আচ্ছা, বলুন তো, আপনি কোনো একটি দেশে ঘুরতে গেলে সাধারণত কী দেখে তার পরিচয়টা জানতে পারবেন? এর সংস্কৃতি? ঐতিহ্য? আসলে না! শব্দগুলো একটু কঠিন হয়ে গেল। এগুলো লক্ষ্য করতে এবং বুঝে উঠতে বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। কোনো দেশে যাওয়ার পরপরই আপনি রাস্তাঘাটে সেই দেশের নিজস্ব পতাকা, আমজনতার পোশাক-পরিচ্ছদ, আর খাবারদাবারের ঘ্রাণ থেকেই তার পরিচয়টা বুঝে নিতে পারেন। তবে একটি দেশে গিয়ে যদি অন্য কোনো দেশের ভাবসাব দেখেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়? এই যেমন ধরুন, অন্য দেশের পতাকায় সজ্জিত পথঘাট। জামাকাপড় তো ভিনদেশীদের মতো আছেই, আবার আশপাশ থেকে আসা খাবারের গন্ধও ভিনদেশীদের খাদ্যের মতোই।
এখন আপনার মনে হতেই পারে, অন্য দেশের বা অঞ্চলের সাজে কোনো দেশ কিংবা শহর কেনই বা সজ্জিত হতে যাবে? আসলেই এরকম স্থান থাকা সম্ভব? হ্যাঁ! এ ধরনের একটি শহর আসলেই আছে। বলছি, ইতালির উত্তরের শহর শিওর কথা। যে শহর বছরে শুধু একদিনের জন্য ব্রিটেনের সাজে সজ্জিত হয়। এ যেন গ্রেট ব্রিটেনের একটি ছোট সংস্করণ! আপনি যে ইতালির কোন শহরে আছেন তা বোঝাই অসম্ভব হয়ে পড়ে এই সময়। শিও শহর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘দ্য ম্যানচেস্টার অব ইতালি’ হিসেবেও পরিচিত।
এখন জানার বিষয় হলো, কেন এই শিও একদিনের জন্য ব্রিটেনের রুপধারণ করে? আর শহরটির এমন উপাধির পেছনের রহস্যটা কি?
এখানে একদিন বলতে আসলে ‘ব্রিটিশ ডে শিও’র কথা বলা হচ্ছে, যে উৎসবে শিওর অধিবাসীরা নিজেদেরকে ব্রিটিশ হিসেবে ঘোষণা করে, আর অতীত ও আধুনিক যুগের বিভিন্ন খ্যাতনামা চরিত্রের রুপ ধারণ করেন। ভিন্ন সময়ের ব্রিটিশ রানীদের সাথেও একবারে দেখা হয়ে যেতে পারে! একটি বিশেষ পত্রিকাও এ সময় প্রকাশ করা হয়। প্রতিবছর অক্টোবরের দ্বিতীয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই বিশেষ দিবসটি উদযাপন করা হয়। এই বছর এর শিরোনাম ছিল লা চিটা’ পিউ’ ব্রিটানিকা ডি’ইতালিয়া, যার মানে ইতালির ব্রিটিশ শহর।
ছয় বছর আগে এই ব্রিটিশ ডে পালনের বুদ্ধিটা আসে ৫১ বছরের ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ক্লডিয়া ক্যানোভার মাথায়। তিনি শিও সম্পর্কে বলেন, “এটি সবসময়ই দ্য ম্যানচেস্টার অব ইতালি নামে পরিচিত”। আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রেক্ষিতেই যে এই বিশেষ দিন পালনের বুদ্ধিটা তার মাথায় আসে তা অবাক করার মতো কোনো বিষয় নয়।
শিওর এ ধরনের উপাধি ও বিশেষ দিনটি পালনের কারণ লুকিয়ে আছে এর শিল্প-ইতিহাসের মধ্যে। একসময় শিও ম্যানচেস্টারের মতোই উল ও টেক্সটাইল উৎপাদনের মূলকেন্দ্র ছিল। এখানে কম বেতনেই দক্ষ শ্রমিক এবং প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল সহজেই পাওয়া যেত। তবে আধুনিক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য শিওবাসীদের নির্ভর করতে হতো ইংল্যান্ডের উপর। আর এই আমদানীর পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা রাখেন ভেনাসের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নিকোলো ট্রন। বিখ্যাত গণিতবিদ আইজ্যাক নিউটনের বন্ধু এবং সম্রাট জর্জের সাবেক প্রতিনিধি ট্রন ১৭১৮ সালে শিও শহরে একটি উলের কারখানা চালু করেন। ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি উন্নত হলেও শিওর অধিবাসীদের মতো দক্ষ এবং স্বল্প বেতনে কাজ করার মতো শ্রমিক না থাকায় ট্রন শিওতে নিজের কারখানা চালু করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে নয়জন প্রযুক্তিবিদকে শিওর উল কারখানায় কাজের দেখাশোনা করার জন্য নিয়ে আসেন। পরিবারসহ থাকার ব্যবস্থাও করে দেন এই শিওতেই। এর কয়েক দশক পর ট্রন এই ছোট শহরটিকে আরেকটি নতুন যন্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এর নাম ছিল ’দ্য ফ্লাইং শাটল’।
এর আবিষ্কারক জন কে ল্যাঙ্কাশায়ারের একজন যন্ত্রচালক ছিলেন। তার তৈরি ফ্লাইং শাটল দিয়ে তাঁত বুননের কাজ আরও দ্রুত করা সম্ভবপর হয়। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং খরচও কমে আসে। আর এই শাটল পরবর্তীতে স্বয়ংক্রিয় তাঁতশিল্পের পথ উন্মোচন করে। একসময় এই শিও উচ্চমানের টেক্সটাইলের জন্য খ্যাতি লাভ করে, যার দরুণ ইউরোপের ভেতরে ও বাইরে রপ্তানি করার দিক থেকে শিও এগিয়ে যায়।
বিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সেসকো ও আলেসান্দ্রো রোজি নামক পিতা-পুত্রের জুটি শহরটির টেক্সটাইল ব্যবসায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। ১৮৬২ সালে আলেসান্দ্রো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্যাবরিকা অল্টা’ নামের কারখানাটি টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে অভিনব পরিবর্তন আনতে ভূমিকা পালন করে। আলেসান্দ্রো ম্যানচেস্টারসহ গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন অংশে ভার্টিকাল উল মিল দেখে এই মিল প্রতিষ্ঠিত করার প্রেরণা পান। এটি ছিল ইতালিতে বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বড় আকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্ট এবং এই প্ল্যান্টকে ইতালির প্রথম শিল্প বিপ্লবের সংকেত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ৩৩০টি প্রতিসম জানালাবিশিষ্ট ফ্যাবরিকা অল্টা সাক্ষ্য দেয়, কয়েকশ বছর আগে শিও এবং ম্যানচেস্টারের মধ্যে প্রযুক্তিগত সংযোগ ছিল, যদিও দুটি শহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল ২,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি।
এখন ক্যানোভারের ‘ব্রিটিশ ডে শিও’র ব্যাপারটি সম্পর্কে আরেকটু বর্ণনা করা যাক। এই বিশেষ দিনটিতে ব্রিটিশদের ধাঁচে একটি রক মিউজিক কনসার্টের আয়োজন করা হয়, যার নাম ‘শিওলাইফ’। এ বিষয়ে ক্যানোভা বলেন, “২০০৭ সাল থেকে আমরা এ ধরনের কনসার্টের আয়োজন করে আসছি। এখন পর্যন্ত জেনেসিসের স্টিভ হ্যাকেট, প্রকোল হারুমের স্যার গ্যারি ব্রুকার, জেথ্রো টাল থেকে রিক ওয়েকম্যান ও অ্যান্ডারসনের মতো বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার মতো সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আমি একসময় বুঝতে পারি যে, আমরা ইতালির সবচাইতে পরিপূর্ণ ব্রিটিশ শহর। তাই এই ভিন্ন প্রকৃতির সংস্কৃতি বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার দায়িত্বও আমাদের।”
এই অনুপ্রেরণায় ক্যানোভা তার কাজটি শুরু করেন, যে বিষয়ে তিনি বিগত ছয় বছরের ভেতরেই সফলতা লাভ করেন। অর্থাৎ বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ব্রিটিশ ডে শিওর স্লোগান হলো, “স্পাইসি। ইনডিপেন্ডেন্ট। অরিজিনাল”, যা ক্যানোভার মতে এই দিবসটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। প্রতি বছর ইতালির এই ছোট শহরের জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবটিতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ২০১৭ সালে প্রায় ৩০,০০০ মানুষের সমাগমে অনুষ্ঠিত হয় এই ব্রিটিশ ডে। প্রতি বছর কোনো না কোনো ব্রিটিশ ব্যান্ড বা শিল্পীদের প্রতি উৎসর্গ করা হয় ব্রিটিশ ডে। প্রথম তিন বছর যথাক্রমে দ্য বিটলস, দ্য ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা ও পিংক ফ্লয়েডের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। গত বছর ম্যানচেস্টারের খ্যাতনামা রক ব্যান্ড ওয়াসিসকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে পালিত হয় এই দিনটি। আর এ বছর সঙ্গীতশিল্পী পিটার গ্যাব্রিয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।
ক্লডিয়া ক্যানোভা পিটার গ্যাব্রিয়েল সম্পর্কে বলেন, “তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া একজন চমৎকার ব্যক্তি। তার মূল্যবান বার্তা সকলের নিকট পৌঁছানো উচিত।” ২০১৯ সালে ব্রিটেনের কোন বিখ্যাত ব্যান্ড বা শিল্পীকে সংবর্ধনা জানানো হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সবাইকে চমকে দিয়ে আলেসান্দ্রো রোজির কথা বলেন। শিও শহরের শিল্পক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আলেসান্দ্রো রোজির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আর তার ২০০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী বছর তার প্রতিই উৎসর্গ করা হবে ব্রিটিশ ডে।
ক্যানোভার মতে, শুধু এসব শিল্পবিষয়ক কারণের জন্যই নয়, বরং আরও কারণ রয়েছে শিওকে ইতালির ম্যানচেস্টার নামে অভিহিত করার পেছনে। তার মতে, “এসব বিষয়ের সাথে শহরটির বৃষ্টির মৌসুম এবং শিওবাসীর বদমেজাজের বিষয়টা জুড়ে দিলেই তা হয়ে যায় ইতালির ব্রিটিশ সিটি।” তাছাড়া শিওবাসী ব্রিটিশবাসীর অনুকরণে তাদের খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি যেভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে শহরটিকে সত্যিকার অর্থেই ম্যানচেস্টার তথা ব্রিটেনের অংশ বলেই মনে হয়।
ব্রেক্সিট প্রচলিত এই দিবসটির উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে নাকি সেই সম্পর্কে ক্যানোভাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “অবশ্যই না। আমার মনে হয় ব্রিটেন ঐতিহাসিক দিক থেকে অবশ্যই ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। তারা অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ইইউ থেকে বের হতে চায়। তবে ইউরোপের বাকি দেশের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চায় না।” আর এই বিশ্বাসের দরুণই তিনি জানান যে, আগামী বছরগুলোতেও শিওতে ব্রিটিশ ডে পালিত হবে।