সময়ের সাথে করোনার প্রকোপ যেন লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ যত দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিডিয়াতে ততই ক্ষিপ্রভাবে চীনবিদ্বেষী কথা বলছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি মনে করে, চীনের উহান শহরের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের ল্যাব থেকেই নতুন করোনাভাইরাসটি ছড়িয়েছে। তার ধারণা, আগামী নভেম্বরে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার বিজয় ঠেকাতেই চীন এই ঘৃণ্য কাজটি করেছে। এমনকি আমেরিকাতে করোনার প্রকোপে ব্যাপক প্রাণহানীর জন্যও তিনি সংবাদ সম্মেলনে সরাসরি চীনকে দায়ী করেছেন। করোনাকে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য চীনের একটি বাজে উপহার বলেও মন্তব্য করেন।
তবে প্রশ্ন হলো, তিনি এমনটি কেন করছেন? তার এই অভিযোগের আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি? চীন আসলে এমন কী করেছে যার জন্য তিনি বার বার তাদের দিকেই আঙুল তুলছেন? এটা কি শুধুই দায় এড়ানোর টালবাহানা, নাকি এর পেছনে রয়েছে ভূ-রাজনীতির কোনো চাল? উত্তরের খোঁজে চলুন একত্রে শুরু করি অনুসন্ধানী যাত্রা।
তদন্তের শুরুতেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে একেবারে করোনার উত্থানকালে। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর। স্থান চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরী। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৪২ মিনিট। চীনের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাটে উহান সেন্ট্রাল হসপিটালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ লি ওয়েনলিয়াং তার মেডিকেল স্কুল অ্যালামনাইয়ের পুরোনো বন্ধুদের সাথে মেসেজে কথা বলছিলেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে লি এক অজানা রোগের কথা তার বন্ধুদেরকে বলেন। স্থানীয় সামুদ্রিক প্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ের বাজারের সাতজন সেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। রোগটির উপসর্গ অনেকটা ২০০৩ সালের সার্সের মতোই। তিনি তার বন্ধু এবং প্রিয়জনদের তাই সাবধানে থাকতে বলেন। কিন্তু তার সেই খুদে বার্তার স্ক্রিনশট মুহূর্তের মাঝেই ভাইরাল হয়ে যায়।
তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুর্ঘটনাক্রমে লির বদৌলতে চীনের নাগরিক তথা বিশ্ববাসী সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি সম্পর্কে অবগত হয়। তাই তাকে কোভিড-১৯ এর প্রথম তথ্য প্রকাশকারী বা ইংরেজিতে হুইসেল ব্লোয়ারও বলা যায়।
তবে লি উইচ্যাটে করোনার কথা বললেও নতুন এই ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট করেন আরেক চীনা চিকিৎসক। তিনি উহানের হুবেই প্রভিন্সিয়াল হসপিটালের রেস্পিরেটরি অ্যান্ড ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের পরিচালক ঝাং জিজ্যান। ৫৪ বছর বয়সী ঝাং ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর অর্থাৎ লির ঘটনার তিনদিন আগে একই পরিবারের তিন সদস্যের দেহে এক অজানা প্রকৃতির ভাইরাল নিউমোনিয়ার খোঁজ পান এবং তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে এই বিষয়ে রিপোর্ট করেন।
পরবর্তীতে তার সেই রিপোর্ট ২৯ ডিসেম্বর উহান হেলথ কমিশনের নজরে পড়ে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুতই এই বিষয়ে সাড়া দেয়। পরদিন অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর উহান হেলথ কমিশন তাদের আওতাভুক্ত সকল মেডিকেল ইন্সটিটিউটকে এক অজানা প্রকৃতির নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাবের কথা উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে মহামারির সম্ভাবনা সরেজমিনে তদন্তের জন্য প্রেরণ করে। অনুসন্ধানী দলটি পরদিন ৩১ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থল উহানে পৌঁছায়। উহান হেলথ কমিশন তখন এই অজানা