২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর রুশ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘রুশ আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পরিষদে’র মহাপরিচালক আন্দ্রেই কোর্তুনভ ২০২১ সালে রুশ পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে সেই সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। নিবন্ধটিতে তিনি ২০২১ সালে রুশ পররাষ্ট্রনীতির ১৪টি মূল লক্ষ্যবস্তু উল্লেখ করেছেন। এই নিবন্ধটির প্রথম পর্বে এগুলোর মধ্যে ৭টি লক্ষ্যবস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই পর্বে অবশিষ্ট ৭টি লক্ষ্যবস্তু উল্লেখ করে সেটির ভিত্তিতে রুশ পররাষ্ট্রনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।
(৮) নাগর্নো–কারাবাখে নতুন সংঘাত রোধ
২০২০ সালে রাশিয়ার ট্রান্সককেশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজারবাইজান ও রুশ মিত্ররাষ্ট্র আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধপূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে আর্মেনিয়া তুর্কি–সমর্থিত আজারবাইজানের নিকট সামরিকভাবে পরাজিত হয়েছে, এবং ২০২০ সালের নভেম্বরে রুশ মধ্যস্থতায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, আজারবাইজান নাগর্নো–কারাবাখের একাংশ ও সংশ্লিষ্ট ৭টি আজারবাইজানি জেলা ফিরে পেয়েছে, আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্টাংশের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ যাতে না হতে পারে সেজন্য নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে।
এই যুদ্ধের ফলে কার্যত ট্রান্সককেশীয় রাষ্ট্র দুটির ওপরে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু নাগর্নো–কারাবাখ সঙ্কটের কোনো সুরাহা হয়নি। আজারবাইজান নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্টাংশ অধিকার করতে ইচ্ছুক, অন্যদিকে আর্মেনিয়া এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারাতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় অঞ্চলটিতে নতুন করে সংঘাত আরম্ভ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যেই যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে অঞ্চলটিতে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সৈন্যদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে যে অনুরূপ কোনো সংঘর্ষ থেকে নতুন করে যুদ্ধ আরম্ভ হবে না, সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এই পরিস্থিতিতে, আন্দ্রেই কোর্তুনভের মতে, ২০২১ সালে রুশ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম একটি লক্ষ্যবস্তু হবে নাগর্নো–কারাবাখে নতুন করে যুদ্ধ যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করা। অন্যথায় অঞ্চলটিতে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীরা একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং রাশিয়া নতুন একটি কূটনৈতিক সঙ্কটে জড়িয়ে পড়বে। তদুপরি, নতুন একটি যুদ্ধ শুরু হলে আর্মেনিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব এবং আজারবাইজানের ওপর তুর্কি প্রভাব উভয়ই বৃদ্ধি পাবে, এবং উভয় রাষ্ট্রেরই রুশ বলয় থেকে চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।
(৯) ‘আর্কটিক পরিষদে’র কার্যপরিধি বিস্তৃতকরণ
২০২১ সালে রাশিয়া দুই বছরের জন্য ‘আর্কটিক পরিষদে’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ফলে এই দুই বছরে সংস্থাটির অর্জন বা ব্যর্থতার ওপর রাশিয়ার মর্যাদা নির্ভর করবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আর্কটিক সার্কেলে (অর্থাৎ উত্তর মেরুতে) অবস্থিত ৮টি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে ‘আর্কটিক পরিষদ’ গঠিত হয়, এবং সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্কটিক অঞ্চলের উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয় করা। সংস্থাটির সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়া।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্কটিক অঞ্চলে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে এবং আর্কটিক মহাসাগরের বরফ গলে একটি ‘উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ’ (Northern Sea Route) সৃষ্টি হয়েছে৷ এটি বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এর ফলে আর্কটিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া আর্কটিকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে এবং এই অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যান্য আর্কটিক রাষ্ট্রের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। কিন্তু অন্যদিকে আর্কটিক অঞ্চলের বাইরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোও (যেমন: চীন) এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
আর্কটিকে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়া বর্তমানে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্র এই অঞ্চলে অধিকতর সক্রিয় হলে রাশিয়ার এই সুবিধাজনক অবস্থান বজায় থাকবে কিনা, সেটি অনিশ্চিত। এজন্য রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো আর্কটিক অঞ্চলেও যেন তীব্র ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দেখা না দেয় সেটি নিশ্চিত করা এবং এর মধ্য দিয়ে আর্কটিকে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্কটিক পরিষদ রাশিয়ার জন্য একটি আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হতে পারে বলে আন্দ্রেই কোর্তুনভ মনে করেন। তার মতে, আর্কটিক পরিষদের সভাপতি হিসেবে রাশিয়ার উচিত এতদঞ্চলে আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি। কিন্তু বর্তমান রুশ–পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এই লক্ষ্য আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।
(১০) ‘নর্ড স্ট্রিম ২’–এর নির্মাণ সমাপ্তকরণ
২০১৮ সালে রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত একটি নতুন গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের কাজ আরম্ভ হয়েছে, এবং এই পাইপলাইনটি ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশ তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি বৃহৎ অংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে। ইতিপূর্বে রাশিয়া ইউক্রেনে অবস্থিত সোভিয়েত আমলে নির্মিত পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করত। কিন্তু ২০০০–এর দশকে রপ্তানিকৃত গ্যাসের মূল্য নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়, এবং এই পথের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া ‘নর্ড স্ট্রিম’ পাইপলাইন নির্মাণ করে, যেটির মধ্য দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে সক্ষম হয়।
২০১৩–১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা–সমর্থিত ইউরোমাইদান বিপ্লবের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে, এবং এর ফলে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর তাদের নির্ভরশীলতাকে প্রায় পুরোপুরি দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে রাশিয়া ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন নির্মাণের কাজ আরম্ভ করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘শেল বিপ্লবে’র (Shale Revolution) ফলে দেশটিতে এখন বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে, এবং দেশটি ইউরোপের নিকট এই গ্যাস ‘তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস’ (Liquefied Natural Gas, ‘LNG’) হিসেবে রপ্তানি করতে ইচ্ছুক। কিন্তু রুশ গ্যাসের তুলনায় মার্কিন এলএনজির মূল্য অনেক বেশি, এজন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগ রুশ পাইপলাইন প্রকল্পেই বেশি আগ্রহী।
এর ফলে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির বাজার নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে, এবং রাশিয়া যাতে এই পাইপলাইন নির্মাণ করতে না পারে, সেজন্য মার্কিন সরকার এই পাইপলাইন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি প্রদান করেছে (ও ক্ষেত্রবিশেষে হুমকিটি বাস্তবায়নও করেছে)। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে, এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটলে ২০২১ সালের মধ্যে পাইপলাইনটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হবে। আন্দ্রেই কোর্তুনভের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারলে এটি রুশ পররাষ্ট্রনীতির একটি বৃহৎ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
(১১) ‘ওপেক+’ সংস্থাটির সংরক্ষণ
২০২০ সালে ‘ওপেক’ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো রাশিয়াকে খনিজ তেল উৎপাদন হ্রাস করার আহ্বান জানায়, এবং রাশিয়া এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলে সৌদি আরব কার্যত রাশিয়ার সঙ্গে একটি ‘তেল যুদ্ধ’ আরম্ভ করে। এর ফলে ওপেক+ ব্যবস্থাটি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীতে রাশিয়া ও সৌদি আরব এই ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, ‘পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা’ (Organization of Petroleum Exporting Countries, ‘OPEC’) ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা, যেটির মূল লক্ষ্য বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে সংস্থাটির সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো সৌদি আরব, ইমারাত, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, নিরক্ষীয় গিনি, গ্যাবন, কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা এবং ভেনেজুয়েলা।
রাশিয়া যেহেতু একটি বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র (কিন্তু ওপেকের সদস্য নয়), সেহেতু বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের জন্য রাশিয়া ও ওপেক একধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে, এবং এই ব্যবস্থাটি ‘ওপেক+’ নামে পরিচিত। কিন্তু ২০২০ সালের রুশ–সৌদি তেল যুদ্ধের ফলে এই ব্যবস্থার অকার্যকর হয়ে পড়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আন্দ্রেই কোর্তুনভের মতে, এই পরিস্থিতি রাশিয়ার জন্য লাভজনক নয়, এবং এজন্য রুশ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম একটি লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত ‘ওপেক+’ ব্যবস্থাকে বজায় রাখার চেষ্টা করা।
কোর্তুনভের মতে, বিশ্ব বাজারে খনিজ তেলের মূল্য যদি ৫০ মার্কিন ডলারের আশেপাশে স্থির থাকে, তাহলে সেটি রাশিয়ার জন্য লাভজনক হবে। আর তেলের মূল্য স্থির রাখার জন্য ওপেকভুক্ত রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো রুশদের জন্য আবশ্যক। অবশ্য এরকম সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব কিনা, বা সম্ভব হলেও সেটি স্থায়ী হবে কিনা, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
(১২) রুশ–চীনা অর্থনৈতিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণ
পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছে। বর্তমানে চীন রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি ও রপ্তানি অংশীদারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনের জন্য রাশিয়া বৃহৎ কোনো আমদানি বা রপ্তানি অংশীদার নয়। অর্থাৎ, রুশ–চীনা অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। চীনের বিস্তৃত শিল্পখাতের জন্য প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন, এবং রাশিয়া ক্রমশ চীনের জন্য একটি কাঁচামাল সরবরাহকারী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে রাশিয়ায় ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে, এবং বিশেষত রুশ জাতীয়তাবাদীরা রাশিয়াকে চীনের একটি ‘কাঁচামাল উপনিবেশ’ (raw materials colony) হিসেবে দেখতে মোটেই আগ্রহী নয়।
এই পরিস্থিতিতে আন্দ্রেই কোর্তুনভ মনে করেন, ২০২১ সালে রুশ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম একটি লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণ। উল্লেখ্য, কোর্তুনভ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক হ্রাস করার পক্ষপাতী নন, বরং তিনি রুশ–চীনা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরো বিস্তৃত করার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর মতে, রুশ–চীনা বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেবল চীনের নিকট রুশ কাঁচামাল রপ্তানির প্যাটার্নে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং উভয় পক্ষের উচিত যৌথ প্রযুক্তিগত প্রকল্প গ্রহণ এবং পারস্পরিক বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। এর মধ্য দিয়ে রুশ–চীনা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে টেকসই করা রুশ পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য।
কিন্তু বর্তমানে রাশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধাজনক নয়, এবং কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ২০২১ সালে রুশ অর্থনীতির অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে কিনা, সেটি নিশ্চিত নয়। এমতাবস্থায় এই বছরে রুশ–চীনা অর্থনৈতিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণ কতটুকু সম্ভব হবে, সেটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
(১৩) সিরিয়ায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় সরকার ও বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে, এবং ২০১৫ সালে রাশিয়া এই গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। রুশ হস্তক্ষেপের ফলে সিরীয় সরকার পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের এখনো অবসান ঘটেনি এবং সহসা এই যুদ্ধের অবসান ঘটার কোনো সম্ভাবনাও নেই। মার্কিন ও তুর্কি সৈন্যরা সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রেখেছে, এবং তারা যথাক্রমে ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস’ ও ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ মিলিট্যান্ট সংগঠনদ্বয়কে সমর্থন দিচ্ছে। তদুপরি, সিরীয় সরকার যাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনের কাজ করতে না পারে, সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর বিস্তৃত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এগুলো সিরিয়ায় রাশিয়ার জন্য বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
শুধু মার্কিন ও তুর্কি হস্তক্ষেপই নয়, সিরিয়ায় ইরানি হস্তক্ষেপও রাশিয়ার জন্য প্রচ্ছন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যদিও সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরান কার্যত একই পক্ষে, কিন্তু উভয়ের লক্ষ্য ভিন্ন। ইরান সিরিয়ায় নিজস্ব সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব জোরদার করতে ইচ্ছুক, এবং গৃহযুদ্ধের সুযোগে তারা ইরানে বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে। এটিকে ইসরায়েল নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, এবং তারা এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় ইরানি ও ইরানি–সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোর ওপর শত শত আক্রমণ পরিচালনা করেছে। সিরিয়ায় ইরানি উপস্থিতি ও এগুলোর ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ রাশিয়াকে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, কারণ ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি কোনো বিরোধ নেই।
এমতাবস্থায় আন্দ্রেই কোর্তুনভ মনে করেন, ২০২১ সালে সিরিয়ায় রুশ পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত দেশটিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ। এই বছর সিরিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, এবং এটি সিরিয়ায় রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের একটি সুযোগ সৃষ্টি করবে। কোর্তুনভ মনে করেন, রাশিয়ার উচিত সিরীয় অর্থনীতির উন্নয়ন, সিরীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার অধিকতর বিকেন্দ্রীকরণ এবং সিরীয় সাংবিধানিক কমিটির কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য সিরীয় সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। অবশ্য এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য সিরীয় সরকারকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার ক্ষমতা কতটুকু, কিংবা সিরীয় সরকারের পক্ষে এই ধরনের সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের সম্ভব কিনা, সেটি যেমন অনিশ্চিত, তেমনি এই ধরনের সংস্কারের ফলে সিরীয় সঙ্কটের তীব্রতা আদৌ হ্রাস পাবে কিনা, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
(১৪) রুশ–তুর্কি সম্পর্কে নতুন সঙ্কট রোধ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও ন্যাটো সদস্য তুরস্কের মধ্যে একটি ‘বিস্তৃত অংশীদারিত্ব’ (comprehensive partnership) গড়ে উঠেছে, এবং এই অংশীদারিত্ব ক্ষেত্রবিশেষে ‘কৌশলগত’ রূপ ধারণ করেছে। ‘তুর্কস্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ও তুরস্ক কর্তৃক মার্কিন চাপ উপেক্ষা করে রুশ–নির্মিত ‘এস–৪০০’ ক্ষেপনাস্ত্র ক্রয় থেকে আরম্ভ করে তুরস্কের ভূমিতে রাশিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পর্যন্ত নানাবিধ ক্ষেত্রে রুশ–তুর্কি সহযোগিতার এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর–পূর্ব সিরিয়ায় রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা যৌথ টহল দিচ্ছে, নাগর্নো–কারাবাখের নিকটবর্তী আজারবাইজানি অঞ্চলে রুশ–তুর্কি যৌথ যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, এবং তুর্কি সৈন্যরা রুশ–নির্মিত ‘এস–৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য রাশিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
কিন্তু এই সহযোগিতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যুতে রাশিয়া ও তুরস্ক বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছে, এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, নাগর্নো–কারাবাখ, ক্রিমিয়া – প্রতিটি ক্ষেত্রে রাশিয়া ও তুরস্ক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তুর্কিরা রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, রুশরা তুর্কি সৈন্যদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে, এবং উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ শুরু করেছে। এর ফলে রুশ–তুর্কি দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্র হচ্ছে।
কিন্তু তুরস্কের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো রাশিয়ার জন্য লাভজনক নয়। রাশিয়ার নিকট তুরস্কের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেশি। রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হচ্ছে ন্যাটোকে বিভক্ত করা, এবং তুরস্কের সঙ্গে কতিপয় ন্যাটো সদস্যের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া তুরস্ককে ন্যাটো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আগ্রহী। এজন্য তুরস্কের সঙ্গে নতুন কোনো গুরুতর সঙ্কট এড়ানো রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে আন্দ্রেই কোর্তুনভ মনে করেন যে, রাশিয়ার উচিত ২০২১ সালে তুরস্কের সঙ্গে গুরুতর কোনো বিরোধে জড়ানো থেকে বিরত থাকা।
কিন্তু রুশ জাতীয়তাবাদীদের একাংশ তুরস্ককে বেশি ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয়। অন্যদিকে, তুরস্কও মধ্যপ্রাচ্য, ট্রান্সককেশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী, এবং এক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া ২০২১ সালে তুরস্কের সঙ্গে নতুন কোনো সঙ্কটে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে পারবে কিনা, বা থাকতে পারলেও রুশ জনসাধারণের নিকট সেটি গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, সেটি অনিশ্চিত।
আন্দ্রেই কোর্তুনভ ২০২১ সালে সম্ভাব্য রুশ পররাষ্ট্রনীতির জন্য ১৪টি লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু তার মতে, রুশরা এই লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে সব কয়টি বাস্তবায়ন করতে পারবে, এই সম্ভাবনা খুবই কম। বস্তুত কোর্তুনভের মতে, যদি রাশিয়া এই ১৪টি লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে অর্ধেকও ২০২১ সালে বাস্তবায়ন করতে পারে, সেটি হবে রুশ পররাষ্ট্রনীতির জন্য বিরাট একটি সাফল্য। এর মধ্য দিয়ে ২০২১ সালে রুশ পররাষ্ট্রনীতি যে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, সেই বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় নিজস্ব উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু কোর্তুনভের তালিকায় এই অঞ্চলগুলোর কোনো উল্লেখ নেই। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এখনো রাশিয়া বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী নয়, বরং নিজস্ব আঞ্চলিক অবস্থান বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সুসংহত করাই তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক উইনস্টন চার্চিল রুশ পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “রাশিয়া একটি প্রহেলিকার অভ্যন্তরে রহস্যে মোড়ানো একটি ধাঁধা। কিন্তু হয়তো এর একটি চাবি রয়েছে। চাবিটি হচ্ছে রুশ জাতীয় স্বার্থ।” এজন্য ২০২১ সালে (অথবা যে কোনো সময়ে) রুশ পররাষ্ট্রনীতির ধাঁধার উত্তর খুঁঁজতে হলে রুশ জাতীয় স্বার্থের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।