২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় সরকার ঘোষণা করে যে, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করবে না। এর ফলে ইউক্রেনের বিরোধী দলগুলো এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণের পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিরোধী অংশ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ও পশ্চিম ইউক্রেনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করে। এই আন্দোলন ‘ইউরোমাইদান’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। পশ্চিম ইউক্রেন থেকে আন্দোলনকারীরা কিয়েভে আসতে থাকে এবং সেখানে ঘাঁটি স্থাপন, সরকারি ভবন দখল, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, পূর্ব ইউক্রেন সাধারণভাবে ইউক্রেনীয় সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে এবং কিয়েভ ও পূর্ব ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে পাল্টা সমাবেশ আয়োজিত হয়, কিন্তু তাদের কার্যক্রম তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কার্যক্রমের মতো আক্রমণাত্মক ছিল না। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি নাগাদ বিক্ষোভকারীদের কিয়েভ থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যেকার উগ্রপন্থী অংশ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করতে থাকে।
ইউরোমাইদানের ‘উষ্ণ’ পর্যায়ের সূচনা (২২—২৭ জানুয়ারি)
২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি কিয়েভে ৪ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ইউরোমাইদান কর্মীরা এদের মৃত্যুর জন্য ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের দায়ী করে, কিন্তু ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং ঘটনার তদন্তের পর এই হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থাকা ‘উস্কানিদাতা’দের (provocateurs) দায়ী করে। ২৩ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদান নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুযায়ী কিয়েভের সরকারি কোয়ার্টার ও হ্রুশেভস্কি সরণি থেকে ইউরোমাইদান কর্মীদের অবরোধ তুলে নেয়ার বিনিময়ে গ্রেপ্তারকৃত ইউরোমাইদান কর্মীদের মুক্তি প্রদানের কথা ছিল। কিন্তু ইউরোমাইদান কর্মীরা এই সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করে। একই দিনে ইউরোমাইদান কর্মীরা পশ্চিম ইউক্রেনের লভিভ, রিভনে, তেরনোপিল ও খেমেলনিৎস্কি প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে নেয় এবং পশ্চিম ইউক্রেনের ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক ও মধ্য ইউক্রেনের পলতাভা ও ঝিতোমির প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়।
২৪ জানুয়ারি ইউরোমাইদান কর্মীরা কিয়েভে অবস্থিত কৃষিনীতি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় ভবন দখল করে নেয় এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে নতুন করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে ও মলোতভ ককটেল নিক্ষেপ করে নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর আক্রমণ চালায়। ‘ইউরোমাইদান রক্ষী’ নামক একটি সশস্ত্র দলের সদস্যরা ৩ জন নিরাপত্তারক্ষীকে বন্দি করে, কিন্তু পরবর্তী দিন তাদেরকে ছেড়ে দেয়। এদিকে একই দিনে ইউরোমাইদান কর্মীরা পশ্চিম ইউক্রেনের ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক ও ভোলিন প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে নেয়, মধ্য ইউক্রেনে সুমি প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসন ইউরোমাইদানের পক্ষে যোগদান করে এবং চেরকাসি প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা স্থানীয় পুলিস সদর দপ্তরে আক্রমণ চালায়। একই দিনে লভিভ প্রদেশের ‘বেরকুৎ’ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করে ইউরোমাইদানের পক্ষে যোগদান করে। অন্যদিকে, পূর্ব ইউক্রেনের দনেৎস্ক, লুহানস্ক, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক ও খেরসন প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনগুলো তীব্রভাবে ইউরোমাইদান কর্মীদের কার্যক্রমের নিন্দা জানায় এবং ক্রিমিয়ায় ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’ গঠনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়।
২৫ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদান নেতৃবৃন্দের মধ্যে আবার আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ইউরোমাইদান নেতা আরসেনি ইয়াৎসেনিউককে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও ভিতালি ক্লিচকোকে উপ–প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রদানের প্রস্তাব করেন। কিন্তু ইউরোমাইদান নেতারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। বস্তুত এই পর্যায়ে এসে ইউরোমাইদান আর সমঝোতায় আগ্রহী ছিল না এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনীয় সরকারকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করা। সেদিন ইউরোমাইদান কর্মীরা কিয়েভের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও ‘উক্রায়নস্কি দিম’ এবং মধ্য ইউক্রেনের ভিন্নিৎসিয়া, পলতাভা ও চের্নিহিভ প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে নেয়।
২৬ জানুয়ারি ইউরোমাইদান কর্মীরা ওদেসায় ইউরোমাইদানের পক্ষে বিক্ষোভ করে, কিন্তু দদনিপ্রোপেত্রোভস্ক ও জাপোরোঝিয়া প্রদেশের আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল ও সেভাস্তোপোলে বিক্ষোভ আয়োজনের জন্য তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২৭ জানুয়ারি ইউরোমাইদান কর্মীরা কিয়েভে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন দখল করে, মধ্য ইউক্রেনের কিরোভোহরাদ প্রদেশে একটি মিছিলের আয়োজন করে এবং দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন প্রদেশে ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করে, যাদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে মারা যায়। অন্যদিকে, সেদিন দনেৎস্ক, ওদেসা ও ক্রিমিয়ায় ইউরোমাইদানবিরোধীরা তাদের ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’ নির্মাণ করতে শুরু করে।
ইউক্রেনীয় সরকারের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ (২৮–৩১ জানুয়ারি)
২৮ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী মিকোলা আজারভ পদত্যাগ করেন এবং ইউক্রেনীয় সরকার ১৬ জানুয়ারিতে প্রবর্তিত নতুন বিক্ষোভবিরোধী আইনের অংশবিশেষ বাতিল করে। একই সঙ্গে ইউক্রেনীয় আইনসভা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহ অস্বীকার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধগুলোতে ভাঙচুর চালানোকে নিষিদ্ধ করে একটি আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে সোভিয়েত আমলে নির্মিত স্মৃতিসৌধগুলোকে ইউরোমাইদান কর্মীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেদিনই রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচের দল ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’–এর একটি সভায় ইউক্রেনীয় নব্য অভিজাত (oligarch) রিনাত আখমেতভ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ৪০ জন আইনপ্রণেতা এবং সের্হি তিহিপকো কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ৩৮ জন আইনপ্রণেতা ইউক্রেনে জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। একই দিনে ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক প্রদেশের ‘আলফা’ বিশেষ বাহিনীর পুরো ইউনিট পদত্যাগ করে এবং ইউরোমাইদানের পক্ষে যোগদান করে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে।
২৯ জানুয়ারি গ্রেপ্তারকৃত ইউরোমাইদান কর্মীদের মুক্তির বিনিময়ে ইউরোমাইদান কর্মীরা কিয়েভে কৃষিনীতি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভবনের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়, কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ইউরোমাইদানের অপেক্ষাকৃত কম উগ্রপন্থী অংশের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সংঘর্ষ হয়। একই দিনে ইউক্রেনীয় আইনসভা একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং এই আইন অনুযায়ী গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাদে সকল ইউরোমাইদান কর্মীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ইউক্রেনীয় সরকার ঘোষণা করে যে, ইউরোমাইদান কর্মীরা দখলকৃত সরকারি ভবনগুলো ছেড়ে গেলেই এই আইন কার্যকর হবে। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি ইউরোমাইদানের নেতারা এই আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে আখ্যা প্রদান করেন।
৩১ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, ‘বাৎকিভশ্চিনা’ দলের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তারা যেসব নথিপত্র জব্দ করেছে, সেগুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইউরোমাইদান স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণআন্দোলন হিসেবে শুরু হয়নি, বরং এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘স্লুঝবা বেজপেকি উক্রায়নি’ (ইউক্রেনীয়: Служба безпеки України) বা ‘এসবিইউ’ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টার অভিযোগে ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ইউরোমাইদানের গতিকে স্তিমিত করা সম্ভব হয়নি।
চূড়ান্ত বিস্ফোরণের পূর্বাভাস (১—১৭ ফেব্রুয়ারি)
১ ফেব্রুয়ারি কিয়েভে ইউরোমাইদানের ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’ সদস্যরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বন্দি করে তার ওপর নির্যাতন চালায় এবং একই দিনে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে পুলিশ একজন ইউরোমাইদান কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ৩ ফেব্রুয়ারি ইয়ানুকোভিচ ইউরোমাইদানকে ‘চরমপন্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ক্লিচকো ও ইয়াৎসেনিউক ইউক্রেনের সংবিধান পরিবর্তন করে ২০০৪ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন করার জন্য ইউক্রেনীয় আইনসভাকে আহ্বান জানান। ৫ ফেব্রুয়ারি ইয়াৎসেনিউক জানান যে, ২০০৪ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন ঘটলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করবেন এবং নতুন সরকার পুরোপুরিভাবে বিরোধী দলের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
৮ ফেব্রুয়ারি এসবিইউ জানায় যে, ইউক্রেনীয় আইনসভা কর্তৃক গৃহীত নতুন আইন অনুসারে তারা ইউরোমাইদান কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারি ভবনগুলো দখলের দায়ে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একই দিনে কিছু ব্যক্তি কিয়েভে ইউরোমাইদান কর্মীদের দ্বারা নির্মিত ব্যারিকেডগুলো সরানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ইউরোমাইদান কর্মীদের বাধার ফলে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি কিয়েভে অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশে ইউরোমাইদানের নেতারা ইউরোমাইদানের ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’গুলোতে যোগদান ও পূর্ব ইউক্রেনে ইউরোমাইদানকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইউক্রেনীয় জনসাধারণকে আহ্বান জানান।
১২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় সরকার জানায় যে, তারা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে একটি জোট সরকার গঠন করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিরোধী দলগুলো কেবল নিজেদের সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটিকে তারা ‘চরমপত্র’ হিসেবে বিবেচনা করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি ভিতালি ক্লিচকো জানান যে, তার দল সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউরোমাইদানে অংশগ্রহণকারী ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী জোট ‘প্রাভিই সেক্তর’ (ইউক্রেনীয়: Правий сектор) নিজেদের একটি ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ গঠন করে এবং দাবি জানায় যে, ইউক্রেনীয় আইনসভায় উপস্থিত বিরোধী দলগুলো যেন তাদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইউরোমাইদানের উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশ নিজেদের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নির্দেশ করে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় সরকার ইতিপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল ইউরোমাইদান কর্মীকে গৃহবন্দি থাকার শর্তে মুক্তি প্রদান করে। একই দিনে ইতিপূর্বে উল্লিখিত ব্যক্তিরা আবার কিয়েভে ইউরোমাইদান কর্মীদের তৈরি ব্যারিকেডগুলো অপসারণের চেষ্টা করে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোমাইদান কর্মীরা তাদেরকে আক্রমণ করলে অন্তত ১৩ জন আহত হয়।
ইউরোমাইদানের চূড়ান্ত পর্যায় (১৮–২০ ফেব্রুয়ারি)
১৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় আইনসভার অধিবেশনে বিরোধী দলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ২০০৪ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন এবং রাষ্ট্রপতি–শাসিত ব্যবস্থা বাতিলের দাবি জানায়, কিন্তু সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। এরপর ইউরোমাইদানের নেতারা ইউক্রেনীয় আইনসভার ওপর একটি ‘শান্তিপূর্ণ আক্রমণ’ পরিচালনার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে নিয়ে আইনসভার দিকে রওনা হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আইনসভাকে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা। কিন্তু আইনসভার কাছাকাছি আসার পর ইউরোমাইদান কর্মীরা পুলিশের অবরোধের সম্মুখীন হয়। এসময় তারা পুলিশের ওপর পাথর ছুড়তে শুরু করে এবং পুলিশ যে ট্রাকগুলো দিয়ে রাস্তা রুদ্ধ করে রেখেছিল সেগুলোর ওপরে মলোতভ ককটেল নিক্ষেপ করে। প্রত্যুত্তরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর ফ্ল্যাশ ও নয়েজ গ্রেনেড এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এই সময়ে আইনসভার অভ্যন্তরে বিরোধী দলগুলোর আইনপ্রণেতারা দাবি করেন যে, আইনসভার সভাপতি ভলোদিমির রিবাক যেন তৎক্ষণাৎ ২০০৪ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের ওপর একটি খসড়া প্রস্তাব আনয়ন করেন। রিবাক এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রস্তাব দেন যে, প্রথমে এই বিষয়ে একটি সর্বজনস্বীকৃত খসড়া আইন প্রণয়নের জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা উচিত। এরপর বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতারা আইনসভার ট্রিবিউন ও প্রেসিডিয়াম অবরোধ করেন। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’–এর আইনপ্রণেতারা আইনসভা ত্যাগ করেন। কমিউনিস্ট দলীয় আইনপ্রণেতারাও আইনসভা ত্যাগ করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতারা তাদের বহির্গমনের পথ রুদ্ধ করে দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতারা তাদের পছন্দনীয় বিলটি নিবন্ধিত করতে সক্ষম হন।
এর ফলে আইনসভার আশেপাশে সংঘাতের মাত্রা স্তিমিত হয়ে আসে, কিন্তু শহরের অন্যান্য অংশে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোমাইদান কর্মীরা নিরাপত্তারক্ষী ও সরকারপন্থী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইউরোমাইদান কর্মীরা বেশ কয়েকজন বেরকুৎ সদস্যকে বন্দি করে, টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তারা পার্তিয়া রিহিওনিভের কার্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে সেটিকে বিধ্বস্ত করে এবং সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যার ফলে কার্যালয়টির একজন কর্মী নিহত হয়। তদুপরি, ইউরোমাইদান কর্মীদের নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে অন্তত ৫ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়।
সেদিন বিকেলেই নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং কিয়েভের ইউরোমাইদান–অধিকৃত অঞ্চলগুলো একে একে পুনর্দখল করতে শুরু করে। সবশেষে তারা মাইদান নেজালেঝনোস্তি থেকে ইউরোমাইদান কর্মীদের উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা চালায় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন নিহত এবং প্রায় ৩৫০ জন আহত হয়। ইউক্রেনীয় সরকার এই সংঘর্ষের জন্য ইউরোমাইদান নেতাদের দায়ী করে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য তাদেরকে আহ্বান জানায়। প্রত্যুত্তরে ইউরোমাইদান নেতারা নির্ধারিত সময়ের আগেই যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রপতি ও আইনসভা নির্বাচনের আয়োজনের এবং কিয়েভ থেকে বেরকুৎ বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানান।
এমতাবস্থায় পশ্চিম ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার ‘স্বেচ্ছাসেবক’কে ইউরোমাইদানের পক্ষে লড়াই করার জন্য কিয়েভে প্রেরণ করা আরম্ভ হয়। ক্রিমিয়ার আঞ্চলিক সরকার কিয়েভে চলমান সংঘাতকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ইউক্রেনের ঐক্য ও সাংবিধানিক শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচকে আহ্বান জানায়। খারকিভের মেয়র কিয়েভে নতুন করে লোক প্রেরণ বন্ধ রাখার জন্য পশ্চিম ইউক্রেনের শহরগুলোর মেয়রদের আহ্বান জানান। এই পরিস্থিতিতে ইয়ানুকোভিচ ও ইউরোমাইদান নেতৃবৃন্দের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু এটি ফলপ্রসূ হয়নি। ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনীয়দের উদ্দেশ্যে প্রচারিত একটি ভিডিও বার্তায় এই রক্তপাতের জন্য ইউরোমাইদান নেতাদের দায়ী করেন এবং তাদের কার্যক্রমকে ‘আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যা দেন।
এদিকে ইউরোমাইদান কর্মীরা কিয়েভে ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয় এবং টেলিভিশন ও রেডিও সম্প্রচার বিষয়ক রাষ্ট্রীয় কমিটির কার্যালয় দখল করে নেয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীরা আইনসভার চারদিকে একটি সুরক্ষাবেষ্টনী নির্মাণ করে এবং ইউক্রেন জুড়ে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর ইউনিটগুলো তাদের অস্ত্রাগারগুলোর সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে শুরু করে। অবশ্য পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে অনুধাবন করা যায় যে, শেষোক্ত পদক্ষেপটি বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি।
ইতোমধ্যে লভিভ প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা সেখানকার প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন দখল করে নেয়, কার্যালয়গুলোর সরঞ্জামাদি ও নথিপত্র ধ্বংস করে এবং অন্তত ১,১৭০টি আগ্নেয়াস্ত্র তাদের হস্তগত হয়। ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা স্থানীয় এসবিইউ সদর দপ্তর দখল করে নেয় এবং অন্তত ২৭১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৯০টি গ্রেনেড হস্তগত করে। ভোলিন প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে নেয় এবং প্রদেশটির গভর্নরকে মারপিট করে। খেমেলনিৎস্কি প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা স্থানীয় এসবিইউ সদর দপ্তর দখলের চেষ্টা করে এবং সংঘর্ষের ফলে ১ জন নিহত ও ২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ঝিতোমির প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় বিভাগের ওপর মলোতভ ককটেল নিক্ষেপ করে। জাকারপাত্তিয়া প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনগুলো দখল করে, এবং ভিন্নিৎসা প্রদেশে তারা গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়।
এসবিইউ–এর ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিনই অন্তত ১,৫০০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং অন্তত ১ লক্ষ রাউন্ড গুলি ইউরোমাইদান কর্মীদের হস্তগত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইয়ানুকোভিচ ও ইউরোমাইদান নেতৃবৃন্দের মধ্যে আবার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং ইউক্রেনীয় সরকার সেদিন রাতে মাইদানে পুনরায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা বাতিল করে। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে ২০ ফেব্রুয়ারিকে ইউক্রেন জুড়ে শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি কিয়েভে ইউরোমাইদান কর্মীরা আবার আক্রমণ শুরু করে এবং নিরাপত্তারক্ষীদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ইউরোমাইদান কর্মীদের অনেকের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল এবং অন্তত কয়েক ডজন নিরস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এমতাবস্থায় নিকটবর্তী ভবনগুলো থেকে অজ্ঞাত কিছু স্নাইপার ইউরোমাইদান কর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে এবং এর ফলে অন্তত কয়েক ডজন ইউরোমাইদান কর্মী নিহত ও শত শত জন আহত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই স্নাইপার কারা ছিল, সেটি নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ইউরোমাইদান কর্মীরা দাবি করে যে, এই স্নাইপাররা ছিল তদানীন্তন ইউক্রেনীয় সরকারের। অন্যদিকে, তদানীন্তন ইউক্রেনীয় সরকারের বক্তব্য অনুসারে, এই স্নাইপারদের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্রব ছিল না এবং ইউরোমাইদান কর্মীরা ইউক্রেনীয় সরকারকে বহির্বিশ্বের কাছে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য নিজেরাই এই ‘উস্কানি’র (provocation) আয়োজন করেছিল।
সেদিন দুপুরে কিয়েভে প্রায় ৭০ জন নিরাপত্তারক্ষী ইউরোমাইদান কর্মীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন পার্তিয়া রেহিওনিভ থেকে পদত্যাগের হিড়িক শুরু হয় এবং কিয়েভের নগর প্রশাসনের প্রধান ভলোদিমির মাকেয়েঙ্কোসহ দলটির বহু সংখ্যক আইনপ্রণেতা, আঞ্চলিক সংগঠনের প্রধান, আঞ্চলিক আইনসভা সদস্য ও মেয়র দল থেকে পদত্যাগ করেন। এদিকে সুমি প্রদেশে ‘প্রাভিই সেক্তর’ দল আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের ‘যুদ্ধবিরতি’র অবসান ঘটায়; ঝিতোমির প্রদেশে ইউরোমাইদান কর্মীরা ভ্লাদিমির লেনিনের একটি স্মৃতিসৌধ ধ্বংস করে; ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক প্রদেশের আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচকে ‘অবৈধ রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে; ভোলিন প্রদেশে অবস্থিত ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এসবিইউ ও প্রোসিকিউটরের কার্যালয় ভোলিনের আঞ্চলিক পরিষদকে প্রদেশটির স্বশাসিত কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং লভিভ প্রদেশে বেরকুৎ–এর একটি ঘাঁটিতে অগ্নিসংযোগের ফলে ২ জন নিহত হয়।
ইউক্রেনীয় আইনসভা কর্তৃক গঠিত একটি তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন অনুসায়ী, ২০১৪ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারিতে ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৯৬ জন ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষী গুলিবিদ্ধ হয় এবং এদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন প্রাণ হারায়। অর্থাৎ, এই পর্যায়ে এসে ইউরোমাইদান একটি পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করে এবং এই সংঘাতে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীরা (অর্থাৎ, ইউক্রেনীয় সরকার) সুবিধা করে উঠতে পারছিল না।
এভাবে ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউরোমাইদান আন্দোলন ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি তুলনামূলকভাবে মৃদু ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদানের মধ্যে সংঘটিত একটি পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করে। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ পশ্চিম ইউক্রেনের প্রদেশগুলো ক্রমশ ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে এবং ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের নিজস্ব রাজনৈতিক দলেরও একটি বৃহৎ অংশ পক্ষ পরিবর্তন করে। অথচ মাত্র মাস তিনেক আগে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন সিংহভাগ পর্যবেক্ষকই আপাতদৃষ্টিতে এরকম পরিণতির কথা চিন্তাও করতে পারেননি। বস্তুত ইউরোমাইদান আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিস্তার সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না, বরং শুরু থেকেই ইউক্রেনের ঘটনাবলি বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তী পর্বে ইউরোমাইদানের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে বর্ণিত হবে।