মানব সভ্যতা এগিয়ে গেছে বহুদূর। আধুনিকতার আলোয় পুরাতনকে ফেলে নতুন রীতিনীতিকে গ্রহণ করেছে মানুষ। ‘মধ্যযুগীয়’ কিংবা ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে বহু আদি প্রথা ও রীতিনীতিকে পরিত্যাগ করেছি আমরা। তারপরও পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখনো রয়ে গেছে সেই বর্বর প্রথাগুলোর গুমোট অন্ধকার। কোথাও ধর্মের নামে, আবার কোথাও প্রথা ধরে রাখার নামে চালু রাখা হয়েছে ‘অমানবিক’ কর্মকাণ্ড। ঠিক তেমনই একটি অমানবিক প্রথা চালু আছে ভারতের মহারাষ্ট্রে বসবাসরত কাঞ্জারভাট আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। সেখানকার নারীদের আজও বিয়ের প্রথম রাতে বা বাসর ঘরে ‘কুমারীত্বের পরীক্ষা’ দিতে হয়।
এই কুমারীত্ব পরীক্ষার পদ্ধতি আদিম যুগের যেকোনো বর্বর প্রথাকেও হার মানাবে। সেখানে বরকে যৌন উত্তেজক ঔষধ, পর্নগ্রাফি প্রদর্শন ও সমাজের জ্যেষ্ঠদের দ্বারা ‘প্রশিক্ষণ’ দিয়ে বাসর ঘরে পাঠানো হয়। বাসর ঘরের জন্য নির্ধারণ করা হয় একটি ভাড়া করা হোটেল। সেই হোটেলের বিছানায় বিছানো হয় ধবধবে সাদা একটি চাদর। স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ফলে সেই সাদা চাদর যদি ভিজে লাল হয়ে যায়, তবে প্রমাণিত হয় নববধূর কুমারীত্ব বহাল আছে।
আর যদি নববধূ এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন তবে তাকে প্রকাশ্যে অপমান-অপদস্থ করা হয়। সবার সামনে ‘অসতী’ আখ্যা দিয়ে তাকে জুতাপেটা কিংবা গণপিটুনি দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় হোটেল রুমের কথিত বাসর ঘরেই। স্ত্রী ভাগ্য জোটে না তার। এক ভয়াল অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে।
তবে স্বামী সাক্ষ্য দিলেই হবে না। সমাজের ক্ষমতাধর পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরা সেই হোটেলের সামনে অপেক্ষমাণ থাকেন। তারাই সেই সাদা চাদর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হয়। শাস্তি নির্ধারণ কিংবা বিয়ের বৈধতা প্রদানের ক্ষমতাও তাদের হাতে কুক্ষিগত থাকে।
এমন ভুক্তভোগী এক নারীর নাম অনিতা (ছদ্মনাম)। তার বর্তমান বয়স ২২ বছর। প্রায় ২ বছর আগে বাসর রাতে নিজের কুমারিত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করে এখনো প্রতিনিয়ত চোখের জল ঝরে তার। প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির কাছে সেই ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে অনিতা বলেন-
আমাদের মধ্যে বিয়ের আগেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আমাদের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এমনকি ওর সাথে আমার শারীরিক সম্পর্কও ছিল। তাই ওর ভয় ছিল যে, আমি হয়তো বিয়ের রাতে কুমারীত্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবো না। কিন্তু আমাদের কথা ছিল সেদিন ও আমার পাশে থাকবে এবং কৌশলে আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু বিয়ের দিন রাতে যা ঘটলো তা অবর্ণনীয়। সেদিন স্বামী হিসেবে ও আমার পাশে দাঁড়ায়নি। আমি এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
অনিতা আরও বলেন-
বাসর ঘর থেকে কুমারীত্ব পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর অপেক্ষমান পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরা আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলো আমি ‘সতী’ নাকি ‘অসতী’? আমার স্বামী তার হাতে থাকা চাঁদর সবার সামনে তুলে ধরে আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, ‘আমি অসতী’। অথচ বিয়ের ছয় মাস আগ থেকে ওর আশ্বাসেই আমি ওর সাথে শারীরিক সম্পর্কে রাজি হয়েছিলাম। কথা ছিল কুমারীত্ব পরীক্ষায় ও আমাকে সতী ঘোষণা করবে। কিন্তু সেই কঠিন সময়ে ও আমাকে নির্দ্বিধায় অসতী ঘোষণা করে দিল। পঞ্চায়েত কমিটি আমাকে ওর ভাষ্য অনুসারেই ‘মিথ্যাবাদী’ বলে ঘোষণা করলো।
আনিতার উপর আরোপিত এই পদ্ধতি শুধুমাত্র তার উপর নয়, কাঞ্জারভাট আদিবাসী সমাজে বসবাসরত প্রায় সকল নারীকেই এমন অমানবিক পরীক্ষা দিয়ে সংসার জীবন শুরু করতে হয়। কিন্তু কুমারীত্ব পরীক্ষার এই পদ্ধতি আসলে কতটা বিজ্ঞানসম্মত?
দিল্লীর বিশিষ্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ সানিয়া নায়েক বলেন-
প্রথমবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সময় যে নারীর যোনী থেকে রক্তপাত হবেই এমন কোনো কথা নেই। অনেক কারণেই প্রথম মিলনের সময় যোনী থেকে রক্তপাত না-ও হতে পারে। কোনো নারী যদি খেলাধুলার সাথে যুক্ত থাকে বা তিনি যদি নিয়মত ব্যায়াম করেন কিংবা হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত হন তাহলে তার প্রথম মিলনে রক্তপাত না হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে রক্তপাত না হলেই যে তিনি কুমারী নন – এমন ধারণা অবৈজ্ঞানিক।
‘অসতী’ প্রমাণ হওয়ায় অনিতার বিয়ে যখন প্রায় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম, তখন বিষয়টি বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে যায়। এতে ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো নড়েচড়ে বসে। ফলে অনিতার সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুলিশের মধ্যস্থতায় অনিতাকে ঘরে তুলে নিতে তার স্বামীকে রাজি করানো হয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি অনিতার। প্রতিদিন তার স্বামী তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করে। গ্রামের পঞ্চায়েত কমিটি নিয়মিতভাবে তাকে অপমানিত করতে থাকে। সকল প্রকার সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়।
অনিতা বলেন-
আমার গর্ভে সন্তান আসার পরও অবস্থা পাল্টায়নি। আমার স্বামী তখন আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করতো এই সন্তানের বাবা কে? অথচ সে তো ভাল করেই জানতো এই সন্তান তার। শুধু স্বামী নয়, গ্রামের পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরাও নিয়মিত এই প্রশ্ন করে আমাকে অপমানিত করার চেষ্টা করতো।
তার পরের ঘটনাগুলো আরও নির্মম। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দুই মাসের মাথায় নির্মম অত্যাচার করে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয় অনিতাকে। এখন সে পিতা-মাতার সাথে বসবাস করে। কিন্তু এতে শুধু তিনি নন, বিপদে পড়েছেন তার ছোট দুই বোনও। বড় বোন ‘অপবিত্র’ ঘোষিত হওয়ায় তাদেরও বিয়ে হচ্ছে না।
কিন্তু এসব নির্মমতা থেকে মুক্ত হতে চান কাঞ্জারভাট আদিবাসী সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা। তারা এজন্য একটি নাগরিক আন্দোলনও গড়ে তুলেছেন। তবে পঞ্চায়েত কমিটি আর প্রথা রক্ষাপন্থীদের হুমকির মুখে সেই আন্দোলন প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
এই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তারা একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার করছেন। তারা গ্রুপটির নাম দিয়েছেন ‘স্টপ দ্য ভি রিচুয়াল‘। এখানে ‘ভি রিচুয়াল’ দিয়ে ‘ভার্জিনিটি রিচুয়াল’ বোঝানো হয়েছে, যার মানে হলো ‘কুমারীত্ব পরীক্ষা’। এখন পর্যন্ত এই গ্রুপে প্রায় ৬০ জন সদস্য যোগ দিয়েছেন। সদস্যদের অধিকাংশই নারী। তবে কিছু সচেতন যুবকও তাদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ভিবিক তামাইচেকার। তার বর্তমান বয়স ২৫ বছর।
সম্প্রতি তিনি ও তার বন্ধুরা একটি বিয়ে বাড়িতে কুমারীত্ব পরীক্ষার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রথারক্ষাপন্থী আদিবাসীদের হাতে বেদম মার ও অপমানের শিকার হয়েছেন। যদিও সেই ঘটনা পুলিশকে জানানো হলে সেখান থেকে ৪০ জন আদিবাসীকে আটক করেছিল পুলিশ। তবে এসব অত্যাচার আর নির্যাতনে থেমে যেতে চান না ভিবিক তামাইচেকার। তার বিশ্বাস একদিন এই অমানবিক প্রথা তাদের সমাজ থেকে উঠে যাবে। তিনি বলেন-
এর মাধ্যমে নব দম্পত্তিদের গোপনীয়তা পুরোপুরি লঙ্ঘিত হয়। এটি একটি বর্বর ও বেদনাদায়ক প্রথা। নব দম্পতিরা যখন ভিতরে প্রবেশ করে তখন দরজার সামনে একদল লোক ফলাফল জানার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। কুমারীত্ব পরীক্ষার জন্য স্ত্রীর কাছে যাওয়ার আগে ‘প্রশিক্ষণের’ নামে স্বামীদের প্রায়ই মদ খাওয়ানো হয় এবং পর্নগ্রাফি দেখিয়ে উত্তেজিত করে তোলা হয়।
ভিবিক তামাইচেকার অন্তত নিজে এরকম নিষ্ঠুর প্রথা অবলম্বন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। তাদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রত্যেক সদস্যই এই নিষ্ঠুর প্রথা ব্যতিরেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। এই প্রথাকে তিনি সম্প্রদায়ের ‘দুর্নামের’ কারণ বলেও মনে করেন। কিন্তু শুধু তিনি বা তাদের গ্রুপ এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে এই নির্মম প্রথা নির্মূল করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, এজন্য একটি সামগ্রিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
আন্দোলনের সাথে যুক্ত নারী সদস্য প্রিয়াংকা তামাইচিকার বলেন–
একজন নারীকে আপনারা কীভাবে স্রেফ একটি পণ্য ভাবতে পারেন? আমাদের সমাজে নারীদের কোনো মূল্যই নেই। কোনো পুরুষকে কেউ কেন জিজ্ঞাসা করে না যে, আপনি কী সতী?
প্রিয়াংকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন-
নারীরা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বয়ংসম্পন্ন। আমরা এখন পুরুষের সমান। আমরা এই নির্মম প্রথা থেকে আমাদের নারীদের রক্ষা করতে চাই।