প্লাস্টিক কোনো সমস্যা না। আসল সমস্যা আমরা নিজেরাই। আমরা যদি যেখানে সেখানে প্লাস্টিক না ফেলতাম, সাগর তো এভাবে প্লাস্টিকে পূর্ণ হতো না। এভাবে পরিবেশ নষ্ট না করে, বরং চাইলেই আমরা এসব কাজে লাগাতে পারি।
– রাজাগোপালান বাসুদেভান
২০১৮ সালে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পদ্মশ্রী পদকজয়ী, তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের মাদুরাই শহরের অধ্যাপক রাজাগোপালান বাসুদেভান উদ্ভাবন করেন ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সড়কপথ নির্মাণের এক অভিনব পদ্ধতি। যে পদ্ধতির ব্যবহার বদলে দিতে চলেছে ভারতের সড়কপথ নির্মাণের ইতিহাস।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে অধিক টেকসই, সাশ্রয়ী ও গুণগত মানসম্পন্ন সড়ক পথ নির্মাণের এক অনন্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন তিনি। এ পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণে সময় যেমন কম লাগবে, তেমনই ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ থেকেও মুক্তি পাবে পরিবেশ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন একটি ঐতিহাসিক উদ্ভাবনাকে প্রথমে ঠিকমতো মূল্যায়নই করা হয়নি। তবুও থেমে যাননি রাজাগোপালান, আপন প্রতিভার দীপ্তিমালা ছড়িয়ে গেছেন নিরন্তর।
গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কাজ করেন রাজাগোপালান বাসুদেভান। মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে তিনি যথাক্রমে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিও সম্পন্ন করেন। পরের বছর ১৯৭৫ সালে তিনি তামিলনাড়ুর থিয়াগরাজরান কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন, এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যাপনা শুরু করেন। বর্তমানে সেখানেই তিনি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০০১ সালে প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণায় মন দেন তিনি। মূলত নিজ ওয়ার্কশপে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্যের কার্যকর নিষ্কাশন পদ্ধতি ও অবকাঠামোগত নির্মাণে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। সেখান থেকেই যুগান্তকারী আইডিয়াটি মাথায় আসে তার। অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষের সামনে আইডিয়াটি উপস্থাপন করে তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি।
থিয়াগরাজরান কলেজ পরিদর্শনকালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত বিজ্ঞানী ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম এ গবেষণার ব্যাপারে জানতে পেরে তাকে নিজ ক্যাম্পাসেই প্লাস্টিকের রাস্তা তৈরি করতে উৎসাহিত করেন।
তিনি আমাকে ধূসর রঙের রাস্তা নির্মাণ করতে বলেছিলেন, কারণ কালো রঙ তাপ শোষণ ও ধারণ করে।
-রাজাগোপালান বাসুদেভান
পরবর্তীতে ২০০২ সালে, তিনি নিজ ক্যাম্পাসে নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৬০ ফিট দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করেন। রাস্তাটি এখনও অক্ষত আছে।
২০০৪ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এ আইডিয়া উপস্থাপন করার সুযোগ পাবার পরই বদলে যায় চিত্র। অনন্য এ উদ্ভাবন দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে, ১০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাকে প্লাস্টিক রোডে রূপ দেয়ার ব্যাপারে অনুমোদনও দেন।
বিটুমিন নামের এক কালো হাইড্রোকার্বন আর নুড়ি পাথরের মিশ্রণ রাস্তায় বিছানো হয়। ডক্টর বাসুদেভান তার গবেষণায় দেখেন, বিটুমিন আর পাথরের মিশ্রণে গলিত প্লাস্টিক মেশানো হলে প্লাস্টিক এই দুই উপাদানকেই ধরে রাখে। বিটুমিন-মডিফাইড প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে টেনসাইল স্ট্রেংথ বৃদ্ধি পাবার ফলে রাস্তা হয় আরও বেশি নমনীয়, ঘাতসহ ও টেকসই। বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো রাস্তায় খানাখন্দের উৎপত্তিও হয় না। আর বিটুমিন ও নুড়ি পাথরের মিশ্রণের উপাদানগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা গলিত প্লাস্টিক পূরণ করে দেওয়ার ফলে জমে থাকা পানি থেকে অবকাঠামোগত ত্রুটিও দেখা দেয় না।
উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটির জন্য তিনি ২০০৬ সালে প্যাটেন্ট পান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ডক্টর রাজাগোপালানানের এই প্রযুক্তিতে।
ভারতের ‘স্টিল সিটি’-খ্যাত জামশেদপুরে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে ১২-১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথ নির্মাণ করেছে জাসকো। জাসকোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি এক কি.মি. দৈর্ঘ্য ও চার কি.মি. প্রস্থের রাস্তা নির্মাণে সাশ্রয় হয় ৫০০০০ ভারতীয় রূপি। কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের সাশ্রয় ছাড়াও প্রযুক্তিটি গ্রহণ করার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক মডিফাইড বিটুমিনে বানানো এসব রাস্তার কোয়ালিটি ও লাইফটাইম সাধারণ বিটুমিন রোডের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। এছাড়াও, প্রথম পাঁচ বছরে কোনো ধরনের বাড়তি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনও হয় না।
২০১৫ সালে ভোকারভেসেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠান মূলত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সড়কপথ নির্মাণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। পানির বোতল, প্লাস্টিক ব্যাগ, চকলেটের প্যাকেটের মতো নিত্যদিনের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস থেকে ৫০ মাইক্রন বেধের প্লাস্টিকের টুকরা বানিয়ে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে ভারতে আছে ৪১ লক্ষ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক পথের এক সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক। যার মধ্যে ৬৬ হাজার কিলোমিটার প্রধান সড়ক, আর ২৪ লক্ষ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ সড়ক। ৫০ হাজার কিলোমিটারেরও অধিক সড়কে ইতোমধ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রযুক্তি। অন্তত ১১টি রাজ্যে সরকারি প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তি গ্রহণ করা হয়েছে।
সাধারণত প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি চাপা দেওয়া অথবা পোড়ানো হয়। অথচ এই প্রক্রিয়াগুলোর কোনোটিই পরিবেশবান্ধব নয় এবং অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক থেকে রাস্তা তৈরি করার এ প্রক্রিয়াটিই হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশনের সবচেয়ে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব উপায়।
প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জীবনধারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার, প্লাস্টিক পোড়ালে বা মাটিচাপা দিলে পরিবেশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
-রাজাগোপালান বাসুদেভান
ঠিক এ কারণেই, ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুড়িয়ে বা মাটিচাপা না দিয়ে আবারও ব্যবহার করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন বাসুদেভান। বিভিন্ন উদ্ভাবনী ও গবেষণামূলক কাজের জন্য ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য সম্মাননাও জিতে নিয়েছেন তিনি। ‘সত্যমেব জয়তে’ নামক একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তার উদ্ভাবনী গবেষণার প্রদর্শনীও করা হয়েছিল।
দ্য বেটার ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
রাস্তা নির্মাণে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের সুবিধা অনেক। প্রক্রিয়াটি যেমন সহজ, তেমনি এতে নতুন কোনো মেশিনেরও প্রয়োজন নেই। প্রতি কিলো পাথরের সাথে ৫ গ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্যসহ মোট ৫০ গ্রাম বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। এতে করে বিটুমিনের পরিমাণ কমে যায়। প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে অ্যাগ্রিগেট ইমপ্যাক্ট ভ্যালু এবং ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের মান বৃদ্ধি পায়। রাস্তা ক্ষয়ের পরিমাণও ব্যাপক হারে কমে আসে।
এছাড়াও হেভি লোড ও হেভি ট্রাফিক সামাল দিতে সক্ষম প্লাস্টিক টারে বানানো নতুন এই রাস্তাগুলো বিটুমিন দিয়ে বানানো সাধারণ রাস্তার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী ও টেকসই। বৃষ্টি বা জলাবদ্ধতায় ক্ষতি হয় না বলে, এসব রাস্তায় কোনো গর্ত কিংবা ফাটল তৈরি হয় না, উচ্চ চাপ ও গতিতে চলার সময়ও পড়ে না চাকার দাগ। ল্যাবরেটরি টেস্টে দেখা গেছে, এসব রাস্তার লাইফটাইম সাত বছরেরও বেশি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অধিক সাশ্রয়ী এসব রাস্তার আয়ুষ্কালে সেরকম রক্ষণাবেক্ষণের কোনো প্রয়োজন পড়বে না।
সেন্ট্রাল রোড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের বানানো প্লাস্টিক টার রোডের পারফরম্যান্স স্টাডি থেকে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। সিপিসিবি ও এনআরআরডিএ মনোগ্রাফে সেসব প্রকাশও করেছে।
এসব বাদেও ভারতের প্লাস্টিক ম্যানের ঝুলিতে আছে ক্ষয়হীন রড, প্লাস্টোন এর মতো আবিষ্কার। প্লাস্টিক ও পাথরের মিশ্রণে তৈরি প্লাস্টোন (প্লাস্টিক+স্টোন) দিয়ে ফ্লোরিংয়ের কাজেও আসবে নতুনত্ব। বিশেষ করে ঘরের বাইরে যেকোনো ফ্লোরিংয়ে সিমেন্ট ব্লকের অন্যতম বিকল্প হতে পারে এই প্লাস্টোন। অবিরাম বৃষ্টিতে সিমেন্ট ব্লকের মতো ক্ষয়ে যায় না বলে সাশ্রয়ের দিক থেকেও এটি অনন্য।
রাজাগোপালান বাসুদেভানের বানানো পরিবেশবান্ধব ও দূষণমুক্ত এই আবিষ্কারটি ফ্রুগাল ইনোভেশনের এক অনন্য উদাহরণ। মূলত, কোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ ও উৎপাদন জটিলতা কমানোর প্রক্রিয়াকেই ফ্রুগাল ইনোভেশন বা ফ্রুগাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়।
যেখানে প্রতি বছর সড়কপথ নির্মাণে সরকার অজস্র অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে, সেখানে এই টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে খরচ ও পরিবেশ-দূষণের পরিমাণ কমে আসবে। সেই সাথে অন্যান্য রাস্তার তুলনায় এসব রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণেও তুলনামূলকভাবে কম খরচ হবে।
এছাড়াও, বাসুদেভানের মতে, ওয়্যারহাউজেই বানিয়ে সরাসরি রাস্তায় বসানো যায় বলে এই প্রযুক্তিতে কোনো ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। আর এ কারণে অন-সাইট প্রোডাকশন বা সরেজমিন উৎপাদন খরচও কমে আসবে।
একবিংশ শতাব্দীতে উন্নতির শিখরে চোখ রেখে অদম্য গতিতে ছুটে চলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক জীবনধারাকে দূষণবিরোধী ও পরিবেশবান্ধব করে তোলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর সে অগ্রযাত্রায় এক উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে ভারতের ‘প্লাস্টিক ম্যান’ রাজাগোপালান বাসুদেভানের অবদান।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিশ্ব’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/