১৯৩২ সালের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীকে লুইস মেশিনগানসহ অন্যান্য সমসাময়িক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত করে অস্ট্রেলিয়ার বন-জঙ্গলে মোতায়ন করা হয়। তবে এই সেনা মোতায়নের উদ্দেশ্য কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিদ্রোহ দমন করা ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ইমু পাখির সংখ্যাধিক্য দমন করা। কারণ ঐ সময়ে প্রায়ই ইমুরা ঝাঁক বেঁধে এসে অস্ট্রেলিয়ার চাষীদের ফসলি জমির শস্য নষ্ট করে যাচ্ছিল।
আর ঐ হাজার হাজার ইমুর সামনে স্থানীয় চাষীরা ছিল সম্পূর্ণ নিরুপায়। ফলে অস্ট্রেলিয়ার সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে সেনা মোতায়েন করে। ইতিহাসে এই ঘটনাটি ইমু যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই যুদ্ধে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত মানুষের পরিবর্তে ইমুরা জয়লাভ করে। ইমু যুদ্ধে মানুষের পরাজয় ও ইমুদের জয়ের কারণ ছিল পাখিগুলোর দ্রুতগতি, সুচতুরতা ও সংখ্যাধিক্য।
কিন্তু সেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় এবং বিস্ময়কর ফলাফল ছাড়াও দুঃখজনক আরেকটি দিক রয়েছে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ ঘোষণা। আপাতদৃষ্টিতে ইমুদের আক্রমণ থেকে আবাদকৃত ফসলি জমি রক্ষার প্রচেষ্টা যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ ইমুরা তাদের বনের বাসস্থান ছেড়ে লোকালয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।
এখন যদি প্রশ্ন তোলা হয়, অস্ট্রেলিয়া নামক দ্বীপে কাদের অধিকার বেশি? মাত্র দু’শো বছর আগে আগমন করে অস্ট্রেলিয়াকে নিজের সম্পত্তি দাবি করা মানুষের, নাকি হাজার হাজার বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী ইমুদের? এ প্রশ্নের উত্তর ইমু যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেবে। কারণ একদিকে মানুষ ইমুদের আদি আবাসস্থল দখল করেছে। অন্যদিকে ইমুদের প্রতিআক্রমণ প্রতিরোধে অস্ত্র ধারণ করেছে।
তবে মানুষের এতে কিছুই আসেযায় না। কারণ প্রকৃতি ও এর জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যের চেয়ে মানুষের নিকট নিজেদের সমৃদ্ধি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগের মানবকেন্দ্রিক সভ্যতায় মানুষের হঠকারিতার এক অনন্য নিদর্শন ছিল ইমু যুদ্ধ। ঐ যুদ্ধের ন্যায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের হঠকারিতার আরেকটি নিদর্শন হলো ডিঙ্গো ফেন্স। ৫,৬১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লোহার জালের বেড়া পৃথিবীর দীর্ঘতম সীমান্ত বেড়া।
এমনকি পৃথিবীর রাজনৈতিকভাবে সদা উত্তপ্ত আন্তর্জাতিক সীমান্তগুলোতেও এত দীর্ঘ বেড়া তৈরি করা হয়নি। এটি তৈরি করা হয় দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার গবাদি পশুর খামারগুলোকে কুকুরসদৃশ ডিঙ্গোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। তবে এই বেড়া নির্মাণের ইতিহাস ও ফলাফল সম্পর্কে জানার পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য এবং এর উপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমনের কুপ্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা বেশি জরুরি।
অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য সকল অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি একে একটু অদ্ভুতুড়ে বললেও ভুল হবে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকূলের ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রাণী শুধুমাত্র ঐ দ্বীপেই স্থানীয়। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য কোথাও এদের দেখা পাওয়া যায় না। তাই পূর্বপরিচিত না হলে অস্ট্রেলিয়ার অনেক প্রাণীকে দেখে ভিনগ্রহের প্রাণী বলেও মনে হতে পারে। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীর মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলো বিভক্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া নামক দ্বীপটি অন্যান্য মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলো থেকে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তখন থেকেই দ্বীপটি এর বর্তমান অবস্থানে থিতু হয়। ফলস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীজগতের পক্ষে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের প্রাণীজগতের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়নি। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে ঐ একক ও অনন্য জীববৈচিত্র্য নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে সেই ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায় অষ্টবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে, ইউরোপীয়দের আগমনের মাধ্যমে। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে ব্রিটিশদের উপনিবেশ অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই ইউরোপীয়রা, বিশেষত ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা, ভাগ্যের খোঁজে কিংবা রোমাঞ্চের আশায় অস্ট্রেলিয়ার বুকে পাড়ি জমাতে থাকে। তবে তারা একা আসেনি।
নতুন অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি পূরণে নবাগত ইউরোপীয় উপনিবেশিকরা অস্ট্রেলিয়ার বুকে প্রথম কৃষিকাজের সূচনা করে। আর ঐ দ্বীপে আবাদযোগ্য উর্বর জমির কোনো অভাব ছিল না। তাই তারা ইচ্ছামতো জমি দখল করে চাষাবাদ শুরু করে। কিন্তু এর ফলে বনাঞ্চলের ক্ষতি কিংবা কোনো প্রাণীর আবাসস্থলের সংকোচন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ কৃষিকাজের ফলে খাদ্য ঘাটতি ভালোভাবেই পূরণ হচ্ছিল। অন্যদিকে, ইউরোপে চাষাবাদের পাশাপাশি গবাদি পশুর খামার করাও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রাণীকূলের কোনোটির মাঝেই গবাদিপশুর কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই উক্ত উপনিবেশ স্থাপনকারীরা সিদ্ধান্ত নেয়, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে গবাদি পশু আমদানি করার।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমনের পূর্বে অস্ট্রেলিয়ায় খুরবিশিষ্ট কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির খুরবিশিষ্ট প্রাণী যে লক্ষাধিক সংখ্যা নিয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এগুলো মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ঔপনিবেশিকদের দ্বারা আমদানিকৃত।
এদের কোনোটির আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া নয়। তবে সেই আমদানিকৃত গবাদিপশুর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। আর এই সফলতার প্রধান কারণ হলো চারণভূমির অতিপ্রাচুর্য। কিন্তু খামারগুলো গড়ে তোলার প্রাথমিক দিক থেকে খামারিদের একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে, ভেড়ার খামার মালিকদের।
ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত ভেড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কেননা ভেড়া যে শুধু দুধ, মাংস ও চামড়া উৎপাদনে সহায়তা করে তা নয়, বরং এর গায়ের পশম তথা উল ইউরোপীয় শীতপ্রধান দেশগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক। তাই নবাগত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা তাদের সাথে করে ভেড়া নিয়ে আসবে না, এ তো অসম্ভব। ১৭৮৮ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম ভেড়া নিয়ে আসা হয়। এর প্রায় পাঁচ বছর পর ১৭৯৩ সালে জন ও এলিজাবেথ ম্যাকআর্থার দম্পতি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ভেড়ার খামার স্থাপন করে। এরপর অস্ট্রেলিয়া অতি উর্বর অঞ্চল তথা দক্ষিণ-পূর্বের রাজ্য কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় হু হু করে ভেড়ার খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত খামার মালিকরা একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করেন। তাদের খামার থেকে নিয়মিতভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভেড়া উধাও হয়ে যাচ্ছিল। আর উধাও হওয়ার সংখ্যা মোটেও এড়িয়ে যাবার মতো না। তাই তারা এ বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখতে তৎপর হন। কিছুদিন পর তারা দেখতে পেলেন, ভেড়া উধাও হওয়ার পেছনে মূল হোতা অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রে সবার উপরে থাকা কুকুরসদৃশ হিংস্র পশু ডিঙ্গো।
“অস্ট্রেলিয়ার সবকিছু আপনাকে হত্যা করতে পারে।”
অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীজগৎ সম্পর্কে এটি একটি বহুল প্রচলিত কথা এবং এটা মোটেও মিথ্যা নয়। সাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পোকামাকড় কিংবা কুমির থেকে শুরু করে প্লাটিপাসের পায়ের বিষ, সবকিছু একজন মানুষকে মৃত্যুর অতি কাছাকাছি নিতে সক্ষম। কিন্তু এই বৈচিত্র্যময় ও ভয়ঙ্কর প্রাণী জগতের রাজা বলা চলে ডিঙ্গোকে। যদিও সিংহের রাজকীয় কেশর কিংবা শক্তিশালী থাবা কোনোটিই এদের নেই। তবে দলগতভাবে আক্রমণ করে এরা যেকোনো আকারের শিকারকে কাবু করতে পারে। মজার বিষয় হলো, ডিঙ্গোর আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া নয়। বরং প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে অ্যাবরিজিনালদের সাথে এরা অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। তারপর সময় বিবর্তনের এরা ঐ দ্বীপের খাদ্যচক্রে সবার উপরে অবস্থান করে নিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে হাজার হাজার বছর ধরে ডিঙ্গোর প্রধান খাদ্য ছিল ক্যাঙ্গারু। কিন্তু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের স্থাপিত খামারসমূহ উক্ত দৃশ্যপটে বেশ পরিবর্তন ঘটায়। কারণ বন্য ক্যাঙ্গারু শিকারের চেয়ে খামারে পালিত ভেড়া শিকার বহুগুণে সহজ। আর ডিঙ্গোগুলো সেই সহজ সুযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু মানুষ তো তাদের সম্পদ এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারে না। তাই স্থানীয় খামারি মালিকরা গুলি করাসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ডিঙ্গো হত্যা শুরু করে। কিন্তু কোনোভাবেই খামারগুলোতে ডিঙ্গোর আক্রমণের সংখ্যা কমানো সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে এর দায় বর্তায় সরাসরি সরকারের কাঁধে। কারণ অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে ঐ খামারগুলোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই সমস্যার সমাধান অত্যাবশ্যক। তবে উক্ত সমস্যা সমাধানে অস্ট্রেলিয়ার সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তা পুরো দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
ইতোপূর্বে কিছু সংখ্যক খামার মালিক ডিঙ্গো হত্যার পাশাপাশি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের খামারগুলোর চারপাশ লোহার জালের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে। বিস্ময়করভাবে তাদের খামারগুলোতে ডিঙ্গোর আক্রমণ কমে আসে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকার অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একটি নিরবচ্ছিন্ন সীমান্ত বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই বেড়া অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ভেড়ার খামারবহুল এলাকায় ডিঙ্গোর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও অনুপস্থিতি নিশ্চিত করবে। ফলে প্রত্যেক খামার মালিককে এককভাবে নিজেদের খামার লোহার জাল দিয়ে ঘেরাও করতে হবে না।
১৮৮০ সালের দশক জুড়ে ডিঙ্গো ফেন্সের নির্মাণ করা হয়। এই বেড়াটি কুইন্সল্যান্ডের জিমবুর থেকে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান বাইট পর্যন্ত ৫,৬১৪ কিলোমিটার নিয়ে বিস্তৃত। তবে একসময় এর দৈর্ঘ্য ৮ হাজার কিলোমিটার ছিল। এমনকি দৈর্ঘ্য হারাবার পরও এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম বর্ডার ফেন্স তথা সীমান্ত বেড়া। এটি নির্মাণ করতে লোহার জাল এবং খুঁটি হিসেবে কাঠ ও লোহার খুঁট ব্যবহার করা হয়েছে। এর উচ্চতা ছয় ফুট। এছাড়া মাটির নিচে আরও এক ফুট গভীর করে একে স্থাপন করা হয়েছে যাতে লাফিয়ে কিংবা মাটি খুঁড়ে কোনোভাবেই ডিঙ্গো এই বেড়া পার হতে না পারে। যেহেতু ডিঙ্গোর অনুপ্রবেশ রোধকল্পে এর নির্মাণ করা হয়েছে, তাই এর নামকরণ করা হয় ডিঙ্গো ফেন্স। এছাড়া এটি ‘ডগ ফেন্স’ নামেও পরিচিত।
সুদীর্ঘ এই বেড়া অস্ট্রেলিয়াকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। এখানে বলে রাখা ভাল, অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ মানুষ উক্ত দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেসমূহে বসবাস করে। ঐ অঞ্চলেই ব্রিসবেন, সিডনি, মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেডসহ অন্যান্য বিখ্যাত ও জনবহুল শহরগুলো অবস্থিত। ডিঙ্গো ফেন্স অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়া রাজ্যদ্বয়কে সম্পূর্ণরূপে এবং কুইন্সল্যান্ড ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যদ্বয়কে আংশিকরূপে পুরো অস্ট্রেলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তবে গাড়ি চলাচল করার জন্য বিভিন্ন স্থানে গেট রয়েছে। সুতরাং এই বেড়া মানুষ ব্যতীত ডিঙ্গো কিংবা অন্যান্য প্রাণীর জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
ডিঙ্গো ফেন্স নির্মাণের পর অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবশিষ্ট অধিকাংশ ডিঙ্গো হত্যা করা শুরু হয়। অন্যদিকে এ বেড়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে ডিঙ্গো আগমন বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ডিঙ্গোর অস্তিত্ব একেবারেই অপ্রতুল। সুতরাং বলা চলে যে, ডিঙ্গো ফেন্স নির্মাণের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সরকার তার উদ্দেশ্যে প্রায় শতভাগ সফল হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত উক্ত সাফল্যের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব বনাঞ্চল জীববৈচিত্র্য আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
বাস্তুতন্ত্র হলো বনের প্রধান চালিকাশক্তি। একটি বনের বাস্তুতন্ত্রের সকল উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্কের ভারসাম্য বনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। একইভাবে সেই সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা বনের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকা বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। আর তাদের উক্ত স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হল ডিঙ্গো ফেন্স। বর্তমানে এই বেড়ার বদৌলতে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ডিঙ্গো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে, উক্ত অঞ্চলে ক্যাঙ্গারু সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংখ্যা বৃদ্ধি বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে।
ডিঙ্গো ক্যাঙ্গারু খায় এবং ক্যাঙ্গারু খায় ঘাস। এটা অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মসমূহের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ডিঙ্গো ফেন্স অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেসমূহে উক্ত প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দিয়েছে। ডিঙ্গোর সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঐ রাজ্যসমূহে ক্যাঙ্গারুর সংখ্যা বর্তমানে আকাশচুম্বী। আর এই অধিক সংখ্যক ক্যাঙ্গারু নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য অধিক মাত্রায় ঘাস ও লতাপাতা ভক্ষণ করছে। ফলে, উক্ত বনাঞ্চলের তুলনামূলক ক্ষুদ্রকায় তৃণভোজী প্রাণীগুলো খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। এমনকি খাদ্য সংকটের দরুন এদের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
ক্যাঙ্গারুর সংখ্যাবৃদ্ধি শুধু যে অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর খাদ্য সংকট ঘটিয়েছে তা নয়। প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র যেকোনো বনাঞ্চলের মাটির উর্বরতা রক্ষায় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ডিঙ্গো ফেন্স সেই চক্র সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ক্যাঙ্গারুর অতিচারণের ফলে মাটির উর্বরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে ক্যাঙ্গারু ঠিকই নিজেদের চাহিদা মতো ঘাস ও লতাপাতা ভক্ষণ করছে। কিন্তু উক্ত অঞ্চলের অনুর্বর মাটি আর আগের মতো তৃণলতা উৎপাদন করে পারছে না। ফলস্বরূপ তৃণভূমির সংখ্যা কমে গিয়ে সবুজায়ন ব্যহত হচ্ছে। এমনকি মহাকাশ থেকে এই পরিবর্তন দৃশ্যমান।
