১৯৯১ সাল। কুয়েত দখল করে সেখানে গেড়ে বসেছে ইরাকি বাহিনী। রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পের আশেপাশে রাস্তায় টহল দিতে দেখা যাচ্ছে তাদেরকে। ক্যাম্পের ভেতরে রাডারের দায়িত্বে থাকা সেনা অফিসারের চোখ তন্দ্রায় প্রায় বুজে এসেছে। সতর্ক থাকলে হয়তো রাডার স্ক্রিনের একপাশে সামান্য সময়ের জন্য অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেতো সে।
ধুম! রাতের নিস্তদ্ধতা খানখান করে দিয়ে শোনা গেল মিসাইল বিস্ফোরণের শব্দ। হেলফায়ার আর হাইড্রা-৭০ ফ্লেচেট রকেটগুলো মুহুর্মুহু আছড়ে পড়তে থাকলো ইরাকি বাহিনীর ক্যাম্পের উপর। অতর্কিত হামলায় ইরাকি বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংস হয়ে গেল তাদের রাডার সিস্টেম। রাডার ধ্বংস হওয়ার সংবাদ পাওয়ামাত্র কুয়েতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের মিত্র দেশগুলোর ফাইটার-বোম্বারগুলো। মাত্র ১০ ঘণ্টার ব্লিৎসক্রেইগে ইরাকি বাহিনীকে নাকাল করে ছাড়লো তারা।
রাডারগুলো ধ্বংস না হলে হয়তো এত সহজে কুয়েত অভিযান সফল হতো না। আর ঠিক সেই কাজটিই সফলভাবে শেষ করেছিলো মাত্র ৮টি এএইচ-৬৪ অ্যাপাচি। রাডারের রেঞ্জের নিচ দিয়ে গিয়ে শত্রুপক্ষকে চমকে দিয়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো এই অ্যাটাক-হেলিকপ্টারগুলোই। ১০০ ঘণ্টার যুদ্ধে ২৭৭টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের মিসাইলের আঘাতে উড়ে গিয়েছিল ২৭৮টি ট্যাংকসহ অসংখ্য ইরাকি সাঁজোয়া যান। বিপরীতে মাত্র একটি অ্যাপাচি ভূপাতিত হয়েছিল ক্লোজ-রেঞ্জ আরপিজির আঘাতে, যদিও পাইলট বেঁচে গিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে প্রথম মার্কিন সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়া এই হেলিকপ্টারগুলো এখনো বিশ্বের বুকের সেরা অ্যাটাক-হেলিকপ্টারের মর্যাদা ধরে রেখেছে। হেলিকপ্টার জগতের এই বিস্ময় সম্পর্কেই আরো বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সূচনার গল্প
১৯৭২ সালে এএইচ-৫৬ চেয়েন প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যাওয়ার পর মার্কিন বিমানবাহিনীর এ-১০ থান্ডারবোল্ট আর মেরিন কর্পসের হ্যারিয়ারের মতো এয়ারক্রাফট তৈরি করার জন্য তোড়জোর করা শুরু করলো মার্কিন সেনাবাহিনী। তৎকালীন সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে ভালো হেলিকপ্টার ছিল এএইচ-১ কোবরা। কিন্তু আরো ভালো পারফরম্যান্স, দ্রুতগতিসম্পন্ন আর অধিক অস্ত্রবহনকারী হেলিকপ্টারের প্রয়োজন দেখা দিল সেনাবাহিনীর। অবশেষে ঐ বছরেরই নভেম্বর মাসে বেল, বোয়িং, হিউজ, লকহীড আর সিকরস্কি কোম্পানি অ্যাডভান্সড অ্যাটাক হেলিকপ্টারের প্রোটোটাইপ বানানোর আবেদন করলো।
১ বছর পর ৫টি কোম্পানির প্রোটোটাইপ দেখেশুনে হিউজ কোম্পানির YAH-64A-কেই বেছে নেওয়া হলো। পরবর্তী কয়েকবছরে এতে যুক্ত হলো আরো উন্নত অস্ত্র আর সেন্সরব্যবস্থা। লেজার গাইডেড হেলফায়ার মিসাইল নিয়েও তৎকালীন সময়ে গবেষণা চলছিলো। পরীক্ষামূলকভাবে এই অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল হেলিকপ্টারে সংযুক্ত করে একে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যাটাক হেলিকপ্টার রূপ দেওয়া হলো।
১৯৮১ সালে আমেরিকার প্রাচীন আদিবাসী সম্প্রদায় ‘অ্যাপাচি ইন্ডিয়ান’-দের নামানুসারে হেলিকপ্টারটির নাম রাখা হলো অ্যাপাচি হেলিকপ্টার। যদিও ৩ বছরের মাথায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে হিউজ কোম্পানিকে কিনে নেয় বোয়িং, এবং তারপর থেকে বোয়িং অ্যাপাচি নামেই পরিচিতি পেতে শুরু করে এই অসাধারণ অ্যাটাক হেলিকপ্টারটি। আশি এবং নব্বইয়ের দশকজুড়ে এর মডেলে আরো পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত AH-64D হয়ে ওঠে আরো মারণঘাতী, আরো আঘাত সহ্যকারী।
তবে অ্যাপাচি হেলিকপ্টারগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই তৈরি করা হয়নি; ব্রিটেনের অগাস্টাওয়েস্টল্যান্ড কোম্পানি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যও বেশ কিছু অ্যাপাচি তৈরি করেছে। ২০০৪ সাল থেকে কোরিয়া অ্যারোস্পেস কোম্পানিই অ্যাপাচির ফিউসেলাজ (এয়ারক্র্যাফটের মূল দেহ) তৈরির দায়িত্ব নেয়।
অন্তরীক্ষের আতঙ্ক
হেলিকপ্টারগুলো সাধারণত দু’ধরনের হয়। একটি হচ্ছে কার্গো হেলিকপ্টার, যেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য-রসদ পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আকারে বড় হওয়া এই হেলিকপ্টারগুলো থেকে প্যারাস্যুট বা কর্ড নিয়ে প্যারাট্রুপারদেরকে দেখা যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অন্যদিকে অ্যাপাচির মতো হেলিকপ্টারগুলোতে এক থেকে দুজন পাইলট থাকে। আকাশ থেকেই শত্রুদেরকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো মিসাইল-মেশিনগান হেলিকপ্টার থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
অ্যাপাচির ফিউসেলাজের নিচেই দেখা যাবে একটি ৩০ মি.মি. এম২৩০ চেইনগান। মিনিটে ৬২৫ রাউন্ড গুলি চালানো যাবে এর সাহায্যে। তবে মাত্র ১২০০ রাউন্ড গুলি রাখার জায়গাই রয়েছে অ্যাপাচিতে। অর্থাৎ দুই মিনিটের মধ্যেই গুলি শেষ হয়ে যাবে। তবে এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই চেইনগানটিতে IHADSS প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ চেইনগান চালক তার হেলমেটের ভেতর দিয়ে যেখানে তাকিয়ে থাকবেন, ঠিক সেই জায়গাটিতেই চেইনগানের বুলেট নিক্ষিপ্ত হবে।
এয়ার-টু-সারফেস মিসাইল হিসেবে এতে রয়েছে লকহীড/বোয়িং-এর তৈরি হেলফায়ার মিসাইল, যা ছোঁড়া যাবে ৮ থেকে ১২ কিলোমিটার দূর থেকে! এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল হিসেবে স্টিঙ্গার, সাইডউইন্ডার, মিস্ট্রাল, সাইডআর্ম কিংবা APKWS-এর মতো মিসাইল ব্যবহার করা যাবে অ্যাপাচিতে।
অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের জন্যই লকহীড মার্টিন ‘অ্যারোহেড’ নামের নতুন সেন্সর সিস্টেম তৈরি করেছে, যাতে রয়েছে আরো নিখুঁতভাবে টার্গেট ঠিক করার ব্যবস্থা এবং উন্নত নাইট ভিশন সিস্টেম। প্রতি ঘণ্টায় ১৮৮ মাইল গতিতে উড়তে পারে অ্যাপাচিগুলো, উঠতে পারে ২০ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত! ৫,১৬৫ কেজি ওজনের এই হেলিকপ্টার এর দ্বিগুণ ওজনসমান ভার বহন করে উড়ে যেতে পারে।
সাফল্যের ইতিহাস
১৯৮৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী সর্বপ্রথম অ্যাপাচি হেলিকপ্টার হাতে পায়। তবে ১৯৮৯ সালে পানামাতে অপারেশন জাস্ট কজের আগ পর্যন্ত এটি ট্রেনিং মিশন ছাড়া সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। ২৪০ ঘণ্টার একটানা যুদ্ধে পিডিএফকে গুড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অ্যাপাচিগুলো। অ্যাপাচির হেলফায়ার মিসাইলগুলো দেখে অপারেশন কমান্ডার জেনারেল কার্ল স্টাইনার মন্তব্য করেছিলেন, “আপনি রাতের অন্ধকারে ৪ মাইল দূর থেকে একটি জানালার ফুটো দিয়েই নিখুঁতভাবে এই মিসাইল ছুঁড়তে পারবেন!”
পানামায় সফল হওয়ার পর কুয়েত অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক অ্যাপাচি হেলিকপ্টারই ব্যবহার করা হয়। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মেও সফলভাবে নিজেদের কাজ করে যায় অ্যাপাচিগুলো। তবে নব্বইয়ের দশকে বলকান অভিযানে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় অ্যাপাচিগুলোতে। নাইট ভিশন ইকুইপমেন্ট, জ্বালানি ট্যাংকসহ হেলিকপ্টারের মেকানিজমেই বেশ কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছিলো। ১৯৯৯ সালে আলবেনিয়াতে ট্রেনিংয়ের সময় পিছনের রোটোর কাজ না করায় ক্র্যাশ করে একটি অ্যাপাচি।
ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধেও বেশ কয়েকটি অ্যাপাচি শত্রুর মিসাইলের আঘাতে কিংবা দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে যেগুলো আঘাত সহ্য করেও মিশন চালিয়ে গিয়েছিলো, সেগুলোকে পরবর্তীতে মেরামত করে আবার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়।
তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আরো অনেক দেশই অ্যাপাচি ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সর্বপ্রথম সৌদি আরবের বিমানবহরেই যুক্ত হয় এই অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলো। উপসাগরীয় যুদ্ধের পরপরই বুশ সরকারের সাথে চুক্তি করে দুটি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কিনে নেয় সৌদি সরকার। তাদের দেখাদেখি ইসরায়েলও অ্যাপাচির দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালে ইসরায়েলে ৪২টি অ্যাপাচি পৌঁছে যায়। পরবর্তীতে আরো ৪২টি অ্যাপাচি কেনার চুক্তি করার চেষ্টা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানি করা অস্ত্র দিয়েই লেবানন-ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের উপর অপব্যবহার করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। লেবাননে হিজবুল্লাহর আস্তানায় প্রায়ই মিসাইল ছোঁড়া হতো এই অ্যাপাচিগুলো দিয়ে। ১৯৯৬ সালে লেবাননের এক অ্যাম্বুলেন্সের দিকে দুটি হেলফায়ার মিসাইল ছোঁড়ার ফলে ৬ জন সাধারণ ব্যক্তি মারা যায়। তাছাড়া আল-আকসা ইন্তিফাদার সময়েও গুরুত্বপূর্ণ হামাস নেতা হত্যা করার কাজেও ইসরায়েল এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব সফটওয়্যারের সুবিধা দিতে অস্বীকার করায় ইসরায়েল নিজেদের আবিষ্কার করা প্রযুক্তিই এই হেলিকপ্টারে ব্যবহার করছে। তাছাড়া হেলফায়ারের বদলে আরো হালকা স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইলও যুক্ত করা হয়েছে ইসরায়েলের অ্যাপাচি বহরে।
ইসরায়েল, সৌদি আরব ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, নেদারল্যান্ডসও অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের প্রধান ব্যবহারকারী। গ্রিস, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, কুয়েত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াও এই আধুনিক প্রযুক্তির হেলিকপ্টারগুলোকে নিজেদের বিমানবহরে যুক্ত করেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথেও ৯৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ৬টি অ্যাপাচি AH-64E মডেলের হেলিকপ্টার রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট।