২৬ বছর বয়সী সাংবাদিক রোমান প্রোতাসেভিচ বেলারুশের বাইরে খুব একটা পরিচিত মুখ নন। কিন্তু বর্তমানে তিনিই পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াতে মূল শিরোনাম হয়ে গিয়েছেন। তবে তার জন্য এ অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর কিছু না।
গত ২৩ মে গ্রীসের এথেন্স থেকে রায়ানএয়ার ফ্লাইটের একটি বিমান লিথুনিয়ার ভিলিনিয়াসের উদ্দেশ্যে ১৭০ জনেরও বেশি সংখ্যক যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় বেলারুশের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। তখন বিমানটিকে ‘ইউ টার্ন’ করিয়ে রাজধানী মিনস্ক শহরের বিমানবন্দরে নামাতে বাধ্য করে বেলারুশ। শুধু তা-ই নয়, বেলারুশ একটি মিগ-২৯ বিমানও পাঠায় রায়ানএয়ারের যাত্রীবাহী বিমান থামানোর জন্য।
যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন রোমান প্রোতাসেভিচ। বিমান থামিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সাথে থাকা ২৩ বছর বয়সী রুশ বান্ধবী সোফিয়া সাপেগাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ঘটনাকে দেখছে ‘বিমান ছিনতাই’ হিসাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেলারুশে বিমান চালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে বেলারুশ পাশে পাচ্ছে দীর্ঘদিনের মিত্র রাষ্ট্র রাশিয়াকে।
বিমান ছিনতাই কিংবা গ্রেফতার যা-ই বলা হোক না কেন তা হয়েছে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর নির্দেশে। লুকাশেঙ্কোকে পশ্চিমা বিশ্বে বলা হয় ‘ইউরোপের সর্বশেষ একনায়ক’। ৬৬ বছর বয়সী লুকাশেঙ্কো গত ২৭ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় আছেন। তিনি কেন ২৬ বছর বয়সী একজনকে ধরার ভিন দেশের বিমান ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে যাবেন? রোমান প্রোতাসেভিচই বা কে? এসব বিষয়ের উত্তর খুঁজতে গেলে বেলারুশের সাথে রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্নায়ু যুদ্ধ ও লুকাশেঙ্কো প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলতে হবে।
স্নায়ুযুদ্ধ ও রাশিয়া-বেলারুশ সম্পর্ক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রদের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা সোভিয়েত বলয়ের রাষ্ট্রগুলোতে সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করে। সরকার বিরোধীদের সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য উসকে দেয়। এতে স্নায়ু যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় হয়।
আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়, যার মধ্যে একটি বেলারুশ। রাশিয়ার জন্য নব্বইয়ের দশক ছিল খুব বাজে সময়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে দ্রুত পশ্চিমা মুক্তবাজার অর্থনীতির আদলে গড়ে তুলতে গিয়ে পশ্চিমাপন্থী রুশ সরকার ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। রাশিয়ার শিল্প উৎপাদন হ্রাস পায়, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। এতে বিশ্ব রাজনীতিতেও রাশিয়ার প্রভাব কমে যায়। পশ্চিমা দেশগুলোও রাশিয়াকে কার্যত বড় কোনো সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে। তাদের ধারণা ছিল রাশিয়া একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে পরিণত হয়ে যাবে।
পশ্চিমা বিশ্ব তখন রাশিয়ার প্রতিবেশী সাবেক সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাবে নিয়ে আসতে থাকে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় কয়েকটি দেশ। নব্বই দশকের শেষের দিকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। ১৯৯৯ সালে পশ্চিমাপন্থী রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করেন। তার জায়গায় ক্ষমতায় আসেন রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি’র সাবেক পরিচালক ভ্লাদিমির পুতিন।
পুতিন ক্ষমতায় এসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিকে পশ্চিমা ঘরানা থেকে সরিয়ে স্বতন্ত্র একটি নীতিতে নিয়ে আসেন। এতে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের চাপ আরো বেড়ে যায়। কিন্তু পুতিন সেগুলোর জবাবও দিয়েছেন। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে রুশপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে এনেছেন, ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও হস্তক্ষেপ করেছেন।
পশ্চিমাদের ক্রমাগত চাপের মুখে থাকা রাশিয়ার কাছে বেলারুশ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কে বেলারুশ ‘বাফার রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছে। বেলারুশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোর সদস্য নয়। প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর সাথে পুতিনের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। লুকাশেঙ্কো প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইলোরাশিয়া প্রজাতন্ত্রের আইনসভার একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বাইলোরাশিয়ার একমাত্র সদস্য, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।
আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সালে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ছয়টি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। প্রথম নির্বাচন বাদে বাকি সবগুলো নির্বাচনেই তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে জয়ী হন। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সভেৎলানা তিখানোভস্কায়া মাত্র ১০ ভাগ ভোট পান। কিন্তু তিখানোভস্কায়া সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া সেই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন।
তখন রাজধানী মিনস্ক ও অন্যান্য শহরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। লুকাশেঙ্কোর বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়ান পুতিন। তিনি বেলারুশকে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। রাশিয়ার সহায়তায় লুকাশেঙ্কো সফলভাবেই সেই বিক্ষোভ মোকাবেলা করতে পেরেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বে বলা হয়ে থাকে, রাশিয়া পাশে না থাকলে লুকাশেঙ্কো দেশ ছেড়ে পালাতেন। তিখানোভস্কায়াকেও দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। রোমান প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতার করার কারণটাও সেই সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথেই সম্পর্কিত।
যে কারণে গ্রেফতার হলেন রোমান প্রোতাসেভিচ
রোমান প্রোতাসেভিচ একজন সরকার সমালোচক সাংবাদিক হিসেবে বেলারুশে পরিচিত। তিনি ২০১১ সাল থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়ে আসছেন। লুকাশেঙ্কো বিরোধী এক আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। এরপর বেলারুশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়তে গেলে সেখান থেকেও বহিস্কৃত হন। এর মাঝে ২০১৭-১৮ সালে ভেকলেভ হ্যাভেল ফেলো পুরষ্কার পান রেডিও ফ্রি ইউরোপ থেকে। রুশ মিডিয়া অবশ্য এ প্রতিষ্ঠানকে আমেরিকান সরকারের প্রোপাগান্ডা সার্ভিস বলে থাকে। এর বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই সিআইএ-র একটা মুখোশ হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আছে।
সরকারের চাপে ২০১৯ সালে প্রোতাসেভিচ দেশ ছেড়ে পোল্যান্ডে চলে যান। সেখান থেকে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকেন। টেলিগ্রামে নেক্সটা ও নেক্সটা লাইভ নামে দুটি চ্যানেল পরিচালনা করতেন। এগুলোতে প্রায় ২০ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার আছে, যেখানে বেলারুশের জনসংখ্যাই ৯৫ লক্ষ। ২০২০ এর সেপ্টেম্বরে অবশ্য নেক্সটা ছেড়ে আরেক টেলিগ্রাম চ্যানেল বেলামুভিয়াতে কাজ শুরু করেন। সেই চ্যানেলেও ২,৫৬,০০০ এর মতো সাবস্ক্রাইবার ছিল।
লুকাশেঙ্কো দেশটির গণমাধ্যম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই সেখানে স্বাধীনভাবে কোনো গণমাধ্যম কাজ করতে পারে না। টেলিগ্রাম আনসেন্সরড অ্যাপ হওয়ায় এটা দিয়ে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে প্রচারণা করতে পারতেন প্রোতাসেভিচ। ২০২০ এর আগস্টে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়, তার সমন্বয়ের কাজটা নেক্সটা লাইভের মাধ্যমেই ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। কখন কোন স্থানে প্রতিবাদ করতে হবে, পুলিশকে কীভাবে এড়িয়ে চলতে হবে এসব নির্দেশনা নেক্সটা থেকেই দেওয়া হতো। এই বিক্ষোভ দমনে প্রায় ৩৩,০০০ জন বেলারুশের নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। এই বিক্ষোভে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালে রোমান প্রোতাসেভিচকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ভিন্নমতের লোকদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করা হয়, অথবা চাপের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ২০২০ সালে প্রোতাসেভিচ পোল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। সর্বশেষ অবস্থান করছিলেন অবশ্য লিথুয়ানিয়ায়। তিনি গ্রেফতার হওয়ার আগে গ্রিসের এথেন্সে গিয়েছিলেন এক সভায় যোগ দিতে। সেখান থেকেই বিমানে করে লিথুয়ানিয়ায় ফিরে আসছিলেন। তিনি বিমানবন্দরেই লক্ষ্য করেন এক টাক মাথার লোক তার ছবি তোলার চেষ্টা করছে। তখন তিনি তার এক বন্ধুকে মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে জানান, তাকে সম্ভবত বেলারুশের গোয়েন্দা সংস্থা অনুসরণ করছে।
এরপরই বিমানযাত্রার সময় সেই ইউ টার্ন নিয়ে মিনস্ক বিমানবন্দরে নামতে বাধ্য হয় প্রোতাসেভিচকে বহনকারী বিমানটি। বেলারুশের পক্ষ থেকে বলা হয় মিনস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একটা বেনামি ইমেইল এসেছিল উক্ত বিমানে বোমা পরিবহন করে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে বলা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইজরায়েলকে সমর্থন করায় হামাসের পক্ষ থেকে বোমা হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই বোমা হামলার হুমকি থেকেই নাকি বেলারুশ বিমানটিকে ফিরিয়ে আনে। যদিও হামাস এই দায় অস্বীকার করেছে। তাছাড়া সুইশ ইমেইল সার্ভিস প্রদানকারী সংস্থা প্রোটনমেইলের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে এরকম মেইল এসেছে বিমান ফিরিয়ে আনার ২৪ মিনিট পর। যদিও কোথা থেকে, কে মেইল পাঠিয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষা নীতির কারণে জানা সম্ভব নয়। তবে পুরো ঘটনাটিই যে ছিল প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতারের অজুহাত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গ্রেফতার করার পর লুকাশেঙ্কো ঘরানার এক টেলিগ্রাম চ্যানেল দুটো ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে প্রোতাসেভিচ ও সোফিয়া তাদের স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার ব্যাপারে। এতে প্রোতাসেভিচের সর্বোচ্চ ১৫ বছরের জেল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাশিয়া অবশ্য সোফিয়া সাপেগির নিরাপত্তা রক্ষা করার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। যদিও ফুটেজগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাদেরকে নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
রাশিয়া ঘটনাটি যেভাবে দেখছে
প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতারের পর লুকাশেঙ্কোর সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে লুকাশেঙ্কোর প্রতি তার সমর্থনই ব্যক্ত করেছেন। এর আগে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বেলারুশের প্রতি সমর্থন দেওয়া হয়। বেলারুশ সন্ত্রাসী হুমকির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করেছে বলা হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা জবাব দিয়ে রুশ মিডিয়াতে বলা হয়, ২০১৩ সালে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের ব্যক্তিগত বিমান রাশিয়া থেকে বলিভিয়া যাওয়ার সময় জোর করে অস্ট্রিয়ায় নামানোর সময় তো কোনো প্রশ্ন উঠেনি। আমেরিকার প্ররোচনায় প্রেসিডেন্টের বিমানে এডওয়ার্ড স্নোডেন আছেন সন্দেহ করে ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে দেয়নি এমন অভিযোগ করা হয়।
২০১৬ সালে বেলারুশের একটি বিমানকেও জোর করে ইউক্রেনের বিমানবন্দরে নামানোর ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হয়। আর প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতারের বিষয়টা বেলারুশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবেই দেখছে রাশিয়া।
লুকাশেঙ্কোর বক্তব্য
লুকাশেঙ্কো পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,
আপনি বেলারুশে থাকলে বুঝতেন আমাদের কী পরিমাণ হুমকির মধ্যে দেশ চালাতে হয়। প্রায় প্রতিদিন আমরা পোল্যান্ড, লিথুনিয়া, লাটভিয়ার আইপি অ্যাড্রেস থেকে ভুয়া বোমা হামলার হুমকি পেয়ে থাকি। এগুলোর লক্ষ্য থাকে আমাদের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কোম্পানিগুলোতে বোমা হামলা করা। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
বিমানটি যখন বেলারুশের সীমানায় চলে আসে আমরা পাইলটকে বোমা হামলার ব্যাপারে জানাই। হুমকিটা হামাস দিয়েছিল, নাকি অন্য কেউ তা বড় বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে বিমানের যাত্রীদের ও বেলারুশের নাগরিকদের নিরাপত্তা। বিমানটির যাত্রাপথেই ছিল বেলারুশের নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্ট, যার কাছ থেকে ইউ টার্ন নিয়ে এসেছে। যদি সেখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটত তার দায় কে নিত? আমরা কি আরেকটা চেরনোবিল তৈরি করতে চাই? আমেরিকা তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত এই ঘটনার?
তিনি আরো বলেন,
আমরা বিমান সুরক্ষা আইন মেনেই কাজ করেছি। এটা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্বীকৃত। বিমান ইউ টার্ন করানোর সিদ্ধান্ত অবশ্য আমাদের ছিল না। নিয়মানুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দায়িত্বে থাকা পাইলট। আমরা শুধু সাহায্যের কথা জানিয়েছি। আমরা বোমার ব্যাপারে জানানোর পর ১৫ মিনিট ধরে তাদের কোম্পানি আর ভিলিনিয়াস বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পরামর্শ নিলো। আপনি চিন্তা করতে পারেন ওই পরিস্থিতিতে কেউ ১৫ মিনিট ধরে ফোনে কথা বলে কীভাবে? ভিলিনিয়াস থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে থেকেও তারা কেন বিমান সেখানে নামানোর সাহস পেল না? কেন ওয়ারশ বা কিয়েভ সাহায্য করতে এগিয়ে আসলো না? আমাকে দোষারোপ করবেন না। আমার জনগণকে রক্ষার জন্য আইন মেনেই ব্যবস্থা নিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও তা-ই করব।
মিগ-২৯ কে পাঠানো হয়েছিল বিস্ফোরক বস্তু বহনকারী বিমানটির গতিপথ ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখার জন্য। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যেন আমাদের উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের পাইলটদের নির্দেশনা দিতে পারে।
প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতারের বিষয়ে বলেন, তিনি আগে থেকেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের তালিকায় ছিলেন। প্রোতাসেভিচ সরকার বিরোধী আন্দোলনের অর্থ কোথা থেকে পান পাল্টা সেই প্রশ্ন তোলেন লুকাশেঙ্কো। লুকাশেঙ্কো সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতি আরো কঠোর হচ্ছেন। অনুমতি ছাড়া কোনো সমাবেশ-মিছিলের ক্ষেত্রে লাইভ স্ট্রিমিং করা নিষিদ্ধ করে আইনও তৈরি করছেন।
প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতারের ফলাফল যা হতে পারে
আগেই বলা হয়েছে বেলারুশ রাশিয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। রাশিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো যেখানে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে গিয়ে নাম লিখিয়েছে, সেখানে বেলারুশ তাদের শেষ বন্ধু রাষ্ট্র। লুকাশেঙ্কো এই সুযোগটাই নিয়ে আসছেন গত দু’দশক ধরে। তিনি একইসাথে রাশিয়া এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে আসছিলেন। রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল ও গ্যাস কিনে আসছিলেন এই সুযোগে। রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু ২০২০ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর তিনি প্রায় পুরোপুরি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
পশ্চিমা বিশ্ব এখন লুকাশেঙ্কোকে পুতিনের হাতের পুতুল হিসাবেই দেখে। ধারণা করা হয়, পুতিনের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই পশ্চিমাদের চাপের মুখে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে প্রোতাসেভিচকে গ্রেফতার করেছেন। তবে লুকাশেঙ্কোর বিরোধীরা মনে করছেন পরিস্থিতি আরো জটিল। লুকাশেঙ্কো পুতিনের পাপেট হয়ে থাকতে চান না দেখেই বিমান ছিনতাইয়ের কাজ করেছেন মনে করেন তারা। আগামী ১৬ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে পুতিনের সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। এর আগে পুতিন এত বড় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য লুকাশেঙ্কোকে অনুমতি দেওয়ার কথা নয়।
তবে ঘটনাটি রাশিয়াকে উপকারই করেছে। বেলারুশ এখন পুরোপুরি রুশ বলয়ে চলে এসেছে। বেলারুশের বিমানবন্দরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার জবাবে এয়ার ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনসের দুটি ফ্লাইট রাশিয়ায় আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ তারা বেলারুশের আকাশসীমা দিয়ে আসতে চায়নি। পুরো ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়া-বেলারুশের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।