২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানের অদূরে সংঘটিত একটি আক্রমণে ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ‘অর্গানাইজেশন অফ ডিফেন্সিভ ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ’–এর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসিন ফাখরিজাদে খুন হন। ফাখরিজাদে ছিলেন একজন পরমাণু বিজ্ঞানী এবং ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে ইরানি সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ এই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী, এবং তাদের পরিকল্পনায় কিছু ইরানি ও ইসরায়েলি নাগরিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, এত গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানীর সুরক্ষার জন্য ইরানি সরকার কি কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি? বিদেশি গুপ্তচররা কীভাবে একটা দেশের ভিতরে ঢুকে সেই দেশের এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিকে খুন করতে পারে?
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে, ইরানি সরকার অন্তত বাহ্যিকভাবে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইরানি পরমাণু প্রকল্প এবং প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইরানি সরকার পৃথক একটি সংস্থাই সৃষ্টি করেছে। এই সংস্থাটির নাম ফার্সি ভাষায় ‘عقاب ۲’, যেটি ইংরেজিতে ‘ওঘাব ২’ (Oghab 2) হিসেবে লেখা হয়ে থাকে। ফার্সি ভাষায় ‘ওঘাব’ শব্দটির অর্থ ঈগল। ওঘাব ২ সংস্থাটিকে ইরানের ‘পারমাণবিক গোয়েন্দা সংস্থা’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এটি একটি ‘কাউন্টার–ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’, অর্থাৎ শত্রুপক্ষের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার চেয়ে শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা কার্যক্রম থেকে ইরানি পরমাণু প্রকল্পকে রক্ষা করাই সংস্থাটির মূল দায়িত্ব।
১৯৫০–এর দশকে শাহের শাসনামলে মার্কিন ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে ইরানি পরমাণু প্রকল্প শুরু হয়, এবং ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্কিনপন্থী শাহের পতন ঘটে, এবং তদস্থলে ইরানে আনুষ্ঠানিকভাবে তীব্র মার্কিনবিরোধী ও ইসরায়েলিবিরোধী একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু ১৯৯০–এর দশকে ব্যাপক রুশ ও চীনা কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় ইরানের পরমাণু প্রকল্পে গতিসঞ্চার হয়। ২০০০–এর দশকের প্রথমদিকে ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’ জানায় যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করেছে। ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে নিরস্ত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনাকে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোসাদ ইরানি পরমাণু প্রকল্পকে প্রতিহত করার জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, এবং ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আমান’ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করে। মোসাদের এই পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে– ইরানি পরমাণু প্রকল্পে অন্তর্ঘাত (sabotage) চালানো, এবং এর মধ্য দিয়ে প্রকল্পটির অগ্রগতি যতদূর সম্ভব বাধাগ্রস্ত করা।
২০০০–এর দশকের প্রথমদিকে ইরানি সরকার দুইজন বিদেশি গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করে। এরা ইরানের পারচিন ও লাভিজানে অবস্থিত গোপন পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছিল। এই ঘটনা থেকে ইরানি সরকার বুঝতে পারে যে, তাদের পরমাণু প্রকল্পের গোপনীয়তা রক্ষা ও নিরাপত্তা বর্ধিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকে ইরানি সরকার ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ‘ওঘাব ২’ সংস্থাটি সৃষ্টি করে। সংস্থাটি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র (Islamic Revolutionary Guard Corps) অধীনস্থ, কিন্তু এরা রিপোর্ট করে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স’–এর অন্তর্ভুক্ত ‘কাউন্টার–ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট’–এর নিকট। বিশ্লেষকদের মতে, এরকমভাবে একটি সংস্থার অঙ্গসংগঠন অন্য কোনো সংস্থার কাছে রিপোর্ট করা সাধারণভাবে বিরল হলেও ইরানে একটি প্রচলিত ব্যাপার।
ওঘাব ২–এর প্রথম প্রধান ছিলেন জেনারেল রেজা গোলাম মোহরাবি। তিনি ২০০৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন। এরপর বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আহমাদ ওয়াহিদি জেনারেল মোহরাবিকে প্রতিস্থাপিত করেন এবং ওঘাব ২–এর নতুন প্রধান নিযুক্ত হন। তার অধীনে জেনারেল আকবর দিয়ানাতর ফার এবং জেনারেল আলী নাকদি সংস্থাটির উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেনারেল আকবর ইতিপূর্বে বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনে’ এবং জেনারেল নাকদি ইরানি পুলিসের ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে’ কর্মরত ছিলেন। এটি হচ্ছে ওঘাব ২–এর সিনিয়র কর্মকর্তাদের ব্যাপারে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য। বর্তমানে এরাই সংস্থাটির দায়িত্বে আছেন, নাকি নতুন কেউ এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সেটি জানা যায়নি।
ধারণা করা হয়, ওঘাব ২–এর প্রায় ১০,০০০ কর্মী রয়েছে। সংস্থাটির দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে– ইরানি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ইরানি পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে চলমান বিদেশি গোয়েন্দা কার্যক্রম প্রতিহত করা, বিদেশি কোনো সংস্থা যাতে ইরানি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা এবং বিদেশি গুপ্তচররা ও দেশি বিশ্বাসঘাতক/পক্ষ পরিবর্তনকারীরা যাতে ইরানি পরমাণু প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য বাইরে পাচার করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
এর পাশাপাশি ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সুরক্ষা প্রদান করাও ওঘাব ২–এর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীরা যাতে পক্ষ পরিবর্তন করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখাও ওঘাব ২–এর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত, কারণ ইতিপূর্বে ইরানি বিজ্ঞানীদের পক্ষ পরিবর্তনের নজির রয়েছে। এজন্য ওঘাব ২ সদস্যরা বিদেশে সফররত ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর কড়া নজরদারি করে থাকে। সামগ্রিকভাবে, ওঘাব ২–এর কার্যপরিধি বেশ বিস্তৃত।
সংস্থাটির কার্যক্রম খুবই গোপনীয়, এবং এজন্য সংস্থাটির অন্যান্য বিষয়ের মতো সদস্যদের বাছাই প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণ সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইরানের ‘মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স’ সদস্যদের রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর’ প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ওঘাব ২ যেহেতু মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সের কাছেই রিপোর্ট করে থাকে, সেহেতু এটি সম্ভব যে, ওঘাব ২ সদস্যরাও রুশদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।
অবশ্য ওঘাব ২ তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কতটুকু সফল, এটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ, তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো ইরানের পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে গুরুতর অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এগুলোর ফলে ইরানের পরমাণু প্রকল্প বন্ধ না হয়ে গেলেও তাতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে কতিপয় ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী আর্দেশির হোসেইনপুর নিজের বাড়িতে বিষ প্রয়োগের ফলে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৯ সালে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী শাহরাম আমিরি সৌদি আরবে হজ্ব পালনকালে নিখোঁজ হয়ে যান, এবং পরবর্তীতে জানা যায় যে, তিনি পক্ষ পরিবর্তন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মাসুদ আলিমোহাম্মাদি গাড়ি বোমা হামলায় নিহত হন। একই বছরের নভেম্বরে ইরানি পরমাণুবিদ মাজিদ শাহরিয়ারি বোমা বিস্ফোরণের ফলে নিহত হন এবং আরেক পরমাণু বিশারদ ফেরেদুন আব্বাসি গুরুতরভাবে আহত হন।
২০১১ সালের জুলাইয়ে ইরানি পরমাণু প্রকৌশলী দারিয়ুস রেজায়িনেজাদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আরেক ইরানি পরমাণুবিদ মোস্তফা আহমাদি রোশান গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। সর্বশেষ ২০২০ সালের নভেম্বরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসিন ফাখরিজাদে গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত হন। ইরানি সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মোসাদ এবং তাদের স্থানীয় প্রক্সিরা জড়িত।
অর্থাৎ, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ছয় জন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোসাদের হাতে খুন হয়েছেন এবং অন্তত একজন পরমাণু বিশারদ ইরান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তাত্ত্বিকভাবে, ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সুরক্ষা প্রদান করা এবং তাদেরকে পক্ষ পরিবর্তন থেকে বিরত রাখা ওঘাব ২–এর দায়িত্ব। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ওঘাব ২ ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এবং সাধারণ বিজ্ঞানীদের তো বটেই, ফাখরিজাদের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করতেও তারা সক্ষম হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ২০১২ সালের পর মোসাদ যে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত ছিল, তার পেছনে ওঘাব ২–এর দক্ষতার ভূমিকা সামান্যই।
বস্তুত ইরানের অভ্যন্তরে প্রতিটি খুন করার জন্যই মোসাদকে বেশকিছু ইরানি এজেন্টের পরিচয় ফাঁস করে দিতে হচ্ছিল, এবং এত মূল্যবান এজেন্টদের হারাতে মোসাদ আর আগ্রহী ছিল না। ২০২০ সালে ফাখরিজাদেকে খুন করার মধ্য দিয়ে মোসাদ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা এখনো ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের খুন করতে সক্ষম। এর মধ্য দিয়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ওঘাব ২ অতীতের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত বা বিস্তৃত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
মোসাদ কর্তৃক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের খুনের ঘটনা ছাড়াও ইরানি পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে আরো অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটেছে, এবং সেক্ষেত্রেও ওঘাব ২ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ২০০০–এর দশকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ‘অলিম্পিক গেমস’ নামক একটি যৌথ প্রকল্প গ্রহণ করে, এবং ‘ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস’–এর অন্তর্গত ‘ইউনিট ৮২০০’ নামক সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ও সাইবার ওয়ারফেয়ার ইউনিট এই প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। তারা ‘স্টাক্সনেট’ (Stuxnet) নামক একটি জটিল কম্পিউটার ভাইরাস সৃষ্টি করে এবং সেটিকে ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। এর লক্ষ্য ছিল ইরানি পরমাণু প্রকল্পের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো এবং সম্ভব হলে সেটি রুদ্ধ করে দেয়া।
ইরানি পরমাণু প্রকল্প তো বটেই, এই ভাইরাসটি ইরানের ৫৮% কম্পিউটারকে আক্রান্ত করে ফেলে। এই ভাইরাসের কারণে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের কার্যক্রমের গতি শ্লথ হয়ে যায় এবং বিশেষত অতি গুরুত্বপূর্ণ নাতাঞ্জ ও বুশেহর পরমাণু কেন্দ্রের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ধারণা করা হয়, ২০০৯ সালে নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে সংঘটিত একটি গুরুতর দুর্ঘটনার জন্যও এই ভাইরাস দায়ী ছিল। সামগ্রিকভাবে, স্টাক্সনেট ভাইরাস ইরানি সরকারের জন্য বড় একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাত্ত্বিকভাবে, ইরানি পরমাণু প্রকল্পকে এরকম অন্তর্ঘাত থেকে রক্ষা করা ওঘাব ২–এর দায়িত্ব। অবশ্য ওঘাব ২–এর কোনো সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট আছে কিনা, কিংবা থাকলেও সেটি কতটুকু কার্যকর, এটি জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাদের সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট থাকুক আর না থাকুক, এটি স্পষ্ট যে, ওঘাব ২ (এবং ইরানের অন্যান্য সংস্থা) স্টাক্সনেট ভাইরাস নির্মূল করা তো দূরে থাকুক, এটি শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে রুশ সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ‘ক্যাসপারস্কি ল্যাব’ এই ভাইরাস শনাক্ত করে এবং এটি থেকে ইরানি কম্পিউটারগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য ইরানি সরকারকে সহায়তা করে।
২০১৮ সালে ইরানি পরমাণু প্রকল্পে আরেকটি অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটে। সে বছর ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ফাঁকি দিয়ে ইরানের অতি গোপনীয় পারমাণবিক আর্কাইভ থেকে প্রায় ৫৫,০০০ নথির স্ক্যানকৃত কপি ও কমপ্যাক্ট ডিস্ক সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়, এবং সেগুলোকে ইরানের বাইরে পাচার করে দেয়। ইরানি পরমাণু প্রকল্প সম্পর্কে প্রচুর গোপন তথ্য এই নথিপত্র থেকে ফাঁস হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইরান বরাবরই পরমাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু এই নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, ১৯৯০–এর দশকেই ইরান ‘প্রোজেক্ট আমাদ’ নামক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একটি সংবাদ সম্মেলনে নাটকীয়ভাবে ইরানি পারমাণবিক আর্কাইভের এই নথিপত্র জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। এটি ছিল ইরানি সরকারের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর। কারণ, একে তো এর মধ্য দিয়ে ‘ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না’– ইরানি সরকারের এরকম বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তদুপরি এর মধ্য দিয়ে ইরানি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অকার্যকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য ইরানি সরকার এরকম কোনো পারমাণবিক আর্কাইভের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষক ইরানি পারমাণবিক আর্কাইভ হস্তগত করাকে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের একটি বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন।
তাত্ত্বিকভাবে, ইরানের পারমাণবিক আর্কাইভ রক্ষা করার দায়িত্ব ওঘাব ২–এর, কারণ ইরানি পরমাণু প্রকল্প সংক্রান্ত যাবতীয় কিছুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই সংস্থাটি সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্য দিয়ে সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, কারণ সংস্থাটির ভেতরের কেউ ইসরায়েলিদের সহযোগিতা করে না থাকলে ইরানি পারমাণবিক আর্কাইভ হস্তগত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
অবশ্য এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থারই ব্যর্থতার নজির রয়েছে, সুতরাং এই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে ওঘাব ২–এর ব্যর্থতা সংস্থাটিকে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য হিসেবে প্রমাণ করে না। কার্যত এখন পর্যন্ত সংস্থাটি ইরানি পরমাণু কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে, এবং এখনো এই কেন্দ্রগুলোর ওপর কোনো শত্রু সংস্থা/সংগঠন সরাসরি কোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে পারেনি। এর পাশাপাশি এটিও উল্লেখ্য যে, বারবার অন্তর্ঘাতের মুখোমুখি হওয়া এবং ওঘাব ২–এর ব্যর্থতার পরেও ইরানি পরমাণু প্রকল্প সচল রয়েছে। ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবে, এটিকে এখন একটি নিকট ভবিষ্যতের ব্যাপার হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বীরা, বিশেষত ইসরায়েল, ইরানকে একটি পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে মোটেই ইচ্ছুক নয়, এবং এজন্য ভবিষ্যতে ওঘাব ২ নতুন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হতে পারে।