মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের রাজধানী মাস্কটের ব্যস্ততম বাজার মুতরাহ সুউক। বাজারের দোকানগুলো থেকে সর্বদা সুগন্ধির মৌ মৌ ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ সেখানে সুগন্ধি ক্রয়ের জন্য আসছেন। বিষয়টি ওমানের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। যেন লোভনীয় কস্তূরীর সন্ধানে সেখানে আজও অসংখ্য মানুষ দলে দলে ছুটে আসছেন।
বাজারটিতে মূলত বিভিন্ন শৌখিন পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় সংগঠিত হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের রকমারি গহনার পাশাপাশি সেখানে রয়েছে বিশ্বের নামীদামী ব্র্যান্ডের পাথর ও বাহারি সুগন্ধির সমাহার। এর মধ্যে সবচেয়ে দামী সুগন্ধির নাম ‘লোবান’। এমনকি এই লোবান স্বর্ণের চেয়েও দামী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও লোবান কোনো ধাতব পদার্থ কিংবা পাথর নয়; বরং এক বিশেষ বৃক্ষনির্যাস মাত্র।
পবিত্র বাইবেলে এই মাস্কট শহর ও যাদুকরী লোবানের কথা উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থসমূহে নির্দিষ্টভাবে ‘মুতরাহ সুউক’ বাজারের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এটি আমাদের ইঙ্গিত দেয়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই এখানে স্বর্ণ, রৌপ্য, লোবানসহ জগতের নামী দামী পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় চলে আসছে।
কথিত আছে, শিশু যিশুখ্রিষ্ট যখন একটি ছাদের নীচে লালিতপালিত হচ্ছিলেন, তখন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এমন বিশ্বাসে তিনজন ধর্মবেত্তা তাকে তিনটি মূল্যবান জিনিস উপহার প্রদান করেন। এর মধ্য ছিল স্বর্ণ, মিরাহ (সুগন্ধিতে ব্যবহৃত বিশেষ বৃক্ষজ আঠা) ও লোবান। এই উপহার তার নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ধর্ম প্রচারক হওয়ারও ইঙ্গিতও প্রদান করে। এ কারণে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা উক্ত তিনটি জিনিসকে বিশেষ ধর্মীয় মর্যাদা প্রদান করে থাকেন। প্রায় ৬,০০০ বছর ধরে এই লোবান মূল্যবান সুগন্ধি, সর্বরোগের ঔষধ ও পবিত্র বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বার্সেরাসিয়া পরিবারের বসওয়েলিয়া প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে লোবানের রেজিন সংগ্রহ করা হয়। বিশেষত, বসওয়েলিয়া স্যাকরা (Boswellia sacra) নামক গাছে অধিক পরিমাণে লোবানের রেজিন পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সোমালিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ভারতের কিছু অঞ্চলে এই গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত অধিকাংশ বসওয়েলিয়া স্যাকরা বৃক্ষ সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া ও ইয়ামেন- এই তিনটি দেশে উৎপন্ন হয়। বর্তমানে উক্ত তিনটি দেশেই যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত বিরাজমান থাকায় লোবানের বাজার একচেটিয়া ওমানের দখলে চলে এসছে। তবে ওমানের বাজার সব সময়েই ভালো ছিল, কেননা আদিকাল থেকেই এখানে বিশ্বের সবচেয়ে নিখুঁত লোবান তৈরি হয়। ওমানের লোবানই বিশ্বের সবচেয়ে দামী লোবান হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীন মিশরীয়রা এই লোবানকেই বলতো,
ঈশ্বরের ঘামের নির্যাস।
ওমানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ দাফুরের জনমানবশূন্য শুষ্ক ভূমিতে এই বসওয়েলিয়া স্যাকরা বৃক্ষ জন্মায়। বৃক্ষের বাকল থেকে লোবানের রেজিন সংগ্রহ করা হয়। তা থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মানের লোবান উৎপন্ন করা হয়। মূলত রঙ, ঘনত্ব ও তৈলের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে লোবানের দাম নির্ধারিত হয়। ওমানে বসওয়েলিয়া স্যাকরা গাছের পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও, এসব শর্তপূরণ ও উত্তম পরিবেশনের কারণে এখানে তৈরি লোবান সারা বিশ্বে সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছে। সবচেয়ে ভালো গ্রেডের লোবানের নাম ‘হোজারি’। এই লোবানের রেজিন শুধুমাত্র দাফুরের পর্বত বেস্টিত অঞ্চলে উৎপাদিত হয়, তা-ও নির্দিষ্ট আবহাওয়ার শর্তে (গ্রীষ্ম মৌসুমের শেষ ও বর্ষা মৌসুম শুরুর মাঝামাঝি সময়ে)।
গবেষকগণ জানিয়েছেন, দাফুরের যে অঞ্চলে বর্তমানে লোবান বৃক্ষের সমাহার দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকেই তা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে একাধিক বন্দর ও মরুপথ ছিল। এই বন্দরে প্রধানত লোবানের বাণিজ্য চলতো। মরুপথ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বণিকগণ সেখানে সমাবেত হতেন। এজন্য ইউনেস্কো এই জায়গাটিকে ‘লোবানের ভূমি’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। ইউনেস্কো এই শহরের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছে-
অত্র অঞ্চলে বহুকাল আগে লোবানের বাণিজ্য প্রসারিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্য যুগে যেসব বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের সন্ধান পাওয়া যায় তার মধ্যে এই বাণিজ্য ছিল অন্যতম প্রধান।
এখান থেকে বণিকগণ হাজার হাজার উট ও অনুগত দাসদের সাথে নিয়ে আরব মরুভূমির প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মিশর, ব্যাবিলন, গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে লোবান বিক্রি করতে যেতেন। এমনকি তারা জাহাজে লোবান বোঝাই করে চীন পর্যন্ত বাণিজ্য করতে যেতেন। প্রখ্যাত রোমান লেখক ও দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডার (২৩-৭৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন,
এই বাণিজ্যই দক্ষিণ আরবীয়দের পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে।
আধুনিক যুগে ব্যথানাশক ও রক্তক্ষরণ বন্ধে যেমন অ্যাসপিরিন, পেনিসিলিন ও ভায়াগ্রার ব্যবহার হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে তেমনি লোবানের বহুমুখী ব্যবহার হতো। পাইলস, নারীদের মাসিকের যন্ত্রণা ও মেলানোমার প্রতিষেধক হিসেবে লোবান কার্যকরী ভূমিকা পালন করতো। গ্রিক সেনাবাহিনীর চিকিৎসক পেডানিয়াস ডায়োসোক্রেডস ফ্র্যাঙ্কেনসেস লোবানকে ‘সর্বরোগ নিরাময়ে আশ্চর্য ঔষধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন,
লোবানের আঠাযুক্ত রেজিন আলসারের ক্ষত কিংবা দেহের তীব্র রক্তক্ষরণ ঠেকিয়ে দিতে পারে।
প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘দ্য ইবারস প্যাপিরাস’-এ লোবানকে অ্যাজমা, রক্তক্ষরণ, গলার সংক্রমণ ব্যাধি এবং বমি বমি ভাব দূর করার অন্যতম প্রতিষেধক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিশরীয়রা চিকিৎসা ও সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রচুর পরিমাণে লোবান আমদানি করতো। ১৯২২ সালে যখন সম্রাট তুতেনখামুনের সমাধি উন্মুক্ত করা হয়, তখন সেখানেও লোবানের তৈরি মলমের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রাচীনকালে দগ্ধ লোবানের ধোঁয়াকে স্বর্গীয় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হত। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থান পবিত্র হতো বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। সম্ভবত এ কারণেই প্রত্নতাত্ত্বিকগণ যতগুলি প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন, তার অধিকাংশেই লোবানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধু প্রাচীনকাল নয়, বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এসেও লোবান নিয়ে নানা লোককথা ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন ওমানের বাসিন্দা আমর বিন হামাদ আল হোসাইন তাদের বিশ্বাসের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
আমরা সাপ তাড়ানোর জন্য লোবান পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করে থাকি।
মুসলমানদের মধ্যেও লোবান নিয়ে নানা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। ওমানের স্থানীয় মুসলমানদের বিশ্বাস, ঘরে নিয়মিত লোবান জ্বালালে জ্বীনের কুপ্রভাব হতে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া লোবানের সুগন্ধি ব্যবহার মুসলমানদের কাছে দীর্ঘকালযাবত উত্তম কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোবানের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। অনেক অঞ্চলে গর্ভবতী নারীদের লোবানের রেজিন খাওয়ানো হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে মায়ের কষ্ট লাঘব হয় এবং প্রসূত সন্তান অত্যন্ত বুদ্ধিমান হয়। এছাড়া লোবানের তৈল অত্যন্ত মূল্যবান প্রসাধনী হিসেবে বিক্রি হয়। এতে ত্বক সুরক্ষিত ও মসৃণ থাকে বলে ব্যবহারকারীদের বিশ্বাস। মশা তাড়ানোর জন্যও লোবানের ধোঁয়া ব্যবহার করা হয়। সর্বোপরি লোবানের ব্যবহার আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ১০০ গ্রাম ওজনের এক বোতল লোবানের দাম প্রায় ২৯,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ওমানের আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাই মূলত দাফুরের দুর্গম পর্বতে গিয়ে লোবানের চাষ করে থাকেন। লোবান উৎপাদনের জন্য তারা প্রথমে বসওয়েলিয়া গাছগুলোর চিকন ও শক্ত শাখা-প্রশাখার বাঁকলগুলো কুপিয়ে করে রাখেন, যাকে বলা হয় ‘ট্যাপিং’। এরপর সেখান থেকে দুধের মতো সাদা রঙের রস বের হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় ‘টিয়ার’ বা অশ্রু। উক্ত অশ্রু জমা হয়ে অনেকটা মোমের মতো রূপ ধারণ করে, যাকে বলা হয় ‘স্যাপ’। শ্রমিকরা প্রায় ১০ দিন যাবত উক্ত স্যাপকে ঘনীভূত করে আঠায় পরিণত করেন। ঐ আঠা থেকেই লোবানের প্রধান উপাদান রেজিন সংগ্রহ করা হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সারা বিশ্ব থেকে বর্তমানে লোবান বৃক্ষ দ্রুত হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লোবান সংগ্রহের লোভে এই মূল্যবান গাছ নষ্ট করে ফেলছেন। এছাড়া সোমালিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের কারণে লোবানের গাছসমূহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও ‘কালটিভেশন অফ বসওয়েলিয়া’ গ্রন্থের লেখক জোশুয়া এসলামিহ বলেন,
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও সুগন্ধি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে লোবানের চাহিদা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বসওয়েলিয়া বৃক্ষের ওপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। এতে বসওয়েলিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে। ফলে এই মূল্যবান বৃক্ষটি হুমকির মুখে পড়েছে।
সম্প্রতি উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ বসওয়েলিয়া স্যাকরা বৃক্ষকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়কি ‘ন্যাচার’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে এই বৃক্ষের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যাবে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যেখানে একটি বসওয়েলিয়া স্যাকরা বৃক্ষ থেকে গড়ে ১০ কেজি লোবান সংগ্রহ করা যেত, বর্তমানে সেখানে মাত্র ৩.৩০ কেজি লোবান সংগ্রহ করা যায়। উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, গত ২ যুগে শুধুমাত্র দাফুরের ‘জাবাল সামহান’ নামক সংরক্ষিত বনেরই ৮৫ শতাংশ গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে।তবে এই সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। ওমানের ‘পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠন’ এর পরিচালক ডক্টর মহসিন আল আমারি বলেন,
অনভিজ্ঞ ও পার্ট-টাইম শ্রমিকরা বসওয়েলিয়া বৃক্ষ থেকে সঠিভাবে রস সংগ্রহ করতে পারছেন না। তারা অসতর্কতা বসত অনেক গাছ নষ্ট করে ফেলছেন। তারা ছোট ও অপরিপক্ব গাছ থেকেও রস সংগ্রহ করার অপচেষ্টা করছেন। এছাড়া পরিপক্ব গাছ থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত রস সংগ্রহ করায় তা-ও অকালে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই এই গাছ হুমকির মুখে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি।
বর্তমানে শুধুমাত্র ওমান কিংবা মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের প্রায় সকল উন্নত দেশে লোবানের চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। উন্নত মানের পারফিউম ও প্রসাধনী তৈরিতে লোবানের ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু এই চাহিদাই লোবান বৃক্ষকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এ যেন এক দুষ্ট চক্র। এই দুষ্ট চক্র থেকে লোবান বৃক্ষ মুক্তি পাক এ-ই আমাদের কামনা।