কাট-কপি-পেস্ট প্রক্রিয়াটির সাথে আশা করি পাঠকেরা ভালোভাবেই পরিচিত। কম্পিউটার, ল্যাপটপ হোক কিংবা স্মার্টফোন হোক; এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতে কাজ করার সময় কাট-কপি-পেস্ট করা তো লাগেই। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা না গেলে আপনি একটি ম্যাসেজ আপনার ১০জন বন্ধুকেও পাঠাতে পারতেন না, আবার বিভিন্ন সোর্সে পাওয়া প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোও একত্রিত করে রাখতে পারতেন না। তুচ্ছ কোনো কাজ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রেই আপনাকে এই কপি পেস্টের কৌশল ব্যবহার করতে হয়। কখনো কি চিন্তা করেছেন আপনার কাজ সহজ করে দেওয়ার মতো এই প্রক্রিয়াটি প্রবর্তনের পেছনে কার অবদান রয়েছে? উনি হলেন- কম্পিউটার বিজ্ঞানী ল্যারি টেসলার। আইফোনের পূর্বসূরি হিসেবেও পরিচিত এই টেসলার। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এই বিজ্ঞানী। এই সময় তার বয়স ছিল ৭৪ বছর।
মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তার স্ত্রী বার্টনের মতে, একটি বাইসাইকেল দুর্ঘটনার পর থেকেই তার মধ্যে কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। হয়তো দুর্ঘটনার দরুন কোনো অভ্যন্তরীণ আঘাত তার এই অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
১৯৪৫ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন ল্যারি টেসলার। তিনি স্ট্যানফোর্ডে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন। টেসলার এরপর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই স্ট্যানফোর্ডের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সময়ই আবিষ্কার করেন কমপেল নামক সিঙ্গেল অ্যাসাইনমেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। এটা এমন একটা সময়ে ছিল যখন এআই রিসার্চ সেরকম পরিচিত কিছু ছিল না। এআই রিসার্চ তো দূরের কথা, কম্পিউটার নিয়েই সেই সময়ে লোকজন সচেতন ছিল না। টেসলার আইবিএমের মতো কোম্পানিগুলোর সাথে মিলে অ্যান্টি-ওয়ার ও অ্যান্টি-কর্পোরেট মনোপলি মুভমেন্ট নিয়ে কাজ করেন। টেসলার তার জীবদ্দশায় সিলিকন ভ্যালির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন। এর মধ্যে অ্যাপলেও রয়েছে। সরাসরি স্টিভ জবসের তত্ত্বাবধানে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল টেসলারের। ১৯৭৩ সালে তিনি জেরক্স পালো অল্টো রিসার্চ সেন্টার (পার্ক)-এ চাকরি নেন।
জেরক্স পার্ক মূলত মাউসের গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (জিইউআই) ডেভেলপ করার জন্য পরিচিত। বর্তমানে ‘জেরক্স’ বলতে সাধারণ মানুষ শুধু ফটোকপি করাই বোঝে। তবে একসময় এই জেরক্স প্রতিষ্ঠান পার্সোনাল কম্পিউটারে কাজ করা ও তা সহজ করার জন্য বেশ কাজ করেছিল। সব নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করত জেরক্স। আর এত সব উদ্ভাবনী প্রোগ্রাম ও ফাংশনের পেছনে মূল প্রচেষ্টা ছিল টেসলারের। এখানে তিনি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। মিডপেনিনসুলা ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতাও ছিল টেসলারের। ল্যারি টেসলার তার পেশাগত জীবনের শুরুতে আসলে প্রোগ্রামার ছিলেন। পরবর্তীতে এই প্রোগ্রামারই বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবক হয়ে দাঁড়ান।
টেসলার সবসময়ই কম্পিউটার ব্যবহারের কাজটা কিভাবে সহজ করা তা নিয়ে কাজ করেছেন। অ্যাপেলে কাজ করার সময় তিনি একটি মাত্র বাটন ব্যবহার করে কম্পিউটার মাউস চালানোর বুদ্ধি দেন। গবেষণা করার জন্য অদ্ভুত সব কল্পনা-জল্পনার আশ্রয় নিতেন। যেমন একবার টেসলারের মাথায় আসলো কিভাবে কম্পিউটারে কাজ করা এতটাই সহজ করা যায়, যেন যেকোনো ব্যক্তি বারবার একই লেখা বা একই কাজ সহজেই করতে পারে। এরকম একটি সরল সিস্টেমের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তা জানার জন্য টেসলার তার নতুন সেক্রেটারিকে একটি বন্ধ কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসিয়ে তাকে এরকম সিস্টেমের বর্ণনা বলেন। টেসলার তার সেক্রেটারির সেই বিবরণের সাপেক্ষে টিম মোটের সাথে মিলে জিপসি নামক একটি ওয়ার্ড প্রসেসর আবিষ্কার করেন। এই জিপসিই কাট-কপি-পেস্ট প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে সহায়তা করেন। এই ফাংশনে কার্সর দিয়ে পছন্দমতো টেক্সট সিলেক্ট করে ওই টেক্সটকে ‘কাট’ ও ‘কপি’ করে যেখানে প্রয়োজন সেখানে ‘পেস্ট’ করা যায়।
এই জিপসি প্রোগ্রাম পূর্ববর্তী একটি জেরক্স এডিট ব্রাভোর সাথে শেয়ারে ছিল। ব্রাভো ছুলো প্রথম ‘হোয়াট ইহ শী ইজ হোয়াট ইউ গেট’ প্রোগ্রাম। এখানে প্রোগ্রামিং করার বা লেখার সময়ই ইউজার প্রতিনিয়ত প্রোগ্রাম বা লেখা শেষ হওয়ার পর তা কেমন হবে সেটা দেখার সুযোগ পেত। টেসলারই ‘হোয়াট ইউ সি ইজ হোয়াট ইউ গেট’ বাক্যটি ব্যবহার করা শুরু করেন। এখনকার দিনে ওয়ার্ড প্রসেসর ওপেন করলে ইউজার নিশ্চিত থাকে যে কিবোর্ডে আলফা-নিউমেরিক কি অনুসারে যেই অ্যালফাবেট বা বর্ণ টাইপ করবে সেটাই ওয়ার্ড প্রসেসরে দেখা যাবে। কিন্তু এমন এক সময়ও ছিল যখন ওয়ার্ড প্রসেসরে কাজ করার সময় বারবার মোড পরিবর্তন হতে থাকত। এর ফলে ডকুমেন্টে কিছু ক্যারেক্টার আপনা-আপনি যোগ হয়ে যেত, নতুবা পরিবর্তন হয়ে যেত। এই ঝামেলা থেকেও ল্যারি টেসলার সবাইকে বাঁচিয়েছেন। মোড যাই দেওয়া থাকুক না কেন সেটা যেন কাজে ব্যাঘাত না ঘটায় তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেন।
১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টেসলার অ্যাপল কম্পিউটারে কাজ করেন। বছরের পর বছর টেসলার কোম্পানিটির বিভিন্ন পজিশনে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি একসময় অ্যাপলনেটের ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন। উল্লেখ্য যে, অ্যাপলনেট হলো অভ্যন্তরীণ স্থানীয় নেটওয়ার্কিং সিস্টেম যা পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে বাতিল করা হয়। ল্যারি টেসলার অ্যাপলের মুখ্য বিজ্ঞানীর পোস্টেও ছিলেন। অ্যাডভান্সড টেকনোলজি গ্রুপেরও ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখ্য বিজ্ঞানী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। টেসলার অ্যাপল ছেড়ে দিয়ে অ্যাপলেরই একটি শিক্ষা বিষয়ক সফটওয়্যার স্টার্ট-আপ ‘স্টেজকাস্ট’-এ কাজ শুরু করেছিলেন। এর পাশাপাশি উনি অবশ্য অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছিলেন। ২০০৫ সালে টেসলার ইয়াহুতে যোগদান করেছিলেন। ২০০৮ সালে আবার সদস্য হয়েছিলেন ’২৩অ্যান্ডমি’ প্রতিষ্ঠানের। ২০০৯ সাল থেকে ল্যারি টেসলার ক্যালিফোর্নিয়াতে ইউএক্স কনসালটেন্ট হিসেবেও কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে যোগ দিয়েছিলেন অ্যামাজনে।
শুধুমাত্র কাট-কপি-পেস্টের উদ্ভাবনের মধ্যেই তার কৃতিত্ব সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ‘মোডলেস কম্পিউটিং’-এর মতো ইউজার ইন্টারফেস (ইউআই) ডিজাইন নিয়েও অনেক কাজ করেছিলেন। এই প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে একজন ইউজারকে তার কাজের উপর ভিত্তি করে বারবার ‘মোড’ পরিবর্তন করতে হয় না। যেই মোডই অন থাকুক না কেনো, সেই মোডই বিভিন্ন ধরনের ইনপুট নিয়ে কাজ করা সম্ভব এই মোডলেস কম্পিউটিংয়ের সুবাদে। তার নিজস্ব ওয়েবসাইট ‘নোমোডস.কম’-এ তার উদ্ভাবিত এরকম মোডলেস ফাংশনগুলোর বর্ণনা দেওয়া ছিল। একসময় কম্পিউটার প্রোগ্রাম থেকে মোড বাদ দেওয়ার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে টেসলারের নামডাক ছিল।
২০১২ সালে কাট-কপি-পেস্ট ফাংশন ডেভেলপ করা সম্পর্কে তার লেখা একটি পেপারে তিনি বলেন, “ সবচেয়ে ভালো প্রোগ্রামগুলোতে মোড থাকে যা সবসময় আমার জন্য বাধার সৃষ্টি করে”। ল্যারি টেসলার যে মোডলেস ফাংশন তৈরি করতে ও এসব উদ্ভাবনের পথ উন্মোচনে যে কতটা আগ্রহী তা বোঝা যায় তার কথাবার্তায় ও কাজেই। তিনি সব জায়গায় ‘নো মোডস’-এর কথা বলতেন। ওয়েবসাইট এমনকি নিজের গাড়ির নাম্বার প্লেটেও ‘নো মোডস’ উল্লেখ করে রেখেছিলেন।
অ্যাপলের কয়েকটি বিখ্যাত হার্ডওয়্যার নির্মাণে অবদান রাখার পাশাপাশি সরল প্রকৃতির সফটওয়্যার ও ইউজার ইন্টারফেস নির্মাণ করেছিলেন। লিজা, ম্যাসিনতোশ এবং নিউটাউন- এই তিনটি ইউজার ইন্টারফেস ডিজাইন ল্যারি টেসলারের হাত ধরেই হয়েছে। ম্যাসিনতোশ ও লিজা, প্রথম দুটি পার্সোনাল কম্পিউটার যা ‘কাট-কপি-পেস্ট’ অপারেশনকে জনসাধারণের নিকট পরিচিত করে তোলে। তার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো ‘ফাইন্ড অ্যান্ড রিপ্লেস ফাংশন’।
তার হাত ধরেই নতুন দিশা পায় কম্পিউটার সায়েন্স। এমনকি ‘ব্রাউজার’-এর প্রচলনের জন্যও কাজ করেন ল্যারি। অর্থাৎ অ্যাপলের কিছু হার্ডওয়্যার ও কাট-কপি-পেস্টের জন্য টেসলারের নাম বারবার সামনে আসলেও তার অবদানের ভাণ্ডার এই দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ল্যারি টেসলার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও এভারনোটের কনসালটেন্ট ছিলেন। ডেস্কটপ ও মোবাইল কীভাবে আরো উন্নত করা যায় তা নিয়েই টেসলার কাজ করেছিল। হাতেগোনা যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর অবদানে পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার এত সহজ হয়েছে, তাদের মধ্যে ল্যারি টেসলার অন্যতম।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে