ইসরায়েল কীভাবে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হলো?

গত কয়েক দশক ধরে নিজেদেরকে পৃথিবীর অন্যতম প্রযুক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইসরায়েল। মাত্র ৮০ লক্ষের চেয়ে সামান্য বেশি জনসংখ্যার এই দেশে অবিশ্বাস্যভাবে ৪ হাজারেরও বেশি প্রযুক্তি কোম্পানি রয়েছে। সিসকো, পেপাল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল কিংবা ইনটেল হচ্ছে এমনই কিছু হাতেগোনা কোম্পানির নাম, যারা ইসরায়েলে নিজেদের নতুন পণ্য উৎপাদন ও গবেষণার কাজ করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এই বিষফোঁড়া কীভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহকে পাশ কাটিয়ে নিজেদেরকে বিশ্বে প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়েছে? কীভাবেই বা তারা প্রযুক্তি বিশ্বকে নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে? চলুন সেটাই জেনে আসা যাক।

ইসরায়েলকে নির্দ্বিধায় বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত রাষ্ট্র। ইসরায়েলের প্রসঙ্গ চলে আসলে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সংঘাতের কথা অবধারিতভাবেই চলে আসে। কিন্তু আজকে আমরা চেষ্টা করবো একটু অন্যদিকে আলোকপাত করতে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অসাধারণভাবে এগিয়ে যাওয়া এই দেশটি কীভাবে এই সাফল্য অর্জন করলো, তার পেছনের চিত্র তুলে ধরা আজকের মূল বিষয়।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলে ৪ হাজারেরও বেশি টেক-কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রথম সারির সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর নাম। বিশ্বের সবচেয়ে প্রধান ৫০০টি টেক-জায়ান্টের ৮০টিরই গবেষণাকেন্দ্র এবং নব্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্র রয়েছে ইসরায়েলে! আদতে টেক-স্টার্টআপের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির ঠিক পরেই রয়েছে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের নাম, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি কেন্দ্র। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত টেক-কোম্পানিগুলোর শেয়ারের জন্য তৈরি ন্যাসড্যাক স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকায় ইসরায়েল রয়েছে ৩ নাম্বারে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র আর চীনই রয়েছে ইসরায়েলের উপরে। জার্মানি, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্সের সম্মিলিত প্রযুক্তি কোম্পানির তালিকাও রয়েছে ইসরায়েলের পিছনে!

সিলিকন ওয়াদি, তেল আবিবের প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের কেন্দ্র; Image Source: PYMNTS

কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ঠিক এই মুহূর্তে পরবর্তী মডেলের আইফোনের হার্ডওয়্যারের বেশিরভাগই তৈরি করা হচ্ছে ইসরায়েলে। চীন হয়তো উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু নতুন প্রযুক্তি গবেষণা, আবিষ্কার আর তা বাস্তবে তৈরি করার দিক থেকে সবার উপরে রয়েছে ইসরায়েল। গুগলের নতুন প্রযুক্তিগুলোর অনেকগুলোই তৈরি করেছে এই ইসরায়েলিরা। ইনটেল, বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রসেসর তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান, মাইক্রোচিপ নিয়ে গবেষণার জন্যও ইসরায়েলের গবেষকদের মুখাপেক্ষী। ইসরায়েলের ইনটেল কারখানায় কাজ করে ১১ হাজারেরও বেশি কর্মী, যেটি দেশের অন্যতম বড় প্রযুক্তি কারখানা। বিল গেটসের মাইক্রোসফটকেও ধরা হয় একটি আধা-ইসরায়েলি কোম্পানি হিসেবে, অর্থাৎ আপনার কম্পিউটারে চালিত উইন্ডোজ সফটওয়্যারটি ডেভেলপ করতেও অবদান রয়েছে কোনো ইসরায়েলি প্রযুক্তিবিদের।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ইসরায়েলের আয়ের অন্যতম বড় একটি অংশই আসে এই প্রযুক্তি খাত থেকে। আইবিএম, পেপাল, সিসকো, আমাজন, ফেসবুকসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ সেক্টরে কাজ করার ফলে এবং প্রযুক্তি আমদানির ফলে যে অর্থ আয় হয়, তা ইসরায়েলের জিডিপির ১২.৫%! এখন আপনার মাথায় নিশ্চয়ই ঘুরছে, কীভাবে ইসরায়েল এই সক্ষমতা অর্জন করলো। সেগুলোই শুনে আসা যাক।

ইনটেল ৮০৮৮, তৈরি হয়েছে ইসরায়েলের হাইফা ল্যাবরেটরিতে; Image Source: Wikimedia Commons

ইয়জমা (יוזמה)

নব্বইয়ের দশককে ধরা হয় ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ দশটি বছর, বিশেষ করে অর্থনীতির দিক থেকে। প্রতিবছর প্রায় ১০০% মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থব্যবস্থায় ধস নেমেছে, বাজেটের ঘাটতি আর ঋণের বোঝা তখন দেশের প্রতিটি কোণার মানুষের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। মোদ্দাকথা, ইসরায়েলিদেরকে খেয়ে-পরে চলার জন্য পুরোটাই নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি সাহায্যের উপর। দশকের শেষ দিকে ইসরায়েল চেষ্টা করছে এই বাজে অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য, ঠিক তখনই ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে হাজির হলো প্রায় ৮ লক্ষ ইহুদি। সংখ্যাটা বেশ কম মনে হলেও তৎকালীন সময়ে ইসরায়েলের নাজুক অবস্থাকে আরো শোচনীয় করে তুলতে এটুকুই যথেষ্ট ছিল। এখন ইসরায়েলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো একটিই- কীভাবে এতগুলো বেকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে? ইসরায়েলের হাতে একটাই উপায়, পুরো অর্থনীতি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।

প্রথমদিকে ইসরায়েল সরকার চেষ্টা করলো উদ্যোক্তাদেরকে নতুন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য, কিন্তু যে দেশে টাকাই নেই সেখানে কীভাবে নতুন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবে? আর কে-ই বা ইসরায়েলের মতো হাঙ্গামাপূর্ণ দেশে তাদের মূল্যবান অর্থ বিনিয়োগ করবে? আর তখনই সরকার বুঝতে পারলো যে একমাত্র আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া সম্ভব। আর সেখান থেকেই শুরু হলো ‘ইয়জমা প্রোগ্রাম’।

লেজার প্রজেকশন কী-বোর্ড তৈরি হয়েছে ইসরায়েলেই; Image Source: Youtube

হিব্রু ভাষায় ইয়জমার অর্থ হচ্ছে উদ্যোগ। এই পরিকল্পনার অধীনে ইসরায়েল সরকার ১০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ১০টি ফান্ড তৈরি করলো। বহিরাগত কোম্পানির প্রতি ১২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পিছনে ইসরায়েল সরকার ৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার মাধ্যমে কোম্পানির ৪০% মালিকানা দখলে রাখবে। যদি এখান থেকে লাভ হয়, তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান সামান্য সুদসহ সরকারের টাকা পরিশোধ করে সম্পূর্ণ কোম্পানির মালিক হয়ে যেতে পারবে, অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের জন্য পুরোটাই লাভ। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে ইসরায়েল সরকারের কোনো লাভ নেই মনে হলেও নতুন কোম্পানি আর কর্মসংস্থানের ফলে অর্জিত ট্যাক্স থেকেই সরকারের বিনিয়োগের খরচ উঠে যাবে।

আর এই পরিকল্পনার বাস্তব ফলাফল এর চেয়ে ভালো হওয়াও সম্ভব ছিল না। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো ইসরায়েলে বিনিয়োগ করা শুরু করলো, যেকোনো আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্যই টাকার বরাদ্দ রয়েছে। প্রথম আট বছরের মধ্যেই ফান্ডের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ থেকে ৫১৩ তে! আর ফলাফল? ইসরায়েলকে এখন ধরা হয় উদ্যোক্তাদের রাজধানী হিসেবে, এবং পরিসংখ্যানুযায়ী, প্রতিটি কোম্পানির প্রতিটি কর্মীর পিছনে প্রতি বছর ১৫০ মার্কিন ডলার করে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। তুলনা করা হলে, এটি স্পেনের একজন উদ্যোক্তার পেছনে বিনিয়োগের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি! আর শুধু টাকাই নয়, টাকার সাথে সাথে যোগ হচ্ছে অভিজ্ঞতার পাহাড়ও।

জেরুজালেম টেকনোলজি পার্ক; Image Source: Wikimedia Commons

অভিবাসন নীতি   

কোনো দেশের জনসংখ্যা অভিবাসীদের উপর নির্ভরশীল, প্রশ্নটির উত্তর নিঃসন্দেহে হবে ইসরায়েল। আদতে প্রতি ৩ জন ইসরায়েলির একজন বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে! এবং প্রতি ১০ জনের ৯ জনই অভিবাসী এবং অভিবাসীদের সন্তান-সন্ততি। আর এটিই প্রমাণ করে কীভাবে স্বাধীনতার সত্তর বছরের মধ্যে একটি দেশের জনসংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে গেল। ইসরায়েলের সংবিধান অনুযায়ী,

প্রত্যেক ইহুদির ইসরায়েলে বাস করার অধিকার রয়েছে

প্রত্যাবর্তনের আইন, ধারা ১

আর এই নীতিকে কোনো ছোটখাট জিনিস মনে করলে ভুল করে থাকবেন। জরিপ অনুযায়ী, যে দেশে অভিবাসীর সংখ্যা যত বেশি, সে দেশ ঠিক ততটাই ধনী। কারণ, অভিবাসীদের মধ্যে উদ্যোগ নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা এই ইহুদিদের সম্মেলন নতুন নতুন আইডিয়া বের করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ইসরায়েলে অভিবাসীদের আগমন; Image Source: Wikimedia Commons

শিক্ষাব্যবস্থা

ইসরায়েলের এই বিরাট সাফল্যের মূল কারণ হচ্ছে এর শিক্ষাব্যবস্থা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হওয়ার ৩০ বছর আগেই ইহুদিরা জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠা করে ‘দ্য হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেম’। বর্তমানে কলেজ ডিগ্রি অর্জনের দিক থেকে ইসরায়েল রয়েছে একেবারে প্রথমসারিতে। আর অন্য দেশ থেকে ইসরায়েলকে যা আলাদা করা হয়েছে তা হলো এর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

ইসরায়েলের একটি রসায়ন ল্যাবরেটরিতে ছাত্ররা; Image Source: The Times of Israel

ইসরায়েলের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে একেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে আবার রয়েছে বিভিন্ন বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফলে একজন শিক্ষার্থী যে শুধুই শিক্ষা গ্রহণ করে তা-ই নয়, বরং একইসাথে পেশাদার গবেষক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে ছাত্রাবস্থাতেই বের হয়ে আসে একেকজন উদ্যোক্তা, যার মাথায় ঘুরতে থাকে অসাধারণ সব আইডিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এসব গবেষণা আর উদ্ভাবনের মাধ্যমেই ইসরায়েল নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিধর দেশ হিসেবে।

আশির দশকের বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ইসরায়েল তাদের জনসংখ্যা দুই গুণ বাড়িয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে চার গুণ, জিডিপির দিক থেকে ছাড়িয়ে গেছে স্পেন কিংবা ইতালির মতো উন্নত দেশকে। সর্বোপরি, প্রযুক্তি বিশ্বকে নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে তারা। বর্তমান যুগ হচ্ছে প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির উন্নয়ন ছাড়া কোনো দেশের উন্নতি একপ্রকার অসম্ভব। ইসরায়েলকে মডেল হিসেবে ধরে অন্যান্য দেশও কি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে চোখ ফেলবে? আপনার কী মনে হয়?

ইসরায়েলি-সুইস কোম্পানি স্পেসফার্মা কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে কর্মরত একজন গবেষক; Image Source: Reuters

ফিচার ইমেজ: The Times of Israel

Related Articles

Exit mobile version