(পর্ব ৩-এর পর থেকে)
৬.
মাইকেল ফ্লুয়েকিগার ঠান্ডা মাথায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ৩১ বছর ধরে ট্রমা সেন্টার চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি এর আগে গুলিবিদ্ধ ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া অগণিত রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করেছেন। দেশের বাইরেও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তার কাছে অপরিচিত কিছু ছিল না। কারণ তার ওই সময়ের কর্মক্ষেত্র ছিল এলিট এয়ার-অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ফিনিক্স এয়ারে। তিনি আফ্রিকায় ইবোলা আক্রান্ত আমেরিকানদের নিয়ে আসার ব্যাপারে কাজ করছিলেন। তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তিনি অটোকে উত্তর কোরিয়া থেকে উদ্ধার করে আনতে যেতে আগ্রহী কিনা, তিনি ভয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজে না গিয়ে অধীনস্থ কাউকে পাঠাবেন না। ৬৭ বছর বয়সী এই চিকিৎসক তখন আসন্ন মিশনের জন্য উত্তেজনার সাথে অপেক্ষা করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমতি চলে আসে শুক্রবার দুপুরে। ফিনিক্স এয়ার তখন এর বিলাসবহুল গালফস্ট্রিম জি-থ্রি বিমানকে অবিলম্বে সেনেগাল থেকে এর হেডকোয়ার্টার আটলান্টায় পাঠায়। সেখানে থাকা ফ্লুয়েকিগার ও তার টিম বিমানে ওঠেন। তারপর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ইয়ুন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো দুই কর্মকর্তা যোগ দেন তাদের সাথে। তাদের নিয়ে বিমান চলে যায় জাপানে। সেখানে গিয়ে ইয়ুন, আরেকজন কূটনীতিবিদ ও ফ্লুয়েকিগার ছাড়া বাকি সবাইকে নেমে যেতে হয় বিমান থেকে। কারণ উত্তর কোরিয়া শুধুমাত্র এই তিনজনকেই প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল।
পরদিন গালফস্ট্রিম উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। জাপানি এয়ার-ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা তখন কেবল তাদেরকে বলে দিতে পারেন যে পিয়ংইয়ংয়ের যাওয়ার পথটা কোনদিকে। কারণ দেশ দুটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিমান যোগাযোগ নেই। বিমানের পাইলটকে বলে দেন সোজা ২০ মাইল এগিয়ে যেতে। তখন জাপানের সাথে রেডিও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ১০ মিনিট পর বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণের একটি কণ্ঠ বিমানকে পিয়ংইয়ংয়ে অবতরণের পথ দেখায়। এক বাসে করে আসা সৈনিকরা আমেরিকানদের টারমাক থেকে নিয়ে যায়। বিমানটি জাপানে ফিরে যায়।
আমেরিকানদের তখন পিয়ংইয়ং এর বাইরে এক ফার্মল্যান্ডের গেস্টহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। গেস্টহাউজটিতে মারবেলের সিঁড়ি, ঝাড়বাতি, আরো বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজানো। সেখানে গিয়ে মনে হয়েছিল আমেরিকানরাই একমাত্র অতিথি। সেদিন ইয়ুন উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন অটোকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ইয়ুনকে বার বার উত্তর কোরিয়ার এই যুক্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছিল- অটো একটা অপরাধ করেছেন, তিনি কেন সাজা না ভোগ করে চলে যাবেন?
