সাংবাদিকতার পাঠে একটি দর্শনের বহুল প্রচলন রয়েছে, “Bad news is good news. Good news is no news. No news is bad news.” অর্থাৎ খারাপ সংবাদই ভালো সংবাদ। ভালো সংবাদ কোনো সংবাদ নয়। আর কোনো সংবাদ না থাকা খারাপ সংবাদ।
কথাটি অনেকটা ধাঁধাঁর মতো শোনাতে পারে, বিশেষত আপনার যদি সাংবাদিকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকে। তাই চলুন, গোটা বিষয়টি আপনার সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করা যাক।
শুরুতেই একটি বিষয় খোলাসা করে নেয়া দরকার। সাংবাদিকতার সাথে যারা জড়িত, তারা যে মানুষের সামনে সত্য উন্মোচনের কাজ করে, এবং সত্যান্বেষণই যে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এটিও ভুলে গেলে চলবে না যে, সংবাদ তাদের কাছে একটি পণ্যও।
গোয়ালা যেমন প্রতিদিন আপনার বাসায় এসে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে যায় কেবল আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদে নয়, তার নিজের জীবিকা উপার্জনের লক্ষ্যেও, তেমনই সাংবাদিকরাও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংবাদ সংগ্রহ করে এবং তা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে শুধু নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নয়, এর সাথে তাদের রুটিরুজির ব্যাপারটিও জড়িত বলে।
তাহলে একটি বিষয় পরিষ্কার, সংবাদ হলো সাংবাদিকদের কাছে একধরনের পণ্য (এই বিবৃতির উদ্দেশ্য সাংবাদিকতা পেশা বা সাংবাদিকদের কোনোভাবেই হেয় করা নয়)। এবং অন্য যেকোনো ব্যবসায়ীর মতো একজন একজন সাংবাদিকও অবশ্যই চাইবেন তার পণ্যের সর্বোচ্চ কাটতি নিশ্চিত করতে। তাই তাকে শুধু সংবাদের সামাজিক গুরুত্ব বিচার করলেই চলবে না, অর্থাৎ সমাজকে কোন সংবাদটি জানানো বেশি জরুরি তা ভাবলে চলবে না, নিজের স্বার্থে এটিও ভাবতে হবে যে কোন সংবাদটি মানুষ বেশি দেখতে, শুনতে বা পড়তে চাইবে।
এখনই আসছে সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কোন ধরনের সংবাদ মানুষ বেশি চায়? উদাহরণ প্রদানের সুবিধার্থে ভাবা যাক শুধু সংবাদপত্রের পাঠকদের কথা। মনে করা হয়ে থাকে, খারাপ সংবাদই পাঠকদের আকৃষ্ট করে বেশি। যেসব সংবাদে সমাজ, দেশ বা বিশ্ব সম্পর্কে নেতিবাচকতার উল্লেখ রয়েছে, পাঠক চায় সেই সংবাদগুলো বেশি গুরুত্বের সাথে পড়তে। সুতরাং খারাপ সংবাদের কাটতি সর্বাধিক। তাই সাংবাদিকরা খারাপ সংবাদকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে থাকেন।
একইভাবে ধরা হয়ে থাকে, ভালো সংবাদ পাঠকদেরকে খুব একটা ভাবাবেগে আপ্লুত করে না। কারণ সচরাচর ভালো সংবাদ বলতে বোঝানো হয় সেই সংবাদকে, যেখানে সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছে। যে ঘটনায় সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে, সেখানে তো কোনো নতুনত্ব বা নাটকীয়তা নেই। ওই বিষয়ক সংবাদটি পড়ার আগে স্রেফ শিরোনাম দেখেই পাঠক বুঝে যাচ্ছে, আসলে কী হয়েছে। তাই তারা চাইলে সংবাদটিকে এড়িয়ে গেলেও পারে।
অর্থাৎ ভালো সংবাদ পাঠকের না পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায়, ভালো সংবাদের কাটতি কম। সে কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে আপাতদৃষ্টিতে যে সংবাদটি ভালো সংবাদ, একজন সাংবাদিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিই হয়ে ওঠে খারাপ সংবাদ। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো সংবাদকে সাংবাদিকরা এড়িয়ে যায়, কিংবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে থাকেন। ব্যতিক্রমও অবশ্য রয়েছে। কোনো বিরল অর্জন, যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জয় বা বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি শুধু প্রকাশিতই হবে না, প্রথম পাতায় ফলাও করে প্রকাশিত হবে।
এবার আসা যাক কোনো সংবাদই না থাকার প্রসঙ্গে। কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে হয়তো দেশে, কিংবা বিশ্বে, প্রকাশযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ঘটনাই ঘটল না। যেসব ঘটনা ঘটল, তা-ও অধিকাংশই ভালো ঘটনা, যেগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। তাহলে বলা যায়, ওই দিনে আসলে তেমন কোনো সংবাদই উৎপাদিত হলো না। আর কোনো সংবাদ উৎপাদন না হওয়ায় সাধারণ মানুষের কিছু না গেলে আসলেও, সাংবাদিকদের জন্য নিঃসন্দেহে সেটি একটি মস্ত খারাপ সংবাদ। (এবং এ এমনই এক খারাপ সংবাদ, যা প্রকাশযোগ্য নয়!)
