২০১১ সালের জুলাই মাস। বোয়িং এয়ারক্র্যাফট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কপালে ঘাম। ঘামের কারণ আমেরিকার সামার টাইমের গরম নয়। এয়ারক্র্যাফট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দুনিয়ায় মূলত রাজত্ব করে বেড়ায় আমেরিকার বোয়িং এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এয়ারবাস- এ দুটি কোম্পানি। হঠাৎ করেই বোয়িং জানতে পারে, তাদের প্রতিপক্ষ এয়ারবাস তাদের বহুল জনপ্রিয় সিঙ্গেল আইলের বিমান, এয়ারবাস এ-৩২০ কে আপগ্রেড করছে। মূলত তারা বিদ্যমান প্লেনটির ইঞ্জিন দুটিকে রিপ্লেস করছে তুলনামূলক দুটি বড় আকারের এবং ১৫% অধিক জ্বালানী সাশ্রয়ী হাই বাইপাস রেসিও টার্বো ফ্যান ইঞ্জিন সংযোজন করার মাধ্যমে।
অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এবং জ্বালানী সাশ্রয়ী হবার পাশাপাশি এয়ারবাসের এ নতুন আপডেট বিমানটির যাত্রী পরিবহন ক্ষমতাও বেড়ে যাবে ফ্লাইট প্রতি গড়ে ২০ জন। ব্যবসায়িক দিক থেকে এটি এয়ারলাইন্স অপারেটরদের জন্য উইন উইন সিচ্যুয়েশন। কিন্ত আটলান্টিকের এপারে অন্য ম্যানুফ্যাকচারার বোয়িংয়ের জন্য চরম দুঃসংবাদ। মরার উপর ক্ষরার ঘায়ের মতো, আমেরিকার পত্রিকাগুলোতে খবর বেরিয়ে পড়লো যে, আমেরিকান এয়ারলাইন্স, এ নতুন আপডেটেড এয়ারবাসের ২০০টি বিমান অগ্রিম অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। এরকম খবরে শেয়ার বাজারে বোয়িংয়ের বিশাল পতনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো ছিল না।
তখন বোয়িং সিদ্ধান্ত নিলো তারাও তাদের বহুল জনপ্রিয় সিঙ্গেল আইলের বোয়িং ৭৩৭ বিমানটিকে আপডেট করবে। অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন এবং জ্বালানী সাশ্রয়ী বড় হাই বাইপাস রেসিও টার্বো ফ্যান ইঞ্জিন সংযোজন করবে। বোয়িং অফিস থেকে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের কাছে প্রস্তাব গেল, তারা যদি তাদের বোয়িং ৭৩৭ বিমানটিকে আপডেট করে আরো বেশি যাত্রী পরিবহন ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলে, তাহলে তারা এয়ারবাসের সেই ২০০ বিমানের অর্ডার অর্ধেক কাট করে বোয়িংকে অর্ধেক দিবে কিনা? আমেরিকান এয়ারলাইন্স তাতে রাজি হলো। আর শুরু হয়ে গেল দুই এরোস্পেস জায়ান্টের প্রতিযোগিতা। এয়ার বাস তাদের আপডেটেড ভার্সনের নাম দিল ‘এয়ারবাস নিও এ ৩২০’ আর বোয়িং নাম দিলো ‘৭৩৭ ম্যাক্স’।
তাড়াহুড়া করে প্রস্তাব পাঠিয়ে অর্ডার হাতিয়ে নিলেও বোয়িংয়ের সামনে পড়ে রইলো বিশাল চ্যালেঞ্জ। এয়ারবাসের জন্য পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল। নতুন ডিজাইনে পুরাতন টার্বোফ্যান ইঞ্জিনগুলো প্রতিস্থাপন করে নতুন বড় আকারের টার্বোফ্যান বিমানের পাখার নিচে বসানো সহজ ছিল তাদের জন্য। কারণ তাদের পুরাতন বিমানগুলোর পাখা মাটি থেকে বেশ উঁচুতে। কিন্তু বোয়িংয়ের ক্ষেত্রে বিধি বাম। বোয়িং ৭৩৭ বিমানের পাখাগুলো মাটি থেকে তুলনামূলক কম উচুতে। সুতরাং গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স একেবারেই কম। তার উপর যদি আবার নতুন আরো বড় টার্বোফ্যান ইঞ্জিন বসাতে যায়, সেক্ষেত্রে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেস একেবারেই কমে যাবে। যা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু বোয়িং মাথা নোয়াবে না।
বোয়িংয়ের ডিজাইন ইঞ্জিনিয়াররা মিটিংয়ে বসলো। তারা ঠিক করলো এ সমস্যার সমাধান তারা করতে পারবে, যদি ইঞ্জিনগুলোকে পাখার একটু সামনের দিকে এনে উচু করে বসানো যায়।
ডিজাইন মতোই নতুন বিমান আপডেটের পথে তারা, কিন্তু সামনে এলো নতুন সমস্যা। বিমানের স্ট্যাবিলিটি-কন্ট্রোল ইস্যু। ইঞ্জিনগুলোকে পাখার সামনে এনে একটু উপরে বসিয়ে তারা গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স এর সমস্যা ঠিকই সমাধান করলো, কিন্তু এর ফলে বিমানের সেন্টার অফ গ্রেভেটি বা ভরকেন্দ্র চলে গেল পেছনে। যার কারণে নতুন বিমানটি যখন ইঞ্জিনের পূর্ণ বল দিয়ে নিয়ে টেক অফ করতে যায়, তখন তাতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। বিমানের নাক তথা সামনের অংশটা অস্বাভাবিক উপরে উঠে যায়।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য তারা বের করলো নতুন এক অটোমেটেড সফটওয়্যার। নাম MCAS- Maneuvering Characteristics Augmentation System (MCAS)। এর কাজ হলো বিমানের নাক বেশি উপরে উঠে গেলে, এটি নিজে নিজেই পাইলট থেকে বিমানের কন্ট্রোল নিজের কাছে নিয়ে নোজ ডাউন করে দেবে। কিন্তু বোয়িং কর্তৃপক্ষ থেকে এই নোজ আপ সমস্যা আর এই অটোমেটেড সফটওয়্যারের ব্যাপারে পাইলট এবং এয়ারলাইন্সগুলোকে কিছুই জানানো হলো না। শুধু বলা হলো আগের ৭৩৭ বিমানে পাইলটরা মাত্র ১ ঘন্টার একটা আইপ্যাড ট্রেনিং করেই এই নতুন বিমান চালাতে পারবে। আর এখানেই হয়ে গেল বড় ভুল। অপারেটররা শুরু করে দিল যাত্রী পরিবহন।
সমস্যা হলো, এই সফটওয়্যারটি কেবলমাত্র একটি এঙ্গেল অফ এটাক সেন্সর থেকে ডাটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে নোজ ডাউন করবে নাকি করবে না। কোনো কারণে যদি একটি মাত্র এঙ্গেল অফ এটাক সেন্সর বিমানের কম্পিউটারকে বিমানের নোজ এঙ্গেল সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয় তাহলেই বিপদের সম্ভাবনা। বিমান অটোমেটিক পাইলট থেকে নিজের কাছে কন্ট্রোল নিয়ে নেবে এবং বিমানের নোজ ডাউন করে দেবে। এতে যদি বিমান আকাশ থেকে মাটিতে এসে আচড়ে পড়ে, পাইলটের কিছু করার থাকবে না।
নতুন বিমানে একটি ছাড়া অন্য কোনো এঙ্গেল অফ এটাক সেন্সরও নেই যেটির সাথে ক্রোস চেক করে বিমানের কম্পিউটার বুঝবে আসলেই নোজ বেশি উপরে উঠে গিয়েছে কিনা। যেহেতু টেক অফের সময়ই বিমানের নোজ সবচেয়ে বেশি উঁচুতে মুখ করে থাকে সেহেতু এই অবস্থাটা সবচেয়ে মারাত্মক। যে দুটি এক্সিডেন্টের কারণে এ বিমানের সব ফ্লিট গ্রাউন্ডেড করা হয়েছিল সে দুটি এক্সিডেন্টে এই ঘটনাই ঘটেছিল। টেক অফের সাথে সাথেই বিমানের একটি মাত্র এঙ্গেল অফ এটাক সেন্সর ভুলবশত রিড করে। সাথে সাথেই এই অটোমেটেড সফটওয়্যার পাইলট থেকে নিজের কাছে বিমানের নয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বিমানের নাককে ৪০ ডিগ্রি নিচের দিকে ঠেলে দেয়।
একই অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারলাইন্স এবং ইথিওপিয়ার ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান দুটি ইঞ্জিনের ফুল থ্রাস্ট নিয়েই যথাক্রমে জাভা সাগরের বুকে এবং মাটিতে আছড়ে পড়ে। পাইলট ক্রুসহ সকল যাত্রীই মারা যায়।
বোয়িং সবসময়ই এয়ারবাস থেকে এগিয়ে ছিল, এখনো এগিয়ে আছে এবং আরো কয়েক দশক ধরেও থাকতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই প্রতিপক্ষকে সামনে এগিয়ে যেতে না দেওয়া, সিংহাসন ধরে রাখার অশুভ প্রতিযোগিতায় পড়ে সবকিছু তাড়াহুড়ো করে করতে গিয়ে অনেকগুলো নীরিহ মানুষের জীবন গেল, যাদের অনেকের পরিবারে হয়তো তারাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। আর বোয়িংকে তড়িঘড়ি করে কাজ করার আক্কেলসেলামি দিতে হলো প্রায় ২০০ কোটি ডলার। ঘাড়ের উপর এখনো ঝুলে আছে অনেকগুলো মামলা।
সম্প্রতি ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন (এফ.এ. এ) ৭৩৭ ম্যাক্সকে পুনরায় উড়ার অনুমতি দিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে এ বিমান এখন শতভাগ নিরাপদ। অটোমেটেড সফটওয়্যার পুরোপুরি রি-রাইট করা হয়েছে এবং একটির বদলে দুটি এঙ্গেল অফ এটাক সেন্সর বসানো হয়েছে। যদি এই দুটি সেন্সরেই একই রিডিং আসে তবেই কেবল MCAS বিমানের কন্ট্রোল নেবে।
আশা করা যায় বোয়িং তার ভুল থেকে শিক্ষা নেবে এবং আগামী দিনগুলোতে নিজেদের অর্জিত সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে মুনাফার পাশাপাশি যাত্রী নিরাপত্তার দিকে আরো বেশি নজর দেবে।