প্রকৃতপক্ষে উত্তর কোরিয়াতে প্রোপাগান্ডা পোস্টারগুলোর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা এক গুরুতর অপরাধ। গবেষণা সংস্থা ডেটাবেজ সেন্টার ফর নর্থ কোরিয়ান হিউম্যান রাইটস নিশ্চিত করে, এক কারখানার দারোয়ান এরকম এক ছবিকে আচমকা ধাক্কা দেওয়ায় এটা দেওয়াল থেকে পড়ে যায়, যে কারণে তাকেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কোরিয়া রিস্ক গ্রুপ নামে আরেক গবেষণা সংস্থার পরিচালক আন্দ্রেই ল্যানকভ বলেন, অটো যা করেছেন তা যদি উত্তর কোরীয় কেউ করতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো অথবা নির্যাতন করা হতো।
শেষপর্যন্ত ইয়ুন উত্তর কোরীয়দের রাজি করান অটোর সাথে তার দেখা করার ব্যাপারে। ফ্লুয়েকিগার ও ইয়ুনকে তখন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা ছিল একটা বেসরকারি হাসপাতাল, যেখানে পিয়ংইয়ংয়ে থাকা বিদেশি কূটনীতিকদের প্রায়ই চিকিৎসা দেওয়া হয়। তৃতীয় তলায় বদ্ধ এক আইসিইউ রুমে ফ্লুয়েকিগারকে এক ফ্যাকাশে চেহারার নাকে নল লাগানো লোকের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। এই ছেলেই কি অটো? ফ্লুয়েকিগার ছবিতে অটোকে যেভাবে দেখেছিলেন, চোখের সামনে দেখে অনেক ভিন্ন মনে হয়েছে।
ফ্লুয়েকিগার তখন অটোর কানের পাশে তালি দেন। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তার মন দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তার দুই সন্তান আছে। তাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখার কল্পনাও করতে পারেননি। ইয়ুনও প্রায় অটোর সমবয়সী নিজের ছেলের কথা চিন্তা করছিলেন আর ভাবছিলেন ওয়ার্মবিয়ার দম্পতি তাদের ছেলেকে দেখলে কেমন অনুভব করবেন।
উত্তর কোরিয়ার দুই চিকিৎসক জানান, অটো হাসপাতালে এসেছিলেন এক বছরেরও আগে। প্রমাণ হিসাবে তারা কিছু হাতের লেখা চার্ট দেখান। মস্তিষ্কের কয়েকটি স্ক্যান দেখে বোঝা যায়- অটোর মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। ফ্লুয়েকিগার এক ঘণ্টা সময় নিয়ে অটোকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু তার অবস্থা শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল; অটো আর আগের অটো নেই। যদিও হাসপাতালে আনার পর থেকে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছিল (তার একটা ট্রাকিওটমির ক্ষত ছিল, যার মাধ্যমে মেশিন দিয়ে তাকে শ্বাস নিতে হয়েছিল)। কিন্তু তিনি এমন অবস্থায় ছিলেন, যেখানে তিনি জাগ্রত থাকলেও তার কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া ছিল না। অর্থাৎ, তার মৌলিক রিফ্লেক্সগুলো কাজ করলেও সচেতনতা বোধ ছিল না।
উত্তর কোরীয়রা ফ্লুয়েকিগারকে জানায়, তিনি যেন একটা রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন, যেখানে বলা হয়েছে অটোকে এই হাসপাতালে খুবই যত্ন নিয়ে দেখা হয়েছে। ফ্লুয়েকিগারের কাছে এগুলো ছিল তখন খুবই গৌণ বিষয়। কিন্তু তাকে মিথ্যা বলতে হয়নি। কারণ অটো আসলেই ভালো যত্ন পেয়েছিলেন। যদিও ওই রুমের বেসিনই কাজ করছিল না। কিন্তু অটো শুয়ে থাকার ফলে তার শরীরে কোনো ক্ষতের সৃষ্টি হয়নি, কোমার রোগীদের ক্ষেত্রে যেটা নিয়ে পশ্চিমা হাসপাতালগুলোও সংগ্রাম করে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া তখনো অটোকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে তৈরি ছিল না।
রাতভর চলতে থাকে আলোচনা। পরদিন সকালে ফ্লুয়েকিগার ও ইয়ুনকে নিয়ে যাওয়া হয় পিয়ংইয়ং শহরের কেন্দ্রস্থলে এক হোটেলে। এখানের এক কনফারেন্স রুমে অন্য তিন আমেরিকান বন্দীকে এক এক করে নিয়ে আসা হয়। এই তিন কোরীয়-আমেরিকানকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর থেকে বাইরের দুনিয়ার সাথে তাদের প্রায় কোনো যোগাযোগই ছিল না। তারা কাঁদতে কাঁদতে ইয়ুনের কাছে তাদের পরিবারের কাছে তাদের বার্তা পাঠাতে বলেন। মাত্র ১৫ মিনিট পরই তাদের আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ইয়ুন বলেন,
আমি সত্যিই এই তিনজনকে আনতে না পেরে হতাশ ছিলাম। তাদেরকে রেখে আসাটা ছিল খুব কঠিন।
তারপর তারা গেস্টহাউজে ফিরে আসেন। সেখানে এসে ইয়ুন আবার উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন। তখন ইয়ুন শেষ চালটা চালেন,
আমি আমাদের লোকদের বলি জাপান থেকে বিমান নিয়ে চলে আসতে। উত্তর কোরীয়দের বলি, আমরা চলে যাব, হয় অটোকে নিয়ে যাব নয়তো রেখেই যাব। আমি তখন আর তর্ক করার কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাইনি। আমি নব্বই ভাগ নিশ্চিত ছিলাম তারা অটোকে ছেড়ে দেবে। আর আমার এই উদ্যোগ ওদেরকে সেটা করতে বাধ্য করবে।
উত্তর কোরিয়াতে বিমান অবতরণের অল্প কিছুক্ষণ আগে উত্তর কোরিয়ার এক কর্মকর্তা ইয়ুনের কাছে এসে বলেন, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অটোকে ছেড়ে দেবেন। আমেরিকানরা তখন হাসপাতালে ফিরে আসেন। এক উত্তর কোরীয় বিচারক কালো স্যুট পরে এসে অটোর দণ্ড লঘু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মোটরগাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স তখন সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যায়। তারা নিরাপত্তা গেট পার হয়ে টারমাকে পৌঁছায়, যেখানে গালফস্ট্রিম তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিমানটি যখন উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমা পার হয়ে যায়, তখন কোনো ধরনের উদযাপন করা হয়নি। কারণ পুরো টিমই জানত অটোকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সময় তাদের হৃদয় ভেঙে যাওয়া ছবি দেখতে হবে। ইতোমধ্যে ফ্লুয়েকিগার অটোকে বুকে টেনে নেন, তার ডায়াপার বদলে দেন। তার কানে ফিসফিস করে বলেন- তিনি এখন মুক্ত। ঠিক যেমনটা কোনো বাবা তার শিশুকে আদর করেন।
৭.
অটো ফেরার দুই দিন পর ফ্রেড ওয়ার্মবিয়ার অটোর স্কুলে গিয়ে বক্তৃতা দেন। তিনি অটোর সেই লিনেন ব্লেজারটা পরেছিলেন, যেটা অটো তার জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় পরেছিলেন। তিনি সামনে থাকা সাংবাদিকদের সামনে চোখের পানি ফেলে বলেন,
অটো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার জন্য পাগল। আমি খুব খুশি যে তুমি বাড়ি ফিরে এসেছ।
তিনি ওবামা প্রশাসনকে দায়ী করেন অটোকে আরো আগে মুক্ত করতে না পারায়, এবং একইসাথে ট্রাম্প প্রশাসনকে ধন্যবাদ দেন। তার ছেলের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন, “আমরা তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার চেষ্টা করছি।” অটোর কথা বলতে গিয়ে কখনো কখনো তিনি অতীত কাল ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন।
ফ্রেড স্কুল জীবনের পর থেকেই যে উদ্যোম নিয়ে উদ্যোক্তা হতে নেমেছিলাম, একইভাবে শুরু থেকেই অটোর মুক্তির জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে আসছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে এক ডজনেরও বেশি বার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও অন্যান্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের সাথে তার নিস্ফল এক বছর পার হওয়ার পর তিনি মনে করেন অনেক ধৈর্য ধরেছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির শুরুর দিকে তিনি ফক্স নিউজে কথা বলতে যান। কারণ তিনি জানতেন প্রেসিডেন্ট এই চ্যানেলের ভক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি বলেন,
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আমি আপনাকে বলছি- আমার ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসুন। আপনিই এখানে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন (ওবামা প্রশাসনের সাথে)।
দ্রুতই প্রশাসন অটোর ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে দেখা শুরু করে।
অটো যখন কোমায় থাকা অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসলেন, তখন ফ্রেড পুনরায় তার বিচার নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ফ্রেডের কাছে তার ছেলের ওপর নির্যাতনের প্রমাণ ছিল স্পষ্ট। একসময়ের উদ্যোমী তরুণের মস্তিষ্ক এখন মারাত্মকভাবে আহত। তার আগের সোজা দাঁতগুলো এখন অদলবদল করা। তার পায়ে একটা বড় ক্ষত। চিকিৎসকরাও বটুলিজমের কোনো লক্ষণ দেখতে পাননি, যেটা ছিল উত্তর কোরিয়ার ভাষ্য। অন্যদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক অজ্ঞাতনামা জ্যেষ্ঠ আমেরিকান কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে খবর এসেছে, সরকার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরেছে, অটোকে উত্তর কোরিয়ার হেফাজতে রাখার সময় বারংবার আঘাত করা হয়েছিল।
অটো ফিরে আসার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসে। চিকিৎসকরা তখন ফ্রেড ও সিন্ডিকে নিশ্চিত করেন, তাদের ছেলের জ্ঞান আর কখনো ফিরবে না। তার নাকের নল খুলে ফেলা হয়। তারা ছয় দিন পর বাড়িতে ফিরের আসার আগপর্যন্ত অটোর বিছানার পাশেই থাকেন। তারা তখন মৃত অটোকে বাড়ি নিয়ে আসেন।
শত শত মানুষ রাস্তায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় অটোর শবযাত্রা দেখার জন্য। অনেকে হাত দিয়ে ‘ডব্লিউ’ এর মতো অঙ্গভঙ্গি করে তার স্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করছিল। ফ্রেড একটা আমেরিকান পতাকার টাই পরে ম্লান দৃষ্টিতে তার ছেলের বাড়ি ফেরা সম্পূর্ণ হতে দেখেছিলেন।
কিছুদিন শোকের পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রেড ও সিন্ডি ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অনুষ্ঠানে আসেন। তখন তারা প্রেসিডেন্টের নজরে আসার জন্য আরো জোরালো চেষ্টা করেন। তারা উত্তর কোরীয়দের “সন্ত্রাসী” বলে আখ্যা দেন, যারা অটোকে “উদ্দেশ্যমূলকভাবে আঘাত করেছে”। ফ্রেড তখন আঘাতের ফলে অটোর দাঁত ও পায়ের অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দেন, এবং প্রশাসনের কাছে দাবি জানান এই স্বৈরতন্ত্রের যেন শাস্তি হয়। অল্প সময় পরেই প্রেসিডেন্ট তার সম্মতি প্রকাশ করে টুইট করেন, “অসাধারণ ইন্টারভিউ”, এবং আরো উল্লেখ করেন অটোকে “উত্তর কোরিয়া এমনভাবে নির্যাতন করেছে যা বিশ্বাসেরও উর্ধ্বে”।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার লবিংয়ের জন্য ফ্রেড ভাড়া করেন এক আইনজীবীকে, যিনি বিশেষ কাউন্সিলের রাশিয়া তদন্তের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের হয়ে লড়েছিলেন। নভেম্বরের শুরুতে কংগ্রেস উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাংকিংয়ের অবরোধ আরোপ করে, যার নামকরণ করা হয় অটোর নামে। ওই মাসেরই পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প বলেন, উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
অটোর মৃত্যুর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার শত্রুতা চরমে পৌঁছে। ট্রাম্প ও কিম তখন কার পারমাণবিক বোমার বোতাম কত বড় আর শক্তিশালী, সেটা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। পর্দার আড়ালে জোসেফ ইয়ুনের মতো উদারপন্থী কূটনীতিকদের জায়গায় আসছিলেন জন বোল্টনের মতো কট্টরপন্থী কূটনীতিকরা। জন বোল্টন ছিলেন ইরাক যুদ্ধের অন্যতম রূপকার। তখন যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, এক আমেরিকান কূটনীতিক সিউলে থাকা এক বন্ধুকে বলেছিলেন- তারা মালামাল নিয়ে যেন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বের হয়ে যান।
টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এবং আনুষ্ঠানিক বক্তব্যগুলোতে রিপাবলিকান নেতারা অটোর মৃত্যুর জন্য কিম জং উনকে জবাবদিহিতার সম্মুখীনে আনার কথা বলতে থাকেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গে বলেন, তাদের শত্রু অটো ওয়ার্মবিয়ারকে নির্যাতন করেছে এবং চমৎকার এই যুবককে হত্যা করেছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ভাষণে অঙ্গীকার করেন উত্তর কোরিয়াকে “সর্বোচ্চ চাপে” রাখার এবং অটোর স্মৃতিকে সম্মান জানানোর। গ্যালারিতে থাকা অটোর বাবা-মা তখন কাঁদছিলেন। সিন্ডি জাতিসংঘে বলেন, “আমি অটোর মৃত্যুকে বৃথা যেতে দিতে পারি না।” ২০১৮ সালের এপ্রিলে ওয়ার্মবিয়ার পরিবার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের ছেলেকে “নির্দয়ভাবে নির্যাতন ও হত্যা” করার জন্য।
ট্রাম্প ও তার প্রশাসন অটোর ওপর শারীরিক নির্যাতনের গল্প প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেও এর কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল না। ওয়ার্মবিয়াররা যেদিন জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে ঘোষণা দেন, অটোকে নির্যাতন ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আহত করা হয়েছে, তার পরের দিন সহিংসতার কারণে হওয়া মৃতদেহ নিয়ে পরীক্ষা করা এক ডাক্তার লক্ষী কোদে সাম্মারকো অপ্রত্যাশিতভাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তিনি অটোর মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন- এর আগে তিনি ওয়ার্মবিয়ারদের মানসিক অবস্থাকে সম্মান জানিয়ে এটা নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু তার প্রাপ্ত আলামত ও অটোকে পরীক্ষা করা অন্যান্য চিকিৎসকদের পাওয়া ফলাফল ওয়ার্মবিয়ারদের দাবিকে বিরোধিতা করে।
ফ্রেড বলেন, অটোর দাঁতগুলো প্লাইয়ার্স দিয়ে তুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্মারকো তার পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় দেখেন, দাঁতগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এমন ছিল। তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতও দেখতে পাননি। তার পায়ের ক্ষতগুলোও কোনো কিছুই নির্দেশ করছিল না। শারীরিক নির্যাতনের অন্য লক্ষণগুলোও অনুপস্থিত ছিল। তার মস্তিষ্কের দুই দিকেই একইসাথে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব ছিল। মাথায় আঘাত হলে পুরো মস্তিষ্কে না থেকে ক্ষতগুলো অপ্রতিসমভাবে থাকত।
ওয়ার্মবিয়াররা সার্জিক্যাল অটোপসি করার ব্যাপারে অনুমতি না দিলেও অটোর শরীর স্ক্যান করে কোনো অস্থির ফ্র্যাকচার বা আঘাতের অন্যান্য কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে ওয়ার্মবিয়ারদের দাবির ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,
তারা ভুক্তভোগী বাবা-মা। তারা কী বলেছেন, বা তাদের উপলব্ধি কী, এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু এখানে এই অফিসে আমরা কোনো উপসংহারে পৌঁছানোর ব্যাপারে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করি।
অটো ফিরে আসার পর আরো যে তিনজন তার চিকিৎসা করেছিলেন, তারাও কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন খুঁজে পাননি।
অটোর আঘাতের উৎস একটা রহস্য হয়েই থাকবে। সাম্মারকো বলেন,
আমরা কখনোই জানতে পারব না অটোর কী হয়েছিল, যদি না যারা সেখানে উপস্থিত ছিল, তারা সামনে এসে বলে, ‘অটোর সাথে এই এই হয়েছিল’।