পাপুয়া নিউগিনি রাষ্ট্রের সীমান্ত ঘেষে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশ। এই পাপুয়া প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসবাস করে ‘করওয়াই’ নামের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এরা ‘কোলুফো’ নামেও পরিচিত। জনসংখ্যার বিচারে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। পাপুয়ার গভীর জঙ্গলে এদের বসবাস।
পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ১৯৭৪ সাল নাগাদ একদল নৃবিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। সেই নৃবিজ্ঞানীরা জানান, এই আদিবাসীরা নিজেদের বসবাসের জন্য গাছের শীর্ষে ঘর তৈরি করে, যা রীতিমতো নৃতাত্ত্বিক জগতে আলোড়ন তৈরি করে। তাদের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পৃথিবীর প্রথম ‘ট্রি ডুয়েলার্স’ বা ‘গাছের অধিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
কিন্তু সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে এই স্বীকৃতি নিয়ে খানিকটা বিতর্ক ওঠে। বিবিসির ওই প্রতিবেদন অনুসারে, করওয়াই আদিবাসীদের ‘গাছের শীর্ষে তৈরি করা ঘর’ কৃত্রিম বা অবাস্তব। তাহলে কি যুগের পর যুগ গবেষকগণ আমাদের বোকা বানিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন করে আসছেন?
করওয়াই আদিবাসীরা ‘করওয়াই’ নামক নিজস্ব প্রাচীন ভাষায় কথা বলে। এদের অর্থনৈতিক আয়ের প্রধান উৎস গাঁজা চাষ। তবে গবেষকদের মতে, এটি তাদের আদি পেশা নয়। আধুনিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হলে ও পর্যটকদের আসা-যাওয়া বাড়লে তারা এই পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। গবেষকদের ধারণা, পশু শিকার করওয়াইদের আদি পেশা। করওয়াইরা এখনো তাদের খাদ্য হিসেবে শূকর, হরিণসহ বিভিন্ন প্রকারের বন্য প্রাণী গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া তাদেরকে পাম গাছ থেকে তৈরি সাগা এবং কলা খেতে দেখা যায়।
২০১৪ সালের আদমশুমারির সময় গণনায় নিযুক্ত কর্মীরা মোট ২৮৬৮ জন করওয়াই আদিবাসী সদস্যের সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়। সেখানে দেখতে পাওয়া যায়, হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন আদিবাসী সদস্য তাদের নাম লিখতে ও পড়তে পারেন। অর্থাৎ, শিক্ষার কোনো আলো বনের এই অধিবাসীদের এখনো স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি।
করওয়াই আদিবাসীদের নিয়ে পাপুয়ার জনসংখ্যা গণনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সানতোনো বলেন,
তাদের জীবনাচরণ দেখে মনে হয়েছে, তারা এখনো প্রস্তর যুগে বসবাস করছে। তারা কোনো পোশাক পরিধান করে না। তারা গভীর বনে গাছে বাসা তৈরি করে বসবাস করে। খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য তারা বন্য প্রাণী শিকার করে ভক্ষণ করে।
১৯৯০ সালের পূর্ব পর্যন্ত তারা বিনিময় প্রথার মাধ্যমে সকল সম্পদের আদান-প্রদান করত। কিন্তু পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে ১৯৯০ সাল নাগাদ প্রথমবারের মতো তারা মুদ্রার ব্যবহার শুরু করে। তবে এখনো তাদের নিজেদের মধ্যে বিনিময় প্রথা চালু আছে।
পারিবারিকভাবে করওয়াইরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বিয়েশাদীর ব্যপারে তাদের মধ্যে ‘ওমাহা কিনশিপ’ বা একই বংশের আলাদা পরিবারসমূহের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। এদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন রয়েছে।
সমাজ পরিচালনা ও বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে সমাজে একজন প্রভাবশালী সর্দার রয়েছেন। সাধারণত গুরু তার শিষ্যকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগ করে যান। সকল করওয়াই সদস্য মনে করেন, তাদের সর্দারের মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। ফলে ধর্মীয় বিবেচনাতেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন।
ধর্মীয়ভাবে তারা ‘জিমিজি’ নামক এক দেবতার উপাসনা করে। তারা বিশ্বাস করে, জিমিজি দেবতার আত্মা থেকে তাদের উৎপত্তি। দেবতাকে স্মরণে প্রতি বছর তারা ‘সাগা গ্রাব’ নামক একটি উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসবে তারা দেবতার উদ্দেশ্যে শূকর বলিদান করে। এছাড়া নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গান, জাদু প্রদর্শন ও নানা উপকথা পরিবেশন করে থাকে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, মানুষ মারা গেলে কর্মফলের ভিত্তিতে তাদের আবার পৃথিবীতে আসার প্রয়োজন হতে পারে। পরকালের দেবতা চাইলে তাদের আবার যেকোনো সময় দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পারেন।
১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ নাগাদ ইউনিভার্সিটি অফ ডেনভারের নৃবিজ্ঞানী পিটার ভান আরসডেল, ভূগোলবিদ রবার্ট মিট্টন এবং উচ্চতর যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ গ্রান্ড হোয়েফারের সমন্বয়ে গঠিত একটি গবেষণা দল যথার্থভাবে করওয়াই আদিবাসীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হন। তারা আপার এইলানদেন নদীর তীরে ১২ জন করওয়াই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যের সাথে কথা বলতে সক্ষম হন (এর আগে ১৯৭০ সালে একদল ডাচ-প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান মিশনারী তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলেও তা গবেষণার মানদণ্ডে উন্নীত ছিল না)।
১৯৮০ সালে জাপানের একটি টেলিভিশন প্রথমবারের মতো করওয়াই আদিবাসীদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে। এরপর ১৯৯৩ সালে আমেরিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট করওয়াইদের নিয়ে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। এরপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদেরকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিও তাদের উপর বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে তাদের জনপ্রিয় টেলিভিশন প্রোগ্রাম ‘হিউম্যান প্ল্যানেট’-এ ২০১১ সালে কয়েক পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচার করা হয়। সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া বিতর্কটি শুরু হয়েছে তাদের সেই প্রামাণ্যচিত্রকে ঘিরেই। বিবিসি জানায়,
করওয়াই আদিবাসীদের নিয়ে ২০১১ সালে প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্রে গাছের শীর্ষে তৈরি যে বাড়িগুলো দেখানো হয়েছে, তা বাস্তব নয়। কেননা সম্প্রতি তৈরি করা আরেক প্রামাণ্যচিত্রে ওই আদিবাসী জনগোষ্ঠীটি দাবি করেছে যে, সেই সময়ে যে বাড়িগুলো দেখানো হয়েছিল, তা ‘প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের স্বার্থেই তৈরি করা হয়েছিল’।
আদিবাসীরা জানান, প্রামাণ্যচিত্রে যে সকল ঘর দেখানো হয়েছে, সেখানে তারা কখনো বসবাস করেননি। সেগুলো পুরোপুরি কৃত্রিম ছিল। বিদেশিদের স্বার্থেই সেগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। আদিবাসীদের পক্ষ থেকে এমন দাবির প্রেক্ষিতে বিবিসির একটি ঊর্ধ্বতন দল সেখানে দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যান। তারা সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আগের প্রামাণ্যচিত্রে ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে মর্মে সত্যতা খুঁজে পান। বিবিসির এক মুখপাত্র বলেন,
বিবিসি হিউম্যান প্ল্যানেট সিরিজের প্রামাণ্যচিত্রে গাছের শীর্ষে যে ঘর দেখানো হয়েছে, তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সেখানে বিবিসির একটি দল প্রেরণ করা হয়। তারা সেখানে গিয়ে জানতে পারে, আদিবাসী গোত্রটি সম্পর্কে আমাদের মনে যে চিত্রাঙ্কন পূর্বের প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি সঠিক নয়; সেখানে গাছের শীর্ষে যে ঘর দেখানো হয়েছিল, তা তাদের বসবাসের জন্য তৈরি ঘর থেকে অনেকটাই আলাদা।
মূলত ২০১১ সালের বিবিসির ওই ভিডিওতে গাছের শীর্ষে করওয়াইদের যে ঘর দেখানো হয়েছিল, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় অবস্থিত ছিল। এই ঘরগুলো ভিডিওটিকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল, যা গবেষণা ও সাংবাদিকতার নৈতিকতার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ফলে বিবিসির ওয়েবসাইট থেকেও পূর্বের প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, করওয়াইরা আসলেই বৃক্ষের উপরে ঘর তৈরি করে বসবাস করে না। তারা ওই প্রামাণ্যচিত্রে প্রদর্শিত উচ্চতার চেয়ে অনেক কম উচ্চতায় তাদের বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ করে, কিন্তু গাছের উপরেই করে। সেক্ষেত্রে তাদের ঘরের উচ্চতা সাধারণত ৫ মিটার থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বনজ কাঠ ও পাতা দিয়েই তারা তাদের ঘর নির্মাণ করে থাকে। বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই তারা এভাবে গাছের উপরে ঘর তৈরি করে আসছে বলে ধারণা করা হয়। বিশ্বের বুকে নানা বৈচিত্র্যময় আদিবাসীদের বসবাস থাকলেও গাছের উপরে বসবাস করে, এমন আদিবাসীদের সংখ্যা খুবই বিরল।