অন্যদিকে তৃণভূমির সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাতাস মাটি থেকে আরো সহজে এবং অধিক পরিমাণে বালু ও ধূলিকণা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, সাধারণত ঘাস ও অন্যান্য তৃণলতা মাটির উপর একটি পরত হিসেবে কাজ করে। যে পরত বাতাসকে মাটির উপরের স্তরে থাকা বালু ও ধুলিকণা উড়িয়ে নিতে বাধা দেয়। এবার বাতাসের উড়িয়ে নেওয়া সেই বালু ও ধুলিকণা অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বিশাল বিশাল স্যান্ড ডুন বা বালিয়াড়ির সৃষ্টি করছে। আবার সেই বালিয়াড়িগুলো দেয়াল হিসেবে বাতাসের গতিপথে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। আর বাতাসের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। মোটামুটি ডিঙ্গো ফেন্স উক্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় ভেড়ার খামারসমূহ রক্ষার্থে স্থাপিত ৫,৬১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ডিঙ্গো ফেন্স এক মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় গোটা বনাঞ্চলের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে। কিন্তু এই অবস্থার প্রতিকারে অস্ট্রেলিয়ার সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী নয়। কারণ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ভেড়ার খামারগুলোর মূল্য প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। আর এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রির সুরক্ষাবলয় হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ডিঙ্গো ফেন্সের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে সামান্য বিঘ্ন ঘটা কোনো বড় বিষয় নয়। তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে অস্ট্রেলিয়ার সরকার বর্তমানে ডিঙ্গো ফেন্সের সংস্কার করাতে ব্যস্ত।
ইমু যুদ্ধ থেকে শুরু করে ডিঙ্গো ফেন্স, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক তথা পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঐ দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য চরমভাবে বিঘ্নিত করেছে। তাদের উক্ত স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের পেছনে কারণ হলো ইউরোপীয়দের প্রতিষ্ঠিত মানবকেন্দ্রিক সভ্যতার চেতনা।
এমনকি ইউরোপের উন্নত দেশগুলো থেকে শুরু করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ মানবকেন্দ্রিক সভ্যতার জয়জয়কারে ব্যস্ত। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতি আর কতদিন এই স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করবে? হয়তো আজ না হয় কাল আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাব। হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বস, সুনামি কিংবা অন্য কোনো উপায়ে প্রকৃতি তার ক্রোধের জানান দেবে।
মানবকেন্দ্রিক সভ্যতার বিপরীত দিক হলো প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান। রেড ইন্ডিয়ান থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনালরা হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করেছে। যদিও তাদের মতো করে আদিম পদ্ধতি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে আমরা আমাদের সভ্যতার চলমান সফলতার ধারা অব্যাহত রাখতে পারব এবং সেই সাথে সহাবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সহাবস্থানের বিষয়টি একেবারে মুছে গেছে। আজ আমরা মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহে বসতি স্থাপন নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের কাছে এই পৃথিবী যেন একটি পুরনো ছেঁড়া জামা যা পরিত্যাগ করা অত্যন্ত জরুরি।
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে আমরা প্রকৃতির সাথে এই স্বেচ্ছাচারী আচরণ শুরু করিনি। বরং গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ ইউরোপীয়দের মানবকেন্দ্রিক সভ্যতার পাল্লায় পড়ে আমরা এমন আচরণ শুরু করেছি। তবে এখনই সময় পরিবর্তনের। এখনই সময় পৃথিবী ও প্রকৃতিকে ভালোবাসার। প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ বন্ধ করার। বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের দায়িত্ব। হয়তো মহাকাশে বসতি স্থাপনের সুযোগ আসবে, তাই বলে আমরা পৃথিবীর প্রকৃতিকে অবহেলা করতে পারি না। আমাদের চারপাশ সম্পর্কে আমাদের আরও দায়িত্ববান হতে হবে। তাহলেই পৃথিবীর প্রতি আমাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে।