বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি রাষ্ট্রের নাম আমেরিকা ও চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা একটা লম্বা সময় ধরে তার তৎকালীন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি দ্বিকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজিবাদী বিশ্বের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিল। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে৷ পূর্ব ইউরোপে আত্মপ্রকাশ করে পনেরটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আমেরিকার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো একক কোনো দেশ ছিল না। বিশ্ব প্রবেশ করে এককেন্দ্রিক বিশ্বের যুগে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে এত বেশি উন্নতি করেছে যে, তা আমেরিকার আধিপত্য খর্ব করার মতো অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ও চীনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন আর পর্দার আড়ালের কোনো ব্যাপার নয়।
আমেরিকা ও চীন– বর্তমান বিশ্বের দুটি শক্তিশালী দেশই একে অপরের উপর নজরদারি চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিপক্ষ কী করছে– সেটি সম্পর্কে যদি আপনার পরিস্কার ধারণা থাকে, তবে প্রতিপক্ষকে আটকানোর ছক কষতে সেটি দারুণ সহায়ক হবে। দুটি দেশই অর্থনৈতিক কিংবা সামরিকসহ সব ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনের দিক জোর দিয়েছে৷ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আমেরিকা অনেকবারই চীনের বিপক্ষে ‘অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি’র অভিযোগ এনেছে। অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি হচ্ছে এমন এক পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে একপক্ষ অপরপক্ষের মেধা সম্পত্তি চুরি করে থাকে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, আমেরিকার কোনো প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোনো ডিভাইসের নতুন একটি মডেলের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়া তৈরির পেছনে সময় গিয়েছে, বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এখন সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সেই ডিভাইসের খসড়াটি হাতিয়ে নিতে পারে, তবে সেই প্রতিষ্ঠানটির সময় ও অর্থ– দুটোই বেঁচে যাবে। এটি অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তির একটি উদাহরণ।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্বের সব প্রেসিডেন্টের তুলনায় সবচেয়ে বেশি চীনবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। আমেরিকাকে নামিয়েছিলেন চীনের বিরুদ্ধে তীব্র অর্থনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে। ২০১৮ সালে মার্কিন বিচার বিভাগ মেধা সম্পত্তির চৌর্যবৃত্তি ও অন্যান্য ঘরানার গুপ্তচরবৃত্তি রোধ করার জন্য নতুন এক অভিযান শুরু করে। প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যে মার্কিন গোপন তথ্য ও অর্থনৈতিক মেধা সম্পত্তি চুরির জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে– সেটি এই পরিকল্পনায় বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। এটি নিছক গুজব কিংবা চীনাভীতির উপর ভিত্তি করে নেয়া কোনো অভিযান ছিল না। বিশ্বস্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বার বার চীনা গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধে দেয়া প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই আমেরিকার বিচার বিভাগ এমন একটি অভিযান শুরু করে। এফবিআই এর ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার রে বলেছিলেন বর্তমানে তাদের হাতে প্রায় ২,০০০ কেইস আছে চীনা গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত। এছাড়াও প্রতি বারো ঘন্টায় একটি করে এই ধরনের কেইস তাদের হাতে আসছে।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা বংশোদ্ভূত অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক পড়াশোনা, শিক্ষকতা এবং গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে। মূলত তারাই তৎকালীন মার্কিন এটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘চায়না ইনিশিয়েটিভ’ এর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল চীন এই ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে আমেরিকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর গোপন তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে।
আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে এই অভিযান গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় এই অভিযান কার্যকরী তো হচ্ছেই না, বরং এটি আমেরিকায় অবস্থানরত এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের বিরুদ্ধে জাতিঘৃণার একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এছাড়া এই অভিযানের অনেক বিষয়ই ঠিকমতো বিচার-বিবেচনা করা ব্যতিরেকে গ্রহণ করা হয়েছিল, যার ফলাফল ডেকে এনেছিল বিপর্যয়। মূলত যেসব ছাত্র ও শিক্ষক চীনা অর্থায়নের বিষয়টি ঠিকমতো উল্লেখ করতে পারেননি কিংবা তাদের কাগজপত্রে কোনো ছোটখাট ভুল ছিল, তাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। অর্থাৎ ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে যাদেরকে এই অভিযানে বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়াস চালানো হচ্ছিল, তাদের মূল অপরাধ ছিল তাদের কাগজপত্রে কিছু গুরুত্বহীন ভুল পাওয়া গিয়েছিল কিংবা চীনা অর্থায়নের ব্যাপারটি উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এসব ভুলের সাথে জাতীয় নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
চীনা বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযান শুরু থেকেই নিন্দার সম্মুখীন হতে থাকে। বিভিন্ন অধিকার আদায়ে সোচ্চার সংস্থা ও সংগঠন এই অভিযানের বিরুদ্ধে লেখালেখি ও আলোচনা শুরু করে। অনেকে বলতে থাকেন, এখন এমন একটি সময় চলছে, যে সময়ে এশীয়দের বিরুদ্ধে (বিশেষ করে চীনাদের বিরুদ্ধে) জাতিঘৃণা থেকে উৎসারিত অপরাধের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে মার্কিন বিচার বিভাগের নেয়া এই অভিযান যে মার্কিন সমাজে প্রোথিত জাতিঘৃণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করলো। জাতিঘৃণা থেকে উৎসারিত অপরাধের সাথে জড়িতদের এই আইন অনুপ্রাণিত করবে– এরকম কড়া অভিযোগও আনা হয় অনেকের পক্ষ থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল, তারা সবাই ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত ছিলেন, কারও সাথে চীনা সরকারের সাথে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি।
অভিযানের স্বরূপটি ছিল এমন, কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চীনা বংশোদ্ভূত ব্যক্তির বিপক্ষে অভিযোগ আনা হতো। এরপর চলতো অনুসন্ধান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিপক্ষে ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগেই আদালত পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভিযোগে অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদান করে দিয়েছে। আবার যাদের বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হতো, তারাও শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়ে যেতেন। অথবা দোষী সাব্যস্ত হলেও এমন অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হতেন, যার সাথে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার কোন সম্পর্ক নেই। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছিল। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর চার্লস লিবারের কথা বলা যায়। কিন্তু প্রায় সবাই শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হন।
এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় মার্কিন বিচার বিভাগ অভিযানের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় এক মাস ধরে এই অভিযানের সবকিছু পুনর্বিবেচনা করা হয়। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাথিউ ওলসেনের আদেশে ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তবে তিনি বলেছিলেন এই অভিযান শুরু করার উদ্দেশ্য ঠিকই ছিল, কিন্তু সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না হওয়ায় অভিযান ভিন্নপথে ধাবিত হয়। এছাড়া ওলসেন তার বক্তব্যে এই অভিযানের ফলে এশীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী ও অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মধ্যে ভয়ের আবহ তৈরি হওয়ায় মার্কিন গবেষণা ও অ্যাকাডেমিয়া পরিমন্ডলে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেটিও উল্লেখ করেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয় আদালতে ভুল প্রমাণিত হয়, নাহলে অভিযোগ তুলে নেয়া হয়।
চায়না ইনিশিয়েটিভ ছিল আমেরিকার সরকারি কর্মকর্তাদের ক্রমবর্ধমান চীনাভীতির প্রাতিষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ। এই অভিযান এমন একসময়ে ঘটছিল, যখন আমেরিকায় মেরুকরণ ক্রমাগত বাড়ছিল, জাতিবিদ্বেষ পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় কদর্য রূপ ধারণ করছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীন ও আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি অন্যান্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নেয়া ‘ম্যাক্সিমাম প্রেশার’ নীতির অংশ হিসেবে নেয়া এই অভিযান যেন ট্রাম্পের শাসনেরই সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যথাযথ পরিকল্পনা না করায় এই অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।