আর্কটিক মহাসাগর: বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যখন রাশিয়ার জন্য সুফল বয়ে আনে

শিরোনাম পড়ে অনেকে হয়তো ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন। শিরোনাম কি ঠিকভাবে পড়েছি? নাকি লেখক পাগল হয়ে গেছেন? কারণ, আমরা এতদিন দেখে আসছি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কীভাবে পৃথিবীবাসী, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করেছে। তাছাড়া, ভবিষ্যতে এজন্য আমরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি তা-ও আর অজানা নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ভবিষ্যতে আর্কটিকের বরফ পুরোপুরি গলে গেলে এর সুফল ভোগ করবে আর্কটিক ঘিরে থাকা দেশগুলো। তবে, সবচেয়ে বেশি সুফল ভোগ করতে পারে আর্কটিকের তীরে থাকা সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া।

Image Source: World Meteorological Organization

১,৫৫,৫৮,০০০ বর্গ কিলোমিটারের আর্কটিকের উপকূল রেখা হচ্ছে ৪৫,৩৯০ কি. মি., যার প্রায় ৫৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৪,১৪০ কিলোমিটার উপকূল রেখা হচ্ছে রাশিয়ার এলাকা, বাকি ৪৭ শতাংশ উপকূল এলাকা আর্কটিকের অন্য সাত দেশের মধ্যে বিস্তৃত। সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন (UNCLOS) অনুসারে, কোনো দেশের উপকূল রেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতর সকল ধরনের সম্পদের উপর থাকবে ঐ দেশের একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই হিসেবে আর্কটিকের বেশিরভাগ অংশের মালিকানা রাশিয়ার। যদিও UNCLOS এর অন্য একটি ধারা নিয়ে রাশিয়ার সাথে আর্কটিকের বাকি দেশগুলো, বিশেষ করে নরওয়ে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং কানাডার বিরোধ চলে আসছে।

ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের The Henry M. Jackson School Of International Studies তাদের একটি নিবন্ধে রাশিয়ার আর্কটিকে তাদের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বর্ধিত’ করার দাবির বিষয়ে লিখেছে, “রাশিয়ান ফেডারেশনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বর্ধিত করার দাবি বৈধ এবং তাদের এই দাবি মেনে নেওয়া উচিত।” তাদের দাবি যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে আর্কটিকের বেশিরভাগ তেল ও গ্যাস সম্পদের মালিকানা পাবে রাশিয়া।

বেশিরভাগ তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের অবস্থান রাশিয়ার বর্তমান এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এবং তাদের নতুন দাবি করা সীমানায়; Image Source: Siberian Times

বর্তমানে রাশিয়ার মোট জিডিপির ১২-১৫ শতাংশ আসে আর্কটিক ঘিরে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তাদের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ, যার ৮০ শতাংশ গ্যাস, ১৭ শতাংশ তেল ও ৩ শতাংশ মাছ ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ, আর্কটিক থেকেই হয়। আর্কটিকের বুকে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অনাবিষ্কৃত তেল ও গ্যাসের মজুত, আরো রয়েছে মূল্যবান খনিজ ধাতু, যেমন- নিকেল, প্লাটিনাম, প্যালাডিয়াম এবং বিরল মৃত্তিকা ধাতুর বিশাল ভান্ডার, যার অধিকাংশই অবস্থিত আর্কটিকের উত্তরে থাকা দেশগুলোর সীমানায়। আর্কটিকে রয়েছে পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত তেলের ভাণ্ডারের ১৬ ভাগ, যা পৃথিবীর জ্ঞাত তেল ভান্ডারের ৬ শতাংশ এবং রাশিয়ার আবিষ্কৃত তেল সম্পদের ১১০ শতাংশ। রয়েছে পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুতের ৩০ শতাংশ, যেটি পৃথিবীর আবিষ্কৃত গ্যাস মজুতের প্রায় ২৪ শতাংশ, এবং তা রাশিয়ার জানা গ্যাস মজুতের ৯০ শতাংশ। আরো রয়েছে প্রচুর মৎস্য সম্পদ। এর বেশিরভাগই রয়েছে রাশিয়ার দাবি করা সীমানায়।

Image Source: The Arctic Institute

বিজ্ঞানীদের হিসেবমতে, ২০৩৫ সালের মধ্যে আর্কটিকের গ্রীষ্মকালীন বরফ পুরোপুরি গলে যেতে পারে। সেটি হলে আর্কটিকের বুকে লুকিয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ আর্কটিকের তীরবর্তী দেশগুলোর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

নর্দান সী রুটই কি ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের প্রধান রুট হতে যাচ্ছে?

আর্কটিক অঞ্চলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় তিনগুণ, যেখানে বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন বরফ গত হাজার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, হয়তো আগামী এক-দেড় যুগের মধ্যে আর্কটিকের গ্রীষ্মকালীন বরফ পুরোপুরি গলে যেতে পারে। এর সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব পড়বে ইউরোপ থেকে আর্কটিক হয়ে নর্দান সী রুটের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যকার সংযোগের মাধ্যমে।

সুয়েজ খালকেন্দ্রিক রুট এবং নর্দান সী রুটের মধ্যে তুলনা; Image Source: Enterpris.press

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নেদারল্যান্ডসের রোটারডাম থেকে চীনের সাংহাই পর্যন্ত পৌঁছাতে একটি জাহাজকে আফ্রিকা ঘুরে ২৬,০০০ কি. মি পথ পাড়ি দিতে হতো। এরপর ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল উন্মুক্ত হওয়ার পর এই পথ ২৩% সংকুচিত হয়ে যায় এবং নর্দান সী রুট পুরোপুরি চালু হলে এই পথ আরো ২৪ শতাংশ ছোট হয়ে আসবে। সময় কমবে ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২ সপ্তাহ, সাশ্রয় হবে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি। দেখতেই পাচ্ছেন যে তা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত লাভজনক। তাই নিকট ভবিষ্যতে নর্দান সী রুটই হতে পারে ইউরোপ থেকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রধান পথ।

Image Source: Research Gate

বর্তমানে নর্দান সী রুট বছরে ছয় মাস জাহাজ চলাচলের উপযোগী থাকে। রাশিয়া ২০২৫ সালের মধ্যে এই পথ বছরব্যাপী জাহাজ চলাচল উপযোগী করার জন্য তাদের বরফ বিধ্বংসী জাহাজের বহরকে বড় করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বর্তমানে তাদের বহরে প্রায় ৭টি পারমাণবিক শক্তিচালিত এবং ৩০টি ডিজেলচালিত আইস ব্রেকার জাহাজ রয়েছে, এবং আরো কয়েকটি বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

বরফ ভেঙে জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি করছে আইস ব্রেকার; Image Source: Polar Journal

এই রুট এবং আর্কটিক অঞ্চলে থাকা সম্পদ ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার রপ্তানি এশিয়া প্যাসিফিকের দিকে ঘুরিয়ে দিতে বিশেষ সাহায্য করবে, যেহেতু তাদের প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী ইউরোপ, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে।

আর্কটিকে বরফ ভেঙে জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি করছে রাশিয়ান আইস ব্রেকার; Image Source: The Barents Observer

সর্বোপরি, আর্কটিকে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেখানে লুকিয়ে থাকা সম্পদ এবং তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জাহাজ চলাচল রুট কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উদ্ভুত নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে রাশিয়া।

This article is in Bengali language about the positive effects in economy in the region of Arctic due to global warming.

References:
1. What is behind Russia’s interest in a warming Arctic? - Al Jazeera
2. Russia and the future of Arctic - ORF
3. Examining the Russian Federations claim to extend their Exclusive Economic Zone within the Arctic - University of Washington

Related Articles

Exit mobile version