সুতরাং খারাপ সংবাদ, ভালো সংবাদ এবং কোনো সংবাদ না থাকা বিষয়ক ধাঁধাঁর তো সমাধান মিলল। কিন্তু তারপরও অনেক কৌতূহলী পাঠকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এতক্ষণ যা যা বলেছি, তা কি কোনো প্রমাণিত সত্য? অর্থাৎ কথাগুলোর স্বপক্ষে কি কোনো যুক্তি-প্রমাণ আছে?
আলবৎ আছে। এর স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি-প্রমাণ হিসেবে আমরা উপস্থাপন করতে পারি পিউ রিসার্চ সেন্টার হতে প্রকাশিত Two decades of American news preferences শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধটি। মাইকেল রবিনসন রচিত এই প্রবন্ধটি মূলত ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের ব্যবধানে, যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ বিষয়ক ১৬৫টি পৃথক জরিপের সমন্বয়ে রচিত।
প্রবন্ধটিতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ রয়েছে এমন সংবাদসমূহকে ১৯টি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে দেখানো হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে মানুষ সবচেয়ে ‘গভীরভাবে অনুসরণ’ করেছে যে বিষয়ক সংবাদ, তা হলো যুদ্ধ ও জঙ্গিবাদ। এরপর একে একে এসেছে বাজে আবহাওয়া, মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনীতি, অপরাধ ও সামাজিক সহিংসতার মতো বিষয়গুলো। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আগ্রহোদ্দীপক অধিকাংশ সংবাদই ছিল নেতিবাচক।
এই প্রকাশনা থেকে একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোনো সংবাদের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তখনই তুঙ্গে ওঠে, যখন সংবাদটি কোনোভাবে তাদের নিজেদের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলার আভাস দেয়। যেমন যুদ্ধ, জঙ্গিবাদ বা দুর্যোগের সংবাদে মানুষ বেশি আগ্রহ দেখায়, কারণ তাদের মনের মধ্যে ভয় থাকে যে এগুলো তাদের জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে।
কিন্তু কোনো সংবাদের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ চরমভাবে হ্রাস পায়, যখন তাদের নিজেদের জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলছে, কোনোভাবে সেটি হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা নেই। এরকম অবস্থায় মানুষ সংবাদ পাঠ এবং সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকাকে জরুরি বলে মনে করে না, যার ফলে সংবাদপত্রের কাটতি বা নিউজ চ্যানেলের টিআরপি-ও যায় কমে।
পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গণমাধ্যমের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহ সম্পর্কে তারা নেতিবাচক বা খারাপ সংবাদই বেশি প্রকাশ করে। আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকার কোনো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সংবাদ তারা সচরাচর প্রকাশ করে না। কিন্তু যদি হুট করে কোনোদিন করে বসে, ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে সেটি হয় 3D’s সম্পর্কিত। অর্থাৎ সংবাদটির বিষয়বস্তু Death (মৃত্যু), Disease (রোগ), কিংবা Disaster (দুর্যোগ)।
মর্ট রোজেনব্লাম যুক্তরাষ্ট্রের একজন খুবই নামকরা আন্তর্জাতিক সাংবাদিক। সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের হয়ে তিনি বেশ কিছু যুদ্ধবিধ্বস্ত ও তৃতীয় বিশ্বের দেশে গিয়েছেন সংবাদ সংগ্রহ করতে। সেসব দেশে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তার বহুল আলোচিত বই Coups and Earthquakes: Reporting the World for America।
বইটিতে রোজেনব্লাম তুলে ধরেন, আমেরিকান পাঠকের সামনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে ওসব দেশের সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা ভূমিকম্প, অর্থাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই কেন বেশি প্রাধান্য দিতে হয়েছে। কারণটি খুব সহজ, আমেরিকানরা অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ সম্পর্কে এসব সংবাদই পড়তে পছন্দ করে।
রোজেনব্লামের এই বইয়ের মাধ্যমেই সাংবাদিকতার পাঠে পরিচিত হয়ে ওঠে Coups and Earthquakes Syndrome কথাটি, যা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় ঠিক কী কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ সম্পর্কে কেবল নেতিবাচক সংবাদই প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি এ থেকে এটিও প্রতীয়মান হয় যে, গণমাধ্যমের প্রভাবেই মূলত পশ্চিমা বিশ্বের অধিবাসীরা তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে কেবল নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
যা-ই হোক, পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদ উপস্থাপনাকে বিদায় বলে ফিরে আসা যাক বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন সাংবাদিকতার বিষয়ে। একটি ঘটনা যে সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে সংবাদ হিসেবে উপস্থাপনের উপযোগী হয়ে ওঠে, সেগুলোকে বলা হয় সংবাদ মূল্য। একেকজনের কাছে সংবাদমূল্যের সংখ্যা একেকরকম হতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে আমরা আটটি বৈশিষ্ট্যকে একটি সংবাদের সংবাদ মূল্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সেগুলো হলো:
- প্রভাব: একটি ঘটনা কতজন মানুষকে প্রভাবিত করে।
- সময়োপযোগিতা: ঘটনাটি কি একদম সাম্প্রতিক, অর্থাৎ এখনো সেটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে কি না।
- বিশিষ্টতা: যার সাথে ঘটনাটি ঘটেছে, সে সমাজের চোখে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি কি না।
- নৈকট্য: ঘটনাটির সাথে সাধারণ মানুষ কতটা নৈকট্য বা একাত্মতা অনুভব করবে।
- পুনরাবৃত্তি: ঘটনাটি কি বিচ্ছিন্ন, নাকি সেটির পুনঃ পুনঃ অবতারণা ঘটছে।
- অস্বাভাবিকতা: ঘটনাটির কোনো অদ্ভূত বা অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে কি না, অর্থাৎ যে ধরনের ঘটনা সচরাচর ঘটে না।
- পরস্পরবিরোধিতা: ঘটনায় দুটি পক্ষ রয়েছে কি না, এবং তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব রয়েছে কি না।
- নেতিবাচকতা: ঘটনাটি নেতিবাচক বা অমঙ্গলকর কি না।
সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, ‘নেতিবাচকতা’ কোনো ঘটনা সংবাদ কি না, তা নির্ধারণেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এছাড়া নির্ধারক হিসেবে অন্য আর যেসব উপাদান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর সাথেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নেতিবাচকতার যোগাযোগ রয়েছে। যেমন: অস্বাভাবিকতা বা পরস্পরবিরোধিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকতার দিকে ইঙ্গিত দেয়। আবার কোনো ঘটনা নেতিবাচক হলেই মানুষ সেটির প্রতি বেশি নৈকট্য অনুভব করে, এবং নেতিবাচক ঘটনা বারবার ঘটতে থাকলেই তা মানুষের মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
আবার একটি সংবাদে যে সবসময়ই নেতিবাচকতার দিকটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়, তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, দেশে একটি নির্বাচন হয়েছে, এবং একটি দল জয়লাভ করেছে। সেই দলটির জয়লাভের খবরকে আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক সংবাদই মনে হতে পারে, কিন্তু সেই একই সংবাদই আবার বিজিত দলের জন্য নেতিবাচক সংবাদ। কিংবা ধরুন কোনো ক্রিকেট ম্যাচের কথা। বাংলাদেশ খেলছে না সেখানে। অন্য যেকোনো দুটি দলের মধ্যে খেলা হচ্ছে। সেই খেলার প্রতিবেদন যত নিরপেক্ষভাবেই প্রকাশিত হোক না কেন, জয়ী দলের সমর্থকদের জন্য সেটি যেমন ইতিবাচক সংবাদ, হেরে যাওয়া দলের সমর্থকদের জন্য ঠিক তেমনই নেতিবাচক সংবাদ। সুতরাং তথাকথিত ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ সংবাদেও অনেকসময় নেতিবাচকতা লুকিয়ে থাকে বলেই সেগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই শুধু খুনোখুনি, রক্তপাত, চুরি-ছিনতাই-লুটতরাজ প্রভৃতি নেতিবাচক সংবাদই চোখে পড়ে। অবশ্যই আমাদের সমাজে শুধু খারাপ ঘটনাই ঘটে না, অনেক ভালো ঘটনাও ঘটে। আবার ভালো বা খারাপ ঘটনার বাইরে অনেক সাধারণ ঘটনাও ঘটে। কিন্তু খারাপ ঘটনার প্রতি আগ্রহ বেশি বলে সেগুলোর উপরই বেশি আলোকপাত করা হয়, আর সেগুলোর তলানিতে চাপা পড়ে যায় ভালো কিংবা সাধারণ ঘটনা।
তবে এই লেখায় এখনই ইতি টানছি না। খারাপ সংবাদ মানেই ভালো সংবাদ, এই বিষয়টি এতদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সত্যও যে কখনো পরিবর্তিত হতে পারবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এক যুগ আগে যা সত্য ছিল, তা এখন পুরোপুরি মিথ্যা না হোক, অর্ধ-সত্যে পরিণত তো হতেই পারে। খারাপ সংবাদ-ভালো সংবাদ তত্ত্বে এমনই রায় দিয়েছে প্রোসিডিংস অভ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সেসে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ। সেখানে দাবি করা হয়েছে, সব মানুষেরই আগ্রহ কেবল খারাপ সংবাদের প্রতি থাকে না। বরং সাংবাদিকরা এতদিন যা ভেবে এসেছে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ ভালো সংবাদের প্রতি অধিক আগ্রহ পোষণ করে। তাই ভবিষ্যতে ইতিবাচক সংবাদেরও জমজমাট বাজার সৃষ্টি হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লিখিত গবেষণাটি পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অভ মিশিগানের স্টুয়ার্ট সরোকা। তিনি যোগাযোগ এবং গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক। তার গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল এটি খুঁজে বের করা যে নেতিবাচক সংবাদের প্রতি আকর্ষণের যে ‘নেগেটিভিটি বায়াস’, তা কি একটি বৈশ্বিক ফেনোমেনন, নাকি কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ।
সরোকার নেতৃত্বাধীন গবেষণা দলটি বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে মোট ১,১৫৬ জন অংশগ্রহণকারীকে বেছে নেন। অংশগ্রহণকারী নির্বাচনে ঘানা থেকে শুরু করে সুইডেন, আবার চিলি, অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় সব ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়। এরপর তাদেরকে বিবিসি নিউজের বেশ কিছু সংবাদের ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। ভিডিও ক্লিপগুলোতে থাকে ভালো ও খারাপ সংবাদের সংমিশ্রণ। চিড়িয়াখানা থেকে গরিলাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেয়ার মতো ইতিবাচক সংবাদের উপস্থিতি যেমন থাকে, তেমনই থাকে জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বিষয়ক নেতিবাচক সংবাদও। এছাড়া প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক স্থানীয় সংবাদও দেখানো হয়।
অংশগ্রহণকারীরা যখন সংবাদ দেখায় ব্যস্ত, তখন গবেষকরা পরিমাপ করতে থাকেন তাদের হৃদস্পন্দন এবং ত্বকের প্রকৃতি পরিবর্তন। এগুলো পরিমাপের কারণ, এদের সাথে সরাসরি মনস্তত্ত্বের যোগাযোগ রয়েছে, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি কতটা আগ্রহী ও মনোযোগী, তা বোঝা যায় এগুলোর মাধ্যমে। তাছাড়া রিয়েল-টাইমে একজন দর্শকের অজ্ঞাতেই তার প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও স্বরূপও নির্ধারণ করা যায় এদের সাহায্যে।
গবেষকরা দেখতে পান, নেতিবাচক সংবাদ দেখার সময়ই অংশগ্রহণকারীদের হৃদস্পন্দন ও ত্বকের প্রকৃতি পরিবর্তনের মাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। অর্থাৎ যে নেগেটিভিটি বায়াসের কথা শুরুতে বলা হচ্ছিল, তা বিশ্বের সব অঞ্চলেই বিদ্যমান। এ ব্যাপারে প্রবন্ধে লেখা হয়,
“গবেষণাটি থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, নেতিবাচক সংবাদ দেখা বা পড়ার সময়ই বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষ বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা সম্ভবত বিশ্বব্যাপী কেন বিপুল পরিমাণ নেতিবাচক সংবাদ উৎপাদিত হয়, সে প্রশ্নের সদুত্তর লাভের ক্ষেত্রে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছি।”
কিন্তু এখানেই শেষ নয় পুরো গল্পের। ইতিমধ্যেই যে উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে গবেষকরা এবার প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর জন্য পৃথক মডেল সৃষ্টির মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন যে সংবাদে নেতিবাচকতার মাত্রা যদি আরো বাড়ানো হয়, তাহলে তাদের হৃদস্পন্দন ও ত্বকের প্রকৃতি পরিবর্তনের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে কি না।
অনেক অংশগ্রহণকারীর ক্ষেত্রেই এসব শারীরবৃত্তিক পরিমাপের মাত্রা বৃদ্ধি পেলেও, কারো কারো ক্ষেত্রে প্রদর্শিত প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক বৈচিত্র্যও দেখা যায়। কিছু অংশগ্রহণকারীর প্রতিক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তনই দেখা যায় না, আবার কারো কারো সাড়া প্রদানের মাত্রা বাড়ার বদলে কমে যায়। এই ব্যবধানগুলোর সাথে অংশগ্রহণকারীদের নিজ দেশ বা সংস্কৃতির তেমন কোনো সংযোগ পাওয়া যায় না, যার মাধ্যমে বিষয়টির কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাঁড়া করানো সম্ভব।
অনেকের কাছেই গোটা বিষয়টি এতক্ষণে বেশ জটিল ও ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই জটিলতা ও ধোঁয়াশার মাধ্যমেই গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, গণমাধ্যম যদি দর্শক বা পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে চায়, তাহলে তাদের শুধু নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের কোনো প্রয়োজন নেই।
“যদিও গড়পড়তা প্রবণতা এমনই হবে যে নেতিবাচক সংবাদ বা কনটেন্টের প্রতিই দর্শক বা পাঠকরা বেশি আগ্রহী ও আকর্ষিত হয়, কিন্তু এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিবিশেষেরও দেখা পাওয়া যাবে, যারা ভিন্ন বা অপেক্ষাকৃত পরিবর্তনীয় সংবাদকেই বেছে নেবে।”
সামগ্রিকভাবে গবেষকরা প্রবন্ধের শেষে যে বার্তাটি দেয়ার চেষ্টা করেছেন তা হলো, নেতিবাচক সংবাদের দর্শক বা পাঠক সবসময়ই বেশি থাকবে বটে, কিন্তু গণমাধ্যম কিংবা সাংবাদিকরা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ফলাফল লাভ করবেন তখনই, যখন তারা বিদ্যমান নেতিবাচক সংবাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাঝে ইতিবাচকতার পরিমাণ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করবেন।
পরিশেষে বলা যায়, খারাপ সংবাদ মানেই ভালো সংবাদ হলেও, ভালো সংবাদ মানেই অ-সংবাদ বা খারাপ সংবাদ নয়। খারাপ ও ভালো সংবাদের আরেকটু পরিমিত অনুপাত সংবাদমাধ্যমের জন্য ইতিবাচকই হবে। আর তাহলে সাধারণ মানুষকেও পত্রিকার পাতায় কিংবা নিউজ চ্যানেলে শুধু নেতিবাচকতার বৃত্তেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে না, মাঝেমধ্যে তারা একটু তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুযোগও পাবে, যা পরের দিন আবারো তাদেরকে একই পত্রিকা বা নিউজ চ্যানেলে ফিরে আসার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করবে।
সাংবাদিকতা সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) টিভি রিপোটিং
২) রিপোর্টার হবে?
৩) বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস (১৭৮০- ১৯৪৭)
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/