আমরা বিমানে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করি। বিমান ওড়াতে যে জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, সেটি হচ্ছে ‘জেট ফুয়েল’। এটি উৎপাদন করা হয় কেরোসিন পরিশোধনের মাধ্যমে। কেরোসিন পাওয়া যায় খনিজ তেল থেকে। দেশের অসংখ্য স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিতে কর্তৃপক্ষ নিজস্ব বাসের ব্যবস্থা করে থাকে। এই বাস চালাতে ব্যবহার করা হয় ডিজেল, পেট্রোল কিংবা গ্যাসোলিন। এগুলো কোথা থেকে উৎপাদন করা হয় জানেন? খনিজ তেল থেকে। যানবাহনের ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সচল ও কর্মক্ষম রাখতে আমরা ব্যবহার করি ‘লুব্রিকেটিং ওয়েল’। এটাও খনিজ তেল থেকে উৎপাদন করা হয়। জমি কর্ষণের জন্য পুরো বিশ্বজুড়ে বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি যান ‘ট্রাক্টর’। অতি অল্প সময়ে, স্বল্প পরিশ্রমে অধিক পরিমাণ জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর পুরো পৃথিবীতে কৃষকদের কাছে অতি প্রয়োজনীয়। এই ট্রাক্টরে যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়, এটাও কিন্তু খনিজ তেলে থেকে উৎপাদন করা হয়।
না, এখানেই শেষ নয়। আপনার হয়তো ধারণাও নেই, জ্বালানি তেলের উপর আপনি কত বেশি নির্ভরশীল। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খাবার খেতে হয়। এই খাবার উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের সার। পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। এই কীটনাশক কিংবা সার উৎপাদন করা হয় খনি থেকে প্রাপ্ত তেল থেকে। শিল্পকারখানায় বিভিন্ন ফসল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়, যেগুলো ভোক্তার কাছে পরিবহন করা হয় মালবাহী গাড়ির মাধ্যমে। এই মালবাহী গাড়ি চালাতে খনিজ তেল থেকে উৎপাদিত গ্যাসোলিন কিংবা পেট্রোল দরকার হয়। আবার শিল্পকারখানা চালাতে যে শক্তির দরকার হয়, সেটি উৎপন্ন করা হয় জ্বালানি তেল থেকে। আমরা প্রতিদিন যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করি, তার একটি বড় অংশ প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিক তৈরি করা হয় কোথা থেকে জানা আছে? সেই খনিজ তেল থেকে। আমরা অনেকেই পলিয়েস্টার কাপড়ের পোশাক পরিধান করে থাকি। এই পলিয়েস্টার কাপড়ও খনিজ তেল থেকে উৎপাদন করা হয়।
কখনও যদি খনিজ তেলের যোগান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে, সেটি একটু বিবেচনায় নেয়া যাক। আপনি যেসব যানবাহনে চড়ে চলাফেরা করেন, সেসব আর করতে পারবেন না, কারণ পেট্রোল, ডিজেল কিংবা গ্যাসোলিনের অভাবে এসব চলবে না। পৃথিবীর কোনো দেশই খাদ্য ও শিল্পপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাকে এসবের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয় বিমান, মালবাহী জাহাজ কিংবা ট্রাক। জ্বালানি তেলের যোগান বন্ধ হয়ে গেলে আকাশ, সড়ক কিংবা নৌপথের পণ্য পরিবহনের সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, বৈদেশিক বাণিজ্য থমকে দাঁড়াবে। পৃথিবীজুড়ে প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি বিভিন্ন পণ্যের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ জ্বালানি তেলের অভাবে প্লাস্টিক উৎপাদন করা বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, জ্বালানি তেল উত্তোলনের যে তেলক্ষেত্রগুলো রয়েছে সেগুলো যে বিশাল পরিমাণ মানুষ কাজ করে, তারা বেকার হয়ে পড়বে। শিল্পকারখানাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কিংবা বিভিন্ন দ্রবণের উপাদান হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহার করা হয়। সুতরাং যোগান বন্ধ হয়ে গেলে শিল্পকারখানাগুলোও পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে।
মানবজাতির বিভিন্ন সংকট উতরে আসার অসংখ্য উদাহরণ আছে। দুর্যোগ কিংবা বিপর্যয়ের মুখে মানবজাতি একেবারে ভেঙে পড়ে না, বরং দিনশেষে বিজয়ীর বেশে সব প্রতিকূলতা জয় করে ফিরে আসে। এটা অবশ্যই ঠিক, জ্বালানি তেলের যোগান যদি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। কিন্তু যেহেতু মানবজাতির সংকট কাটিয়ে ওঠার অভ্যাস রয়েছে, তাই জ্বালানি তেলের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থা ঠিকই আবিষ্কার করে ফেলবে মানুষ। পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ অসীম নয়। একসময় জীবাশ্ম জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে। সেদিনের কথা ভেবে এখনই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কিছু নেই। ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক হারে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে যে এই ধরনের গবেষণা আরও ব্যাপকতা লাভ করবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক গবেষণার ফলাফল আমরা পেয়েও গিয়েছি। অনেক দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি দেখা যাচ্ছে, যেগুলো চালানোর জন্য গতানুগতিক ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাসোলিন কিংবা সিএনজির পরিবর্তে বিদ্যুৎশক্তি দরকার হয়।
বলা হয়ে থাকে, দেহের জন্য যেমন রক্তের প্রয়োজন, তেমনই একটি দেশের জন্য জ্বালানি তেল প্রয়োজন। রক্তের পরিমাণ একেবারে কমে গেলে যেমন একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, তেমনই জ্বালানি তেল ছাড়া একটি রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। জ্বালানি তেলের এখনও পর্যন্ত কোনো শক্ত ও বিশাল পরিসরে ব্যবহারযোগ্য বিকল্প আবিষ্কার হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম একেবারে নির্দিষ্ট নয়। এখনও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যেতে দেখা যায়। আবার আমরা অনেক সময় দেখে থাকি, জ্বালানি তেলের দাম কমে গিয়েছে। যেহেতু জ্বালানি তেল একটি দেশের অর্থনীতির উপর অনেক বেশি প্রভাব রাখে, তাই জ্বালানি তেলের দরপতন কিংবা মূল্যবৃদ্ধিতে বেশ প্রভাব পড়ে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলো বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আবার যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করে, তাদের অর্থনীতিতে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঠিক বিপরীতভাবে, জ্বালানি তেলের দরপতন হলে আমদানিকারী দেশগুলোর সুবিধা হয়, অপরদিকে তেল রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর মুনাফায় ভাটা পড়ে।
বিগত পঞ্চাশ বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের ওঠা-নামা সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি তেল রপ্তানির নীতিগত সমন্বয়সাধন, এবং ন্যায্য ও স্থিতিশীল দামে জ্বালানি তেল রপ্তানি নিশ্চিত করতে ১৯৬০ সালে ‘অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোল এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ’ বা ‘ওপেক’ (Organisation Of The Petrol Exporting Countries – OPEC) গঠিত হয়। এই সংগঠনটি ১৯৭৩ সালে ইসরায়েল বনাম আরব বিশ্বের সাথে সংঘটিত ইওম কিপুর যুদ্ধের আগপর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ইওম কিপুর যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে আমেরিকা সমর্থন অব্যাহত রাখলে আরব বিশ্ব আমেরিকায় তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। ফলে ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ২৪ ডলার থেকে বেড়ে ৫৬ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দিকে আরেক তেল রপ্তানিকারক দেশ ইরানে যখন ইসলামিক বিপ্লব শুরু হয়, তখন দেশটির রপ্তানির পরিমাণ কমে বিশ্ববাজারে সংকট তৈরি হয়। সেসময় একপর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি খনিজ তেলের দাম দাঁড়িয়েছিল ১২৫ ডলারে!
১৯৯০ সালের আগস্টে যখন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে আক্রমণের মাধ্যমে প্রথম আরব উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা করেন, তখন তেলের দাম ৩৪ ডলার থেকে একধাক্কায় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৭ ডলারে। এরপর যখন মার্কিন নের্তৃত্বাধীন সামরিক জোট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে, তখন ১৯৯১ সালে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩৭ ডলারে নেমে আসে। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে ভেনেজুয়েলা যখন তাদের তেলক্ষেত্রগুলো জাতীয়করণ করে, তখন নতুন সংকট শুরু হয়। এছাড়াও যুদ্ধের কারণে ইরাকের জ্বালানি তেল রপ্তানি ব্যহত হচ্ছিল, নাইজেরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোতে চলছিল শ্রমিক ধর্মঘট। ফলে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে যেখানে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১১৮ ডলার, সেখানে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৫ ডলারে। ২০০৮ সালের দিকে মহামন্দা হানা দেয়, অর্থনীতির ধীরতার প্রভাব পড়ে তেলের বাজারেও। ২০০৮ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নেমে আসে ৫০ ডলারে।
যখন করোনাভাইরাসের আগ্রাসন শুরু হয়, তখন মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে রাষ্ট্রগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, বন্ধ হয়ে যায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। তাছাড়া তেল উত্তোলনের পরিমাণ কমিয়ে আনা নিয়ে রাশিয়া এবং সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা যোগ করে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে। যেহেতু চাইলে হঠাৎ করে তেল উত্তোলন সম্ভব নয়, তাই দেখা গিয়েছিল, চাহিদার তুলনায় তেল উত্তোলন করা হয়েছে অনেক। এত বেশি যে, উত্তোলিত তেল কোথাও সংরক্ষণ করারও উপায় ছিল না। ২০২১ সালের এপ্রিলে ইতিহাসে প্রথবারের মতো জ্বালানির তেলের দাম ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল, যদিও সেই বছরর শেষের দিকে গিয়ে দাম আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল।