অক্টোবর, ২০০৭। জন ম্যাককেইনের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন ক্যাম্পেইনে এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে চলেছেন বারাক ওবামা। ওদিকে স্যান ফ্র্যান্সিসকোতে বসবাসরত কলেজ গ্রাজুয়েট দুই বন্ধুর মাথায় তখন ভেঙে পড়েছে দুশ্চিন্তার আকাশ। সামনের মাস থেকে তাদের বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে ২৫ শতাংশ, ভাড়া মেটাতে না পারলে হারাতে হবে ঘর। অথচ উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নে চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন জো গেবিয়া এবং ব্রায়ান চেসকি।
স্যান ফ্র্যান্সিসকোতে ডিজাইনারদের জন্য আয়োজিত আসন্ন কনফারেন্সই যেন ঘুরিয়ে দিলো তাদের সৌভাগ্যের চাকা। ডিজাইনিং স্টুডেন্ট হওয়ায় কনফারেন্সে আগত পরিচিত মুখের সাথে দেখা হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে; হলোও তা-ই। এক রাতের জন্য লিভিং রুমের মেঝেতে একটি এয়ার-বেড ম্যাট্রেস ভাড়া দিলো তারা। আর প্রথম আয়ের সূচনা করা ঐ ম্যাট্রেসটির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই পরবর্তীতে তাদের কোম্পানির নাম রাখা হয় ‘এয়ারবিএনবি’। বিএনবি বা বিঅ্যান্ডবি এর পূর্ণরূপ হলো ‘ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’।
সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারের যেসব বাড়িতে জনশূন্য অতিরিক্ত কক্ষ থাকে, তারা রাত্রিযাপনের সেবা দিতে এক রাতের জন্য রুমটি ভাড়া দিয়ে থাকেন। পরদিন সকালের নাস্তাও সেই পরিবার থেকেই দেয়া হয়। এই সেবাই মূলত বিএনবি/বিঅ্যান্ডবি নামে পরিচিত।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিফ টেকনোলজি অফিসার হিসেবে তাদের সাথে যুক্ত হলো চেসকির পুরোনো রুমমেট নাথান ব্লেচারজিক। খুটিনাটি নানা পরিকল্পনার বাস্তবায়নে ১১ই আগস্ট, ২০০৮ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলো AirbedAndBreakfast.com নামের একটি ওয়েবসাইট। যার সাহায্যে ৮০ ডলারের বিনিময়ে ছুটির দিনের ইভেন্টগুলোয় ডিজাইনারদেরকে থাকার সুযোগ দেয়া হতো। এই সেবায় শহরের ট্রাভেল গাইড অন্তর্ভুক্ত করায় অন্যান্য দেশ থেকে আগত গেস্টদের জন্য শহর ঘুরে দেখা সহজ হয়ে গেল।
একে একে সাফল্যের সাথে তিনজন গেস্টকে সেবা দেয়ার পর, ব্রায়ান ও জো ভাবলো, এবার তাদের আতিথেয়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে আরও বেশি মানুষের কাছে। বাড়তে থাকলো তাদের তালিকায় যুক্ত হওয়া হোস্টের সংখ্যা। এভাবেই বিভিন্ন বড় বড় ইভেন্টগুলোকে লক্ষ্য করে আগত অংশগ্রহণকারীদের জন্য তারা উন্মুক্ত করলো এই সেবা।
আর তখনই তাদের সামনে হাজারও সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলো ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন ক্যাম্পেইন’ উপলক্ষ্যে কলোরাডোর ডেনভার শহরে বারাক ওবামার আগমন জনসভা। সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুবই শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন বারাক ওবামা। তাই তার ভাষণ শুনতে শহরটিতে উপস্থিত হতে আগ্রহী সম্ভাব্য অতিথি ও সমর্থকের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। অথচ বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও প্রচলিত পদ্ধতিতে থাকার মতো ছিল কেবলই ৩০ হাজার রুম।
দুর্দান্ত সমাধান নিয়ে এগিয়ে এলো এয়ারবিএনবি। সাধ্যের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে বাসস্থান সেবা নিশ্চিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনগোষ্ঠীর নজর কাড়লো।
আবারও তাদের উৎসাহে জোয়ার এলো। পুনরায় ওয়েবসাইট চালু করার মাত্র চার সপ্তাহের ব্যবধানে, ভাড়া দিতে আগ্রহী হোস্টের সংখ্যা ০ থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ৮০০-তে! অনুষ্ঠান শেষে যদিও তাদের সাইটের ট্রাফিক কমে গেল। তবুও, হতাশ না হয়ে, নতুন উদ্যমে বিনিয়োগকারীদের সাথে দেখা করা শুরু করলেন জো ও ব্রায়ান। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে কেউই তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে রাজি হলো না।
বহু দেনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদের কোম্পানির জন্য ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টায় নামলো ব্রায়ান ও জো। বরাবরের মতোই, বিপদে আবারও আলো ছড়ালো তাদের প্রতিভার সুপ্ত প্রদীপগুলো।
নির্বাচনী আবহকে কাজে লাগিয়ে তারা তৈরি করলো দুই ধরনের ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল বক্স- যাদের একটি ছিল ওবামা, এবং অন্যটি ম্যাককেইনের সমর্থনে।
দুই প্রার্থীর তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে, রিপ্যাকেজড জেনারিক সিরিয়াল বক্স বিক্রি করে প্রাথমিক ফান্ডিংও জমিয়ে ফেলেছিল তারা। ৪০ ডলারে একেকটি বক্স বিক্রি শেষে তাদের আয় হয়েছিল ৩০ হাজার মার্কিন ডলার!
ধার-দেনাগুলো শোধ করার পাশাপাশি ‘ওয়াই কম্বিনেটর’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল গ্রাহামের চোখে পড়লো তাদের এই অভিনব ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল প্রজেক্ট। প্রতিষ্ঠানটি স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে আর্থিক ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দান করার জন্য বিখ্যাত।
এয়ারবিএনবি কোম্পানির ওপর ভরসা করতে না পারলেও, তাদের হার-না-মানা মনোভাবে মুগ্ধ হয়েছিল গ্রাহাম। গ্রাহামের মতে,
যারা ৪০ ডলার করে সিরিয়াল বক্স বিক্রি করতে পারে, তারা যেকোনো ব্যবসাকেও সফল করতে পারবে।
ওয়াই-কম্বিনেটরের প্রাথমিক ২০ হাজার ডলারের বিনিয়োগ কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ের মাঝেই ৬ লক্ষ ডলারের বিনিয়োগ পর্যন্ত পেয়ে গেল তারা। আর তাতেই অবশেষে দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে যথাযথভাবে যাত্রা শুরু করলো এয়ারবিএনবি।
বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা মধ্যআয়ের মানুষজনকে এয়ারবিএনবির মাধ্যমে আয়ের পথ বেছে নিতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করলো। চাকরির বাজারে চলা ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে অসংখ্য মানুষ যোগ দিলো এয়ারবিএনবির হোস্ট হিসেবে। সেই সাথে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিয়ে, মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়লো এয়ারবিএনবির নেটওয়ার্ক।
প্রতিটি লেনদেন থেকে মুনাফা আসায় এয়ারবিএনবির আয়ও বাড়তে লাগলো। কিন্তু, দেখা দিলো নতুন এক সমস্যা। অধিকাংশ হোস্টই বুঝতে পারছিল না, কীভাবে তাদের বাসাটিকে ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করা উচিত। ফলে, কাস্টমাররাও ঠিকমতো ভরসা করতে পারছিল না সেসব হোস্টের সেবা নিতে।
আবারও সমাধান নিয়ে এগিয়ে এলো এয়ারবিএনবি কর্তৃপক্ষ। তাদের লিস্টিংয়ে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি হোস্টের বাসায় প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার পাঠিয়ে বিনামূল্যে ছবি তুলে দেয়ার সুযোগ করে, কাস্টমারদের আস্থা ও ভরসার জায়গাটা আবারও অর্জন করে নিলো এয়ারবিএনবি।
পরবর্তী কয়েক বছরে, এয়ারবিএনবিতে আন্তর্জাতিক লিস্টিং উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করায়, বিনিয়োগকারীরা এবার নড়েচড়ে বসলো। এয়ারবিএনবির দুয়ারে বাড়তে লাগলো বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর আনাগোনা।
২০১০ সালে তারা আরও ৭.১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ গ্রহণ করলো। পরের বছর এয়ারবিএনবির বিনিয়োগকারীর তালিকায় যুক্ত হলেন সেলিব্রিটি-ইনভেস্টর অ্যাশটন কুচার।
২০১১ সাল নাগাদ, সর্বমোট ৮৯টি দেশ যুক্ত হওয়া হোস্টদের নিয়ে এয়ারবিএনবির লিস্টিং সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ১ মিলিয়ন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর সংখ্যা হলো ২ মিলিয়ন।
২০১২ সালের জুনে সে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ালো ১০ মিলিয়ন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক শহরে এয়ারবিএনবি ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেছে ১৫০ মিলিয়ন। একটি সাধারণ রাতে এয়ারবিএনবির সেবার রাত কাটায় ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ।
৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের কোম্পানিটি এখনও বেড়ে চলেছে বসন্তে সবুজ পত্রপল্লবের মতোই। এয়ারবিএনবি নামটা শুনলেই হয়তো আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কোনো ছিমছামভাবে সাজানো-গোছানো অ্যাপার্টমেন্ট বা অ্যাপার্টমেন্টের সিঙ্গেল রুমের চিত্র।
কিন্তু, কোম্পানিটির সেবার পরিধি এতটাই বিস্তৃতি পেয়েছে যে, ট্রি-হাউজ, ইগলু, সাজানো গুহা, লাইটহাউজ, ইয়ট, প্রাসাদ ও প্রাইভেট আইল্যান্ড পর্যন্ত হয়েছে এই সেবার অন্তর্ভুক্ত।
আবার, ক্ষুদ্রতম প্রয়াসের দিক থেকেও প্রতিষ্ঠানটি অনন্য। এয়ারবিএনবির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে ছোট ‘বাড়ি’র অবস্থান জার্মানির বার্লিনে। এক বর্গ মিটার ওয়াটারপ্রুফ বাড়িটিতে একজন মানুষের জন্য আছে একটি করে বিছানা, ডেস্ক ও চেয়ার। ইউরোপের সবচেয়ে কম খরুচে বাড়িটিতে এক রাত কাটাতে আপনার খরচ হবে মাত্র এক ইউরো।
মজার ব্যাপার হলো, প্রতিষ্ঠানটির সিইও ব্রায়ান চেসকির নিজের বাড়িটিও ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিল এয়ারবিএনবির লিস্টিংয়ে, যা ছিল এয়ারবিএনবির আদি হেডকোয়ার্টার। সে বাড়িতে ঐতিহাসিক এয়ার বেড ম্যাট্রেসটি পাওয়া না গেলেও, আছে পুরোনো কাউচ এবং অন্যান্য আসবাবপত্র।
প্রবৃদ্ধির হারে এয়ারবিএনবির উন্নতিকে চোখধাঁধানো বললেও হয়তো কমই হবে। প্রথম বছরে যেখানে এয়ারবিএনবির সেবা নিয়েছিলেন মাত্র ৪০০ জন গেস্ট, সেখানে বর্তমান সময়ে প্রতি পাঁচ মিনিটে এয়ারবিএনবি-র সেবা নিচ্ছেন ৯০০ জন গেস্ট। সংখ্যার হিসেবে বৃদ্ধির হার দাঁড়াচ্ছে ২৬,২৮০,০০০%
কেবল ব্যবসায়িক মুনাফায় নজর না রেখে, মানবতার টানেও এগিয়ে যাবার নজির গড়েছে এয়ারবিএনবি। ২০১২ সালে হারিকেন স্যান্ডির আঘাতে যখন লাখো মানুষ হয়েছিল ঘরছাড়া, ‘ইমার্জেন্সি ডিজেস্টার রেসপন্স অ্যান্ড রিলিফ প্রোগ্রাম’ চালু করার মধ্য দিয়ে এয়ারবিএবি তখন বিনামূল্যে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবকদের থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল।
ইরান, সুদান, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়া ব্যতীত বিশ্বের ৯৭.৯৫% দেশে রয়েছে এয়ারবিএনবির সেবা। নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বের অন্যান্য জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর মতো এয়ারবিএনবিও সম্ভবত পাবলিক হতে চলেছে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে স্টক মার্কেটে প্রবেশ করবে কোম্পানিটি।
মাথার ওপর ছাদ টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে অদম্য দুই তরুণের ছোট্ট সেই সৃজনশীল সমাধান আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাল্টি-বিলিয়ন ডলার কর্পোরেশন, যা বিশ্বজুড়ে ট্রাভেল ও ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা।
ইংরেজি A অক্ষরের মতো দেখতে এয়ারবিএনবির বর্তমান লোগো দেখলে, উল্টানো হার্ট শেপ চোখে পড়ে সহজেই। লোগোর মাঝখানের প্যাঁচটি দেখতে ম্যাপ পিনের মতো। ‘বেলো’ নামের এই লোগোটি মূলত বিশ্বজুড়ে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এক ও অভিন্ন সাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে