বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং তারা যে রুশদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে এটা তারা কল্পনাও করেননি। তদানীন্তন রুশ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ তুরস্কের এই পদক্ষেপকে ‘অপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এটিকে ‘পরিকল্পিত উস্কানি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ২৫ নভেম্বর তার পূর্বনির্ধারিত তুরস্ক সফর বাতিল করেন। সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সের্গেই রুদস্কোয় মন্তব্য করেন যে, এখন থেকে সিরিয়ায় রুশ সামরিক কার্যক্রমের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এরকম প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর ওপর তার সৈন্যরা আক্রমণ চালাবে।
এই ঘটনার ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাশিয়ার অন্তর্গত চেচেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান মেজর জেনারেল রমজান কাদিরভ মন্তব্য করেন যে, তুরস্ককে তাদের এই পদক্ষেপের জন্য অনুতাপ করতে হবে! ২৫ নভেম্বর রুশ জনসাধারণ মস্কোয় অবস্থিত তুর্কি দূতাবাস ও কাজানে অবস্থিত তুর্কি কনস্যুলেট–জেনারেলের সামনে বিক্ষোভ করে এবং তুরস্কের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। অবশ্য এই প্রতিক্রিয়া যাতে পূর্ণাঙ্গ রুশ–তুর্কি যুদ্ধে রূপ না নেয়, সে ব্যাপারে রুশ নেতৃবৃন্দ সতর্কতা অবলম্বন করেন। সেদিন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ নবনিযুক্ত তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোলুর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা টেলিফোনে আলাপ করেন এবং উভয়ে এই বিষয়ে একমত হন যে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও তুরস্ক নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ করবে না।
কিন্তু রুশদের পরবর্তী কার্যক্রম থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই ঘটনাকে ঘিরে তারা যুদ্ধ শুরু না করলেও তুরস্কের ওপর অন্যভাবে প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী। ২৭ নভেম্বর রুশ বিমানবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল জেনারেল ভিক্তর বন্দারেভ জানান যে, রুশ ও সিরীয় রাডার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তুর্কি ‘এফ–১৬’ যুদ্ধবিমানদ্বয় রুশ বিমানটির ওপর ‘চোরাগোপ্তা আক্রমণ’ (ambush) চালিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তার ভাষ্যমতে, যে অঞ্চলে ঘটনাটি ঘটেছে, তুর্কি যুদ্ধবিমান দুটি প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সেই অঞ্চলের আকাশে অবস্থান করেছিল এবং যে বিমানটি থেকে রুশ বিমানের দিকে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেটি এই আক্রমণ চালাতে ৪০ সেকেন্ডের জন্য সিরীয় আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছিল। রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের পর তুর্কি বিমান দুটি তাদের বিমান ঘাঁটি থেকে এসেছিল– তুর্কিদের এই বক্তব্য সত্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বস্তুত তুর্কিদের বক্তব্য ছিল, তাদের যুদ্ধবিমান দুটি রুশ বিমানের ওপর আক্রমণ পরিচালনার আগে ৫ মিনিটের মধ্যে ১০ বার তাদেরকে সতর্ক করেছে। কিন্তু তাদের নিজেদের বক্তব্য অনুসারেই, রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমায় মাত্র ১৭ সেকেন্ড অবস্থান করেছে। সুতরাং ১৭ সেকেন্ডের মধ্যে ১০ বার রুশ বিমানকে তারা সতর্ক করেছিল, এমনটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তদুপরি, রুশ ‘সু–২৪’ বিমানগুলো নিচু দিয়ে ওড়ার সময় সর্বোচ্চ গতিতে চললে প্রতি মিনিটে প্রায় ১৩ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। বিমানটির বেঁচে যাওয়া ক্রু ক্যাপ্টেন মুরাখতিনের ভাষ্যমতে, যখন তাদের বিমানটি ভূপাতিত করা হয় তখন সেটি সর্বোচ্চ গতিতে চলছিল। অর্থাৎ, বিমানটি যখন তুর্কি সীমান্ত থেকে প্রায় ১৬ মাইল দূরে (১ মিনিট ২০ সেকেন্ডের দূরত্ব) অবস্থান করছিল, তখনই কেবল এটি বোঝার উপায় ছিল যে, বিমানটি তুর্কি সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, রুশ বিমানটি যদি তুর্কি আকাশসীমায় প্রবেশ করে থাকতোও, সেটি তুর্কিদের পক্ষে ৫ মিনিট আগেই জেনে ফেলার কোনো উপায় ছিল না। বড়জোর ১ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগে তাদের ব্যাপারটি জানতে পারার কথা।
স্বাভাবিকভাবে, রুশ বিমানকে চিহ্নিতকরণ, নিকটস্থ বিমানঘাঁটি থেকে তুর্কি যুদ্ধবিমান প্রেরণ এবং ১০ বার রুশদেরকে সতর্কবার্তা প্রদান– এত অল্প সময়ের মধ্যে এত কিছু করা সম্ভব নয়। এজন্য রুশদের কাছে যে ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল, সেটি হচ্ছে, তুর্কিরা আগে থেকেই একটি রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং ‘রুশ বিমান কর্তৃক তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন’ ছিল মূলত একটি অজুহাত মাত্র। উল্লেখ্য, রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার কয়েক দিন আগে তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভের সঙ্গে একটি বৈঠকে তদানীন্তন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেরিদুন সিনিরলিওলু রুশদের ‘বেসামরিক তুর্কমেন গ্রামগুলো’র ওপর আক্রমণ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং মন্তব্য করেন যে, রুশরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অভিযান বন্ধ না করলে এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোলু আরো স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেন, যদি কোনো আক্রমণের কারণে তুরস্কে শরণার্থী প্রবেশের হার বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে সিরিয়া ও তুরস্ক উভয়ের অভ্যন্তরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বস্তুত রুশ বিমানটি প্রকৃতপক্ষে তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল কিনা, এক্ষেত্রে সেই বিষয়টি মুখ্য নয়। সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের কারণে সিরিয়ায় তুর্কি ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল এবং বিশেষত তুর্কি–সমর্থিত সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের ওপর তীব্র রুশ আক্রমণ সিরিয়ায় তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করা ছিল কার্যত রাশিয়ার ওপর তুর্কি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। অন্তত রুশ রাজনীতিবিদরা এভাবেই ঘটনাটি দেখছিলেন। কর্নেল জেনারেল বন্দারেভের মতো রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনও রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনাকে একটি ‘চোরাগোপ্তা আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
প্রাথমিক তুর্কি প্রতিক্রিয়া
তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর রুশদের প্রতিক্রিয়া ছিল সরল: তারা তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধ চাচ্ছিল না, কিন্তু তুরস্কের ওপর তারা ক্ষিপ্ত ছিল এবং রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য তুরস্ক ক্ষমা প্রার্থনা করবে, এমনটি আশা করছিল। এই বিষয়ে তুরস্কের প্রতিক্রিয়া ছিল তুলনামূলকভাবে জটিল। তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান মার্কিন প্রচারমাধ্যম ‘সিএনএন’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, তুরস্কের নিজস্ব আকাশসীমা রক্ষার অধিকার রয়েছে, তুরস্ক রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবে না এবং উল্টো তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য রাশিয়ারই তুরস্কের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আঙ্কারায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের সময় তিনি আরো মন্তব্য করেন, রাশিয়া যদি আবার তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, তুরস্ক আবারো একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু পরের দিনই ফরাসি টেলিভিশন চ্যানেল ‘ফ্রান্স ২৪’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন, তুরস্ক যদি জানত যে বিমানটি রুশদের, সেক্ষেত্রে তারা অন্যভাবে ঘটনাটির মোকাবিলা করত। তিনি আরো জানান যে, তিনি এই ঘটনার পর দুবার পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু রুশরা কোনো জবাব দেয়নি।
অন্যান্য তুর্কি রাজনীতিবিদদের বক্তব্যও ছিল অনুরূপভাবে মিশ্র প্রকৃতির। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী দাভুতোলু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাভুসোলু উভয়েই মন্তব্য করেন যে, ভূপাতিত বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। কিন্তু উভয়েই যোগ করেন যে, বিমানটি যে রুশদের, সেটি তাদের জানা ছিল না এবং তারা রাশিয়ার সঙ্গে কোনো সঙ্কট চান না, কারণ রাশিয়াকে তারা ‘বন্ধু’ হিসেবে বিবেচনা করেন। একইসঙ্গে দাভুতোলু আবার মন্তব্য করেন যে, রাশিয়াকে সিরীয় তুর্কমেনদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা বন্ধ করতে হবে। তদুপরি, তুর্কি জনসাধারণ ইস্তাম্বুলে রুশ কনস্যুলেট–জেনারেলের সামনে বিক্ষোভ করে এবং সিরীয় তুর্কমেনদের ওপর রুশ আক্রমণের প্রতিবাদ জানায়। অর্থাৎ, তুর্কি সরকার একদিকে রাশিয়ার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছিল, কিন্তু অন্যদিকে আবার অংশত নমনীয় ভাবও প্রদর্শন করছিল।
বস্তুত তুরস্কের উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী। তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার ফলে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল এবং তুর্কি সরকারের অভ্যন্তরীণ জনসমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছিল। তদুপরি, তুর্কি সরকারের ধারণা ছিল, বিগত বছরগুলোতে তুর্কি–মার্কিন সম্পর্কে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, সিরিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার মাধ্যমে তুরস্ক সেই দ্বন্দ্বের মাত্রা প্রশমিত করতে পারবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারবে। এজন্য এই ঘটনার কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেদেরকে দুর্বল প্রমাণিত করার কোনো ইচ্ছা তুর্কি সরকারের ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ কোনো ধরনের যুদ্ধই তাদের কাম্য ছিল না, সুতরাং রুশদের ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য তুর্কি সরকার তাদের বক্তব্যে নমনীয়তা আনয়ন করে এবং কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ (যেমন: এরদোয়ান কর্তৃক সরাসরি পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা ও বিনা শর্তে রুশ বৈমানিকের মৃতদেহ রাশিয়ার নিকট সমর্পণ) গ্রহণ করে।