উৎসের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ২৭ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়। তবে সেখানে ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীদের এই রোগে সংক্রমিত হবার কোনো সম্ভাবনার কথা উল্লেখ ছিল না। রোগীর সংখ্যা কম থাকায় তারা হয়তো তেমন কোনো ঘটনা তখনও খুঁজে পাননি। কিন্তু এই একটি ভুলই পরে মহামারী সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সকল নিয়মকানুন এবং প্রোটোকল অনুসরণ করে ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বিষয়টি অবহিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উহান শহরে শনাক্ত হওয়া অজানা কারণে সৃষ্ট নিউমোনিয়া সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি সেই দিনেই হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করে। তারা কোনো রকম কালক্ষেপণ না করে ঐদিনই বিশ্বব্যাপী সতর্কবার্তা প্রেরণ করে। তাহলে দেখা গেল, ঝাংয়ের সেই প্রাথমিক প্রতিবেদন আমলে নেয়ার মাত্র দুদিন পরেই পুরো পৃথিবীজুড়ে মহামারীর জন্য সতর্কতার উল্লেখ করা হয়।
এবার আসা যাক লির প্রসঙ্গে। চক্ষু বিশেষজ্ঞ হওয়ায় শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ শনাক্তকরণ সম্পর্কে তার তেমন জানা-শোনা ছিল না। সম্ভবত তিনি এবং আরও কয়েকজন ডাক্তার ৩০ ডিসেম্বর উহান হেলথ কমিশন থেকে প্রকাশিত সেই জরুরি নোটিশটি কোথাও দেখেন। স্বভাবতই বিষয়টি তার মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। তাই অসাবধানতাবশত সম্ভাব্য এই মহামারীর বিষয়ে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিংয়ের সময় তাদের সাবধানে ও নিরাপদে থাকার অনুরোধ করেন। এর পর থেকেই আসলে সকল বিতর্কের জন্ম।
উইচ্যাটে স্ক্রিনশট ভাইরাল হওয়ার পর লি বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি ধরেই নেন তার জন্য ভবিষ্যতে অনেক খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে। তার সেই অনুমানই সত্য হয়। মেসেজ পাঠানোর পরদিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর সকালে মহামারী সম্পর্কে উহানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের এক জরুরি বৈঠকে বসে। মিটিং শেষে কর্মকর্তারা লি-কে তার হাসপাতালে ডেকে পাঠায়। সেখানেই তাকে জেরা করা শুরু হয়। তিনি কীভাবে এই রোগ সম্পর্কে জানলেন তার পুরো ব্যাখ্যা দেয়ার কথা বলা হয়।
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বেইজিং ইয়ুথ ডেইলিতে সেই খবর প্রকাশিত হয়। এরপর নতুন বছরের প্রথম দিনেই অর্থাৎ ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি তাকে স্থানীয় একটি পুলিশ স্টেশনে আনা হয়। সেখানে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হন। ৩ জানুয়ারি তিনি পুলিশের একটি সতর্কতামূলক পত্রে স্বাক্ষর করেন। সেই পত্রে তার ভুয়া মন্তব্যের স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এমন বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতির কথাও পত্রে বলা ছিল। লি ভেবেছিলেন, তাকে হয়তো আটক করা হবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পত্রে উল্লেখিত জবানবন্দীতে সই করার এক ঘণ্টা পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে লি-কে ছেড়ে দিলেও নভেল করোনাভাইরাসের কথা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চীনা প্রশাসন ইন্টারনেটে ব্যাপক নজরদারি শুরু করে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন তথ্য লুকাতে শুরু করে। তাদের তালিকায় থাকা সোশ্যাল মিডিয়ার মাঝে অন্যতম ছিল ‘উইচ্যাট’ এবং জনপ্রিয় লাইভ স্ট্রিমিং সাইট ‘ওয়াই ওয়াই’।
৩১ ডিসেম্বর ওয়াই ওয়াই প্ল্যাটফর্মের ৪৫টি সার্চিং কীওয়ার্ডকে ব্ল্যাক্ললিস্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অধিকাংশই ছিল উহানের অজানা ভাইরাস সম্পর্কিত। এদের মাঝে ‘Unknown Wuhan pneumonia’ এবং ‘SARS outbreak in Wuhan’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে ১-৩১ জানুয়ারির মাঝে উইচ্যাটের ১৩২টি কীওয়ার্ড ব্লক করা হয়। মহামারী অব্যাহত থাকায় পরবর্তীতে ১-১৫ ফেব্রুয়ারির মাঝে নতুন আরও ৩৮৪টি সার্চিং কীওয়ার্ডকে সেন্সর করা হয়। এই কীওয়ার্ডগুলোর বেশিরভাগই ছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মহামারী মোকাবেলায় তার প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। এছাড়াও হংকং, তাইওয়ান এবং ম্যাকাউতে অজানা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্যই নেট ঘেঁটে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেন্সর করা কীওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ‘Local authorities + Epidemic + Central (government) + Cover up’ এবং ‘Wuhan + Obviously + Virus + Human-to-human transmission’ ছিল অন্যতম। শুধু তা-ই নয়, ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং সম্পর্কিত ১৯টি কীওয়ার্ডকেও ব্লক করা হয়।
অপরদিকে লি আবার হাসপাতালে কাজে যোগ দেন। বিগত কয়েকদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি সর্বদা অসহায় অনুভব করতে শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১০ জানুয়ারি হাসপাতালে নিজের অজান্তে উহানের সেই অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত এক রোগীর চিকিৎসার পর তিনি কাশতে শুরু করেন। পরদিন শরীরে জ্বর আসে। ১২ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে লির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাই তাকে আইসিইউতে ভর্তি করে অক্সিজেন সাপোর্টে রাখা হয়।
ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে জানা যায় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। করোনার সাথে লড়াই করে অবশেষে ৬ ফেব্রুয়ারি লি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান। ঠিক একই দিনে ঝাং জিজ্যানকে নতুন করোনাভাইরাসের প্রকৃত হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করা হয়। এজন্যই বুঝি বলে- কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। তবে বেঁচে থাকা অবস্থায় লি তেমন কিছু করতে না পারলেও তার মৃত্যুর ফলে পুরো পরিস্থিতি এক নতুন দিকে মোড় নেয়।
মহামারির শুরু থেকেই চীন এর তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তাদের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোনো কথা, এমনকি সেটা সত্য হলেও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। চাইনিজ টুইটার খ্যাত ওয়েইবোতে গুজব রটনাকারীদের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতির বিষয়ে পুলিশের একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। পুলিশ বিভাগের সেই ঘোষণা চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন বা সিসিটিভিতে প্রচারিত হয়। এর মাধ্যমে কোনো ধরনের স্পর্শকাতর ও ভুয়া তথ্য প্রচারকারীদের প্রতি চীনা প্রশাসনের শক্ত মনোভাব ফুটে ওঠে।
মহামারী শনাক্ত হওয়ার পর দুই সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র উহান মিউনিসিপ্যাল হেলথ কমিশন থেকেই যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা হত। ৭ই জানুয়ারি চীনের বিজ্ঞানীরা রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর এই ভাইরাস বা প্যাথোজেনকে নতুন করোনাভাইরাস বলে ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পরের এক সপ্তাহে নতুন কোনো রোগী শনাক্তের খবর প্রকাশ হয়নি। তাই স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অনেকটা আশাবাদী হয়ে বলেন, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনো প্রমাণ নেই। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদের মাঝেও আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঘটনা ছিল না। তাই তারা মনে করেন, এই মহামারী হয়তো প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিষয়টি লি-কে অনেক আগেই ভাবিয়ে তুলেছিল। ৩১ জানুয়ারি ওয়েইবোতে এক পোস্টে তিনি ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত না হওয়ার আনুষ্ঠানিক নোটিশের সমালোচনা করেন।
