আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসিত একটি ভূখণ্ড জিব্রাল্টার। স্পেনের সীমানার দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলটির আয়তন প্রায় ৬.৫ বর্গ কিলোমিটার। এখানে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২৬ মিটার উঁচু একশিলা চুনাপাথরের শৈলান্তরীপ, যেটি ‘দ্য রক অব জিব্রাল্টার’ নামে পরিচিত। একে ‘হারকিউলিসের স্তম্ভসমূহ’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
উত্তর আফ্রিকার মুসলিম মুর জাতিগোষ্ঠীর সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদ ৭১১ সালের ২৭ এপ্রিল জিব্রাল্টারে অবতরণ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। আরবি শব্দগুচ্ছ ‘জাবাল আল তারিক’ অর্থাৎ,’তারিকের পাহাড়’ থেকে ‘জিব্রাল্টার’ নামটি নেওয়া হয়েছে। ১৪৬২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭৫১ বছর জিব্রাল্টারে মুসলিম শাসন বজায় ছিল।
এরপর জিব্রাল্টার স্প্যানিশ শাসনের অধীনে আসে এবং ১৭০৪ সাল পর্যন্ত জিব্রাল্টারে স্প্যানিশ শাসন জারি থাকে। ১৭০০ সালের ১লা নভেম্বর স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর ফলে ১৭০১-১৪ সাল পর্যন্ত স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এই সংঘাতের সুযোগ নিয়ে ১৭০৪ সালের ৪ঠা আগস্ট ব্রিটিশ এডমিরাল জর্জ রুকের নেতৃত্ব অ্যাংলো-ডাচ সামরিক বহর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্পেনের নিকট থেকে জিব্রাল্টারের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৭১৩ সালে নেদারল্যান্ডসের ইউট্রেখ্ট শহরে ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির দশম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ জিব্রাল্টার অঞ্চলকে ব্রিটিশদের নিকট হস্তান্তর করে।
১৭১৩ সালে ব্রিটেনের সাথে ইউট্রেচট শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে জিব্রাল্টারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চেষ্টা চালিয়ে যায়। ১৭২৭ সালে স্প্যানিশ বাহিনী রক অব জিব্রাল্টারের চারপাশে অবস্থান নিয়ে অবরোধ আরোপ করে এবং প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে লড়াইয়ের পর ১৭২৯ সালের ৯ নভেম্বর স্পেনের সেভিল শহরে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে এই সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে।
১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে, জিব্রাল্টারের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ফ্রান্সের সহায়তায় স্প্যানিশ বাহিনী ১৭৭৯ সালের ২৪ জুন থেকে ১৭৮৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর সাড়ে ৭ মাস জিব্রাল্টার অবরুদ্ধ করে রাখে। সেই সময়ে জিব্রাল্টারের গভর্নর ছিলেন ব্রিটিশ সেনাপতি জর্জ অগাস্টাস ইলিয়ট। স্প্যানিশ বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড লড়াই করে ১৭৮০ সালে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল জর্জ রডনি এবং ১৭৮১ সালে ব্রিটিশ ভাইস অ্যাডমিরাল জর্জ ডার্বি অবরুদ্ধ জিব্রাল্টারে পৌঁছেছিলেন। ফলে জিব্রাল্টারের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্পেনের অবরোধ সফল হয়নি।
এরপরও প্রায় ৩৫ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত জিব্রাল্টারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। অঞ্চলটির আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন খাত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৬৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুমোদিত রেজুলেশন ২০৭০ অনুযায়ী, ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে জিব্রাল্টার সংকট সমাধানের আহবান জানান হয়। এরপর দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং দু’পক্ষ জিব্রাল্টারে একটি গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে সম্মত হয়।
ব্রিটেনের সাথে সংযুক্ত থাকা অথবা স্পেনের অধীনে যাওয়া সংক্রান্ত ১৯৬৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণভোটে জিব্রাল্টারের ৯৯ শতাংশেরও বেশি ভোটার ব্রিটেনের সাথে সংযুক্ত থাকার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন। প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর জিব্রাল্টারে জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর জিব্রাল্টারে আবারও একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ প্রশাসনের আয়োজিত সেই গণভোটে ৯৮ শতাংশেরও বেশি ভোটার জিব্রাল্টারের কর্তৃত্ব স্পেন এবং ব্রিটেন এর মধ্যে ভাগাভাগি করা সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে শুধু ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সংযুক্ত থাকার ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানান।
১৯৬৯ সালের ২৮ আগস্ট ‘জিব্রাল্টার হাউস অব অ্যাসেম্বলি’র প্রথম অধিবেশন শুরু হয়, যার মধ্য দিয়ে জিব্রাল্টারে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার কার্যক্রমের সূচনা হয়। নতুন সংবিধানের উপর জনমত যাচাইয়ের জন্য ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর জিব্রাল্টারে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোটার নতুন প্রণীত সংবিধানের সমর্থনে মতামত দেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী অঞ্চলটির আইনসভার নাম ‘জিব্রাল্টার পার্লামেন্ট’ করা হয় এবং এই আইনসভা তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমানে ১৭ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে ‘জিব্রাল্টার পার্লামেন্ট’ গঠিত হয়েছে। জিব্রাল্টার সোশ্যালিস্ট লেবার পার্টির নেতা ফ্যাবিয়ান র্যামন্ড পিকার্ডো ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে অঞ্চলটির ৬ষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২০ সালের ১১ জুন থেকে ব্রিটিশ ভাইস অ্যাডমিরাল স্যার ডেভিড জর্জ স্টিল জিব্রাল্টারের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্বের অন্যতম ট্যাক্স হ্যাভেন হিসেবে পরিচিত জিব্রাল্টার বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া কর ফাঁকির অর্থ রাখার আশ্রয়স্থল হিসেবেও পরিচিত। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে জিব্রাল্টার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর উপকূল থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে জিব্রাল্টারের অবস্থান। বিশ্বের অন্যতম ব্রিটিশ সামরিক স্থাপনা হিসেবে অঞ্চলটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেখানে বিমান ঘাঁটি এবং নৌ ঘাঁটি রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সামরিক ঘাঁটি ব্রিটেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
জিব্রাল্টার প্রণালি বা ‘স্ট্রেইট অব জিব্রাল্টার’-এর উপর নজরদারি প্রতিষ্ঠার জন্য জিব্রাল্টার ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিব্রাল্টার প্রণালি আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্য সংযোগসাধন করেছে। ভূমধ্যসাগরের প্রবেশস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এই প্রণালিকে ‘ভূমধ্যসাগরের চাবি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জিব্রাল্টার প্রণালির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৮ কিলোমিটার এবং এর সর্বনিম্ন প্রস্থ প্রায় ১৩ কিলোমিটার। জিব্রাল্টার প্রণালির সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রণালির মাধ্যমে বাণিজ্যিক জাহাজ সহজে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখান থেকে সুয়েজ খাল দিয়ে লোহিত সাগরে প্রবেশ করতে পারে। বর্তমানে বৈশ্বিক বাণিজ্যের অধিকাংশই জলপথ ব্যবহার করে হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে জিব্রাল্টার প্রণালি পৃথিবীর ব্যস্ততম জলপথগুলোর মধ্যে একটি।
২০১৬ সালের ২৩ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের অপসারণ অর্থাৎ, বেক্সিট সংক্রান্ত একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে যুক্তরাজ্যের ৫১ শতাংশেরও বেশি ভোটার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে সমর্থন জানান। গণভোটের ফলাফল অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তবে ২০১৬ সালের গণভোটে জিব্রাল্টারের প্রায় ৯৬ শতাংশ ভোটার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকার ব্যাপারে সমর্থন জানান। এমনকি জিব্রাল্টারের কয়েকটি রাজনৈতিক দল দ্বিতীয় দফা বেক্সিট গণভোটের দাবি জানায়।
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত থাকার সময় জিব্রাল্টারের সীমান্ত সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং অন্যান্য বিষয় এই জোটের আইন অনুসারে পরিচালিত হত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেক্সিট পরবর্তী জিব্রাল্টারের পদক্ষেপ ঠিক করতে স্