মনে করুন, আপনার চোখের সামনেই কেউ একটি ভয়াবহ অপরাধ করে ফেলল। লোকটিকে আপনি চেনেন না, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড দেখে আপনি ভয়াবহ আক্রোশে ফেটে পড়লেন। সেক্ষেত্রে আপনার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হবে? আপনি প্রতিবাদ করবেন, কিংবা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবেন।
কিন্তু একটিবার ভেবে দেখুন তো, অপরাধী ব্যক্তিটি যদি আপনার পরিচিত কেউ হয়? এমন কেউ, যার সাথে আপনার খুবই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে? হতে পারে লোকটি আপনার বাবা, ভাই, কিংবা আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধ। তারপরও কি আপনি তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবেন?
গণমাধ্যমে যখন আপনি এ ধরনের সংবাদ দেখেন যে একজন ব্যক্তি খুব বড় কোনো অপরাধ করার পরও তার কাছের মানুষেরা তাকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে, যেকোনো উপায়ে তাকে আইনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তখন নিঃসন্দেহে আপনার প্রচণ্ড রাগ হয়। কিন্তু সেই আপনিই হয়তো আপনার পরিচিত কোনো ব্যক্তির অপরাধ ঢাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, নিশ্চিত করতে চাইবেন তাকে যেন বড় কোনো শাস্তি পেতে না হয়।
পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি বুলেটিনে প্রকাশিত নতুন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই বিস্ময়কর কিন্তু বাস্তব সত্য।
গবেষণা প্রবন্ধটির প্রধান রচয়িতা ইউনিভার্সিটি অভ মিশিগানের আরন ওয়াইডম্যান। তিনি ও তার সহকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে মোট দশটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। তারা মূলত জানার চেষ্টা করেছেন যে মানুষের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, যখন তারা জানতে পারবে যে তাদের খুব কাছের কোনো মানুষ একটি অপরাধ করে ফেলেছে।
প্রথম গবেষণায় গবেষণা দলটি প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর কাছে তাদের নয়জন পরিচিত মানুষের নাম জানতে চায়। এই নয়জনের মধ্যে থাকবে কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীর মতো অপেক্ষাকৃত দূরের কেউ, আবার রোমান্টিক সঙ্গীর মতো খুব কাছের কেউও।
এরপর অংশগ্রহণকারীদের কল্পনা করতে বলা হয় যে তারা তাদের কোনো কাছের মানুষকে একটি অপরাধ করতে দেখেছে। অপরাধটি হতে পারে অনলাইনে অবৈধভাবে গান ডাউনলোডের মতো ছোট কিছু থেকে শুরু করে ডাকাতির মতো মস্ত বড় কোনো অপরাধ। এরপর তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, যদি কোনো পুলিশ অফিসার তাদের কাছে আসে তদন্ত করতে, তারা কি সত্যি কথাটি বলে দেবে, নাকি মিথ্যা বলবে যে তারা কিছুই জানে না?
অংশগ্রহণকারীদের জবাব থেকে জানা যায়, খুব দূরের কোনো পরিচিত ব্যক্তি হলে তারা পুলিশ অফিসারের কাছে সত্যি কথাই বলবে। কিন্তু অপরাধী ব্যক্তিটি যতই তাদের ঘনিষ্ঠ কেউ হবে, তাদের মিথ্যা বলার প্রবণতাও বাড়তে থাকবে। এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই মিথ্যার আশ্রয় নেবে।
এবং আরো দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, অপরাধের মাত্রাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যদি অপরাধটি সামান্য কিছু হয়, তাহলে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত সত্যি কথাই বলবে। কারণ তারা জানে, অপরাধীকে খুব বড় কোনো শাস্তি পেতে হবে না। কিন্তু অপরাধের মাত্রা যত বাড়তে থাকবে, অর্থাৎ সম্ভাব্য শাস্তির পরিমাণ বাড়বে, তাদের মিথ্যা বলার প্রবণতাও বাড়বে।
গবেষক দলটি শুধু এটুকু তথ্যেই সন্তুষ্ট থাকেনি। পরবর্তীতে তারা একই বিষয়ে আরো নয়টি গবেষণা চালিয়েছে, এবং প্রতিটি গবেষণায়ই কিছুটা বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আনয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন আঙ্গিকে গোটা বিষয়টিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে।
উদাহরণস্বরূপ একটি বিশেষ দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করা যায়, যেটি যে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলে দেবে। অংশগ্রহণকারীদের উত্তর থেকে জানা যায়, তাদের কাছের মানুষটি যদি যৌন নিপীড়নের মতো কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে বাঁচানোর বেশি চেষ্টা করবে তারা। এবং এক্ষেত্রেও অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে মিথ্যার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। যদি অপরাধটি কেবল ইভ টিজিং বা কাউকে দেখে শিস দেয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে হয়তো অংশগ্রহণকারীরা সত্যি কথা বলতেও পারে, কিন্তু সরাসরি ধর্ষণের মতো ঘটনায় তাদের মিথ্যা বলার সম্ভাবনাই বেশি।
কাছের মানুষটির সাথে ব্যক্তিগত পার্থক্য অবশ্য এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ অপরাধী ব্যক্তির সাথে যদি অংশগ্রহণকারীদের লিঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা মূল্যবোধের ফারাক থাকে, তারপরও সেগুলো অপরাধীকে বাঁচানো বা না বাঁচানোর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাবক রূপে আবির্ভূত হবে না।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন ধরনের মানসিকতা থেকে অংশগ্রহণকারীরা এ কাজ করবে? তাদের কাছ থেকে যে প্রত্যুত্তর পাওয়া গেছে, তা বেশ চমকপ্রদ। তারা বিশ্বাস করে, তারা যা করছে তা একাধারে যেমন নিজেদের স্বার্থে, তেমনই সমাজের ভালোর জন্যও। দূরের কাউকে না বাঁচিয়ে সত্যি কথা বলাকেই তারা প্রাধান্য দেবে, কারণ তারা মনে করে এতে সমাজের উপকার হবে। অথচ কাছের মানুষের ক্ষেত্রে তারা মিথ্যা কথা বলবে। কারণ তারা মনে করে, কাছের মানুষটির তো সময়ের সাথে পরিবর্তনও হতে পারে, তাই তাদেরকে আরেকটি সুযোগ দেয়া উচিৎ।
কাছের মানুষটি বদলে যাবে, তাই তাদের বাঁচানোই শ্রেয়, তাদেরকে আরেকটি সুযোগ দেয়া উচিৎ, এসব তো বোঝা গেল। কিন্তু কাছের মানুষটির কাজও যে নৈতিকতার লঙ্ঘন এবং নিন্দনীয় কাজ, সেটি কি অংশগ্রহণকারীরা মানে? হ্যাঁ, সেটি তারা মানে। তারা অবশ্যই বিশ্বাস করে যে অপরাধটি তাদের কাছের কেউই করুক কিংবা দূরের কেউ, তাতে অন্যায় কখনো ন্যায় হয়ে যায় না।
এরপরও কেন তারা দূরের মানুষটিকে আইনের আওতায় আনতে সাহায্য করলেও, কাছের মানুষটির ক্ষেত্রে তা করবে না? এর পেছনের যুক্তিকে অংশগ্রহণকারীরা এভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে যে, তারা নিজেরাই কাছের মানুষটির মুখোমুখি হবে, তাকে শাস্তি দেবে, এবং তাকে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে।
তবে গবেষকরা সকল অংশগ্রহণকারীর বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুটি বিষয় অনুমান করেছেন। তাদের মতে, কাছের মানুষকে বাঁচানো এবং পরে নিজেরা তাদের মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা, (ক) একজন নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে চায়, (খ) কাছের মানুষটির সাথে নিজেদের সম্পর্ক অটুট রাখতে, ক্ষেত্রবিশেষে আরো মজবুত করতে চায়।
গবেষণায় প্রকাশিত এই তথ্যগুলো থেকে এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন প্রায়ই আমরা বিভিন্ন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিত্বের অপরাধের কথা শুনি, যা তাদের কাছের মানুষ ও পরিবার মিথ্যা বলে বা নীরবতার মাধ্যমে ঢাকার চেষ্টা করে। আরো চরম সত্য হলো, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী যারা দাবি করেছে যে তারা কাছের মানুষদের অপরাধও বরদাস্ত করবে না, বাস্তব পরিস্থিতিতে তাদের একটি বড় অংশও ঠিকই নিজেদের কাছের মানুষদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে। কারণ সাধারণ প্রশ্নোত্তরে নিজেকে সৎ ও সত্যবাদী হিসেবে জাহির করা গেলেও, বাস্তব পরিস্থিতিতে, বিশেষত যখন সামনে বিশাল বিপদের খড়্গ ঝুলছে, তখন নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখা খুবই কঠিন কাজ।
তাই এতক্ষণ এই লেখাটি পড়ে যদি আপনি মনে করেন, আপনিও ওই অংশগ্রহণকারীদের মতো নন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আপনি আপনার নৈতিকতা অক্ষুণ্ন রাখবেন, সেটিকে শতভাগ বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। এখন আপনি কী ভাবছেন বা বলছেন, তাতে আসলে কিছুই যায় আসে না। বাস্তবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে আপনি সত্যের রাস্তা বেছে নেবেন, নাকি গুরুত্ব দেবেন সম্পর্ককে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা টানতে পারি ভারতে বেশ কয়েকটি ভাষায় নির্মিত ও সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র দৃশ্যমের কথা। সেখানেও মুখ্য চরিত্র সত্য ও সম্পর্কের মধ্যকার দোটানায় পড়েছিল, এবং বেছে নিয়েছিল দ্বিতীয়টিকেই। নিজের সিদ্ধান্তের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিল,
“আমি অনেকবার ক্ষমা প্রার্থনার চেষ্টা করেছি। মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিও। এর বেশি আমি আর কী-ই বা করতে পারতাম? আমার কাছে আমার পরিবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাদের জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। যেকোনো রাস্তা বেছে নিতে পারি। ওই মুহূর্তে আমার কাছে কোনোকিছুই ঠিক বা ভুল বলে মনে হয় না।”
যা-ই হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য কখনোই সত্যের পরিবর্তে সম্পর্ককে বেছে নেয়ায় উৎসাহ প্রদান করা নয়। গবেষকরাও তা চাননি। বরং তারা বোঝার চেষ্টা করেছেন, কখনো কি এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তরও তারা পেয়েছেন। তারা আবিষ্কার করেছেন, মানুষের মন থেকে অপরাধীকে বাঁচানোর প্রবণতা দূর করা সম্ভব, যদি তারা অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখে, অপরাধীর সাথে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিকে আমলে না আনে, এবং তৃতীয় পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধী ও তার অপরাধকে বিচার করে।
কাজটি যে কখনোই সহজ নয়, সে কথা অনস্বীকার্য। দূরের কেউ বিপদে পড়লে সেটিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যেতে পারে। কিন্তু কাছের মানুষ বিপদে পড়লে, কিংবা বিপদে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলে, তখনো নিজের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সহজ কাজ নয়। সেরকম প্রবল মানসিক শক্তিও খুব কম মানুষেরই রয়েছে।
এরপরও আমাদের আশা থাকবে, স্রষ্টা যেন আমাদের সবাইকেই সেই মানসিক শক্তি দান করেন, যাতে আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি। অন্যায়কারী আমাদের যত কাছের মানুষই হোক না কেন, তা যেন আমাদের বিচারবোধকে প্রভাবিত করতে না পারে। কেননা,
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”
অপরাধ বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১. অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি
২. প্রশ্নোত্তরে অপরাধ বিজ্ঞান
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/