১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল। সেদিন পর্যন্ত উহান কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪১ জন রোগীর কেস রেকর্ড করে। কিন্তু তারপরেই পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। ২০ জানুয়ারিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৮ জনে। তখন কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসে। সেদিনই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং করোনার বিস্তার রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন। সেই সাথে নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রাপ্ত যেকোনো তথ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকাশ করার কথা বলেন। মহামারী নিয়ে শি জিনপিংয়ের এটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক বার্তা।
ঐদিন সন্ধ্যায় সরকারের নিয়োজিত শ্বাসতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ ও ১৭ বছর পূর্বের সার্স মহামারির সম্মুখযোদ্ধা ঝং নানশান চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভিতে নতুন করোনাভাইরাসের মানুষ থেকে মানুষে বিস্তার এবং সংক্রমণের কথা স্বীকার করেন। এই ঘটনার তিন দিন পরে উহান শহরকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবরুদ্ধ বা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ততদিনে বেশ দেরি হয়ে যায়। কারণ ২৫ জানুয়ারি চীনের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের ছুটি থাকায় সেদিনটি উদযাপনের লক্ষ্যে আগেভাগেই উহানের পাঁচ মিলিয়ন অধিবাসী শহর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। ফলে জিঞ্জিয়াংয়ের সুদূর পশ্চিম সীমান্ত এমনকি তিব্বতের দূরবর্তী অঞ্চলসহ দেশের মোটামুটি সকল প্রান্তেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ জানুয়ারি সিসিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উহানের মেয়র ঝৌ জিয়াংওয়াং করোনাভাইরাসের তথ্যসমূহ সঠিক সময়ে প্রকাশে তার সরকারের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন।
ঠিক তখনই চীনের বেসামরিক জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা মনে করে, লি যখন করোনার কথা বলেছিল, তখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিলে ভাইরাসের এতটা বিস্তার ঘটত না। পুলিশ লি-সহ আটজনকে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অপরাধে জেরা করে। এমনকি তাদের সাথে দুর্ব্যবহারও করেছিল। সেই খবর চাউর হওয়ায় এবং প্রেসিডেন্টের সংবাদ পরিবেশনায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ফলে চীনা সাংবাদিকেরা গভীর অনুসন্ধান শুরু করে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন পত্রিকা বেইজিং ইয়ুথ ডেইলি তখন লি ওয়েনলিয়াংয়ের একটি সাক্ষাৎকার নেয় এবং তা পত্রিকায় ছাপে। মুহূর্তের মাঝেই সেই আর্টিকেল ভাইরাল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে আর্টিকেলটি স্পর্শকাতর হিসেবে সেন্সর করা হয়। কিন্তু গণঅসন্তোষ বাড়তেই থাকে।
লির মৃত্যুতে চীনের সাধারণ মানুষ অনেক শোকাহত হয়। সেই শোককেই তারা শক্তিতে পরিণত করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নজরদারির বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। তখন পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত মানুষদের মনেও সাহসের সঞ্চার হয়। ১০ মার্চ পিপলস ডেইলিতে জি লিংকা নামক আরও একজন করোনার তথ্য ফাসকারী ডাক্তারের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। উহান ইউনিয়ন হসপিটালে কর্মরত এই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডিসেম্বরের শেষের দিকে সার্স সদৃশ এক অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সহকর্মী চিকিৎসকদের সতর্ক করেছিলেন। তথ্যটি গোপন না রাখার কারণে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে গালিগালাজ করে বলে তিনি আর্টিকেলে উল্লেখ করেন।
যথারীতি এই আর্টিকেলটিও ভাইরাল হয় এবং এটিও চীন প্রশাসন ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলে। তবে মুছে ফেলার কিছু সময় পর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহারকারীরা এবার ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। আর্টিকেল পড়া মানুষজন এটি পুনরায় এমনভাবে লেখার চেষ্টা করে যেন ইন্টারনেট থেকে সেটা হারিয়ে না যায়। তারা সেই আর্টিকেলটিকে ১০টি ভাষায় অনুবাদ করে। অনেকে আবার শব্দগুলোকে মোর্স কোডে রুপান্তর করে। কেউ আবার প্রাচীন চীনা লিপিতে আর্টিকেলটি লেখেন। অনেকে পুরো আর্টিকেলটিকে স্ক্যানযোগ্য কিউআর কোডে পরিণত করে। সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। আর তা হলো মানুষের বাকস্বাধীনতা যেন কেউ হরণ করতে না পারে।
এমনকি লির মৃত্যু নিয়েও তথ্য ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। লি মারা যাবার পর তার মৃত্যু সংবাদ সার্চকারীর সংখ্যা মাত্র ১৫ মিনিটের (রাত ১১টা ১৬ থেকে ১১টা ৩০ এর মাঝে) ব্যবধানে ২০ মিলিয়ন থেকে ২ মিলিয়ন হয়ে যায়। হংকং ভিত্তিক আউটলেট দ্য ইনিটিয়ামের বিবৃতি অনুযায়ী এই কয়েক মিনিটের মাঝেই বহুল আলোচিত #DrLiWenLiangDied বিষয়বস্তুটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রেন্ডলিস্টের তিন থেকে আকস্মিকভাবে সাতে নেমে যায়। এই ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনি।
প্রবল জনরোষের মাঝে চীনা প্রশাসনও পিছু হটতে শুরু করে। চীনের সুপ্রিম কোর্ট ২৮ জানুয়ারি তথাকথিত গুজব রটনাকারীদের সাথে পুলিশের দুর্ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করে। ফলে জোরপূর্বক লির স্বাক্ষর করা সেই স্বীকারোক্তিমূলক পত্রটিও প্রত্যাহার করা হয়। চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার তথ্যানুসারে লির সাথে এমন খারাপ আচরণের জন্য পুলিশ তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চায়। এমনকি তারা ক্ষতিপূরণ প্রদানেরও প্রস্তাব জানায়।
মূলত লি ওয়েনলিয়াংয়ের তথ্য ফাঁস, লাঞ্ছনা এবং মৃত্যুই চীনকে বিতর্কিত করে তোলে। আর সেই সুযোগটাই নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রেস ব্রিফিং সবখানেই করোনার তথ্য গোপনের জন্য চীনকেই দায়ী করছেন। সম্প্রতি উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজির ল্যাবে বাদুড় সৃষ্ট তিন প্রজাতির জীবন্ত করোনাভাইরাসের খবর প্রকাশিত হওয়ায় তার অভিযোগের পালে হাওয়া লাগে। ইন্সটিটিউটের পরিচালক উয়াং ইয়ানইয়েই তিন প্রজাতির করোনার সাথে কোভিড-১৯ এর সর্বোচ্চ ৭৯.৮ শতাংশ মিল রয়েছে বলে জানান। সেই সাথে নতুন ভাইরাসটি তাদের ল্যাবে তৈরি হয়নি বলেও দাবি করেন।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটা মানতে নারাজ। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীনের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বরাবরই বলে আসছে কোভিড-১৯ কোনো ল্যাবে নয় বরং প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া ভাইরাস। যেটি বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ এবং বিস্তার করেছে। কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নেয়ায় ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীনকেন্দ্রিক বলেও সমালোচনা করেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতে অর্থায়ন বন্ধ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ১৯ মে তিনি ডব্লিউএইচওর সাধারণ পরিচালক তেদরোস আধানোমকে চার পাতার একটি চিঠি লিখে পাঠান। অবশেষে ২৯ মে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সকল কর্মকাণ্ড থেকে আমেরিকার সরে আসার ঘোষণা দেন।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে বোঝা গেল, চীনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর সম্ভাবনা সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করা। সম্ভবত প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করাতেই এই সিদ্ধান্তগত ত্রুটি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রও সেই ভুল পথেই অগ্রসর হয়। টেস্টের স্বল্পতা এবং সকল সংক্রমিত ব্যক্তি সনাক্ত না হওয়ায় তাদেরকে আজ সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ঠিক এখানেই মাঠে মারা যায়। আমরা সবাই জানি, কোভিড-১৯ হলো একটি নভেল বা নতুন প্রজাতির করোনাভাইরাস। এর সম্পর্কে আগে কেউ কিছুই জানত না। সাধারণ মানুষের মতোই মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় চীনা কর্মকর্তারাও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই তারা এই রোগটির সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তবে তাদের ধারণা ছিল এই রোগটি ততটা ছোঁয়াচে বা তেমন ভয়াবহ নয়। তাই তারা চীনা নববর্ষের প্রাক্কালে উহানের নাগরিকদের স্ট্রিট পার্টি এবং শহরের বাইরে অবকাশ যাপনে বাধা দেয়নি। কিন্তু চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নভেল করোনাভাইরাসকে অত্যাধিক মাত্রায় ছোঁয়াচে রোগ ঘোষণার পরপরই ২৩ জানুয়ারি,২০২০-এ উহান নগরকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন যতই অস্বীকার করুক, চীন তাদের কাছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য গোপন করেনি। জানুয়ারির ৩ তারিখে অর্থাৎ ঝাংয়ের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর পরিচালক আমেরিকার সিডিসির পরিচালককে বিষয়টি অবহিত করেন। নববর্ষের ছুটির সময়ে তাদের মাঝে কথোপকথনে ছেদ পড়লেও দুই দেশের পাবলিক হেলথ কর্মকর্তাদের যোগাযোগ অব্যহত ছিল। এমনকি ভাইরাসটির সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পশ্চিমা বিশ্বের দাবি করা সময়ের অনেক আগেই একে মহামারি হিসেবে নিশ্চিত করেছিল।
করোনার বিস্তার রোধে আমেরিকার নীতিগত সিদ্ধান্তও বেশ আত্মঘাতী এবং বিতর্কিত ছিল। ঝাংয়ের রিপোর্ট পাওয়ার ২৭ দিন পর ২৩ জানুয়ারি উহান লকডাউন করা হয়। অন্যদিকে আমেরিকাতে প্রথম করোনারোগী ধরা পড়ে জানুয়ারির ২০ তারিখে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের দ্বিগুণ সময় অর্থাৎ ৫৪ দিন পর ১৩ মার্চ জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এমনকি লির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং চীনবিরোধী মনোভাবকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি রিপাবলিকান পার্টির ৫৭ পৃষ্ঠার নির্বাচনী প্রচারণা কৌশলের ডকুমেন্ট ফাঁস হয়ে যায়। ডকুমেন্টটি তথাকথিত লির অনেক নকল বা বিকৃত অ্যাকাউন্টে হুমকির তথ্য দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কোথাও ঝাংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচনী প্রচারণার স্বার্থে তাই উহানের ল্যাবে কোভিড-১৯ সৃষ্টির পোক্ত কোনো প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই আশাতেও গুঁড়েবালি। কারণ আমেরিকার নিজস্ব স্বাস্থ্য কর্মকর্তা,পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সোর্স, শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীগণ, এমনকি তাদের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রবাদপুরুষ অ্যান্থনি ফাউসিও সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। তাই উহানের ল্যাব থেকে করোনার উৎপত্তি ও লির তথ্য প্রকাশ এবং তার মৃত্যু- দুই ঘটনার প্রভাবই ট্রাম্পের কাছে সমান। কোনোটিই তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফলে তেমন কাজে লাগল না। কারণ কোভিড-১৯ মহামারির তথ্য নিয়ে চীন নিজের দেশের নাগরিকদের সাথে গড়িমসি করলেও বিশ্ববাসীর সাথে প্রতারণার কোনো সুস্পষ্ট নিদর্শন নেই। তাই এখন হালে পানি না পেয়ে এবং নিজের পিঠ বাঁচাতে করোনার দাপট যতই বাড়ে, ততই ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন চীনকে অহেতুক দায়ী করে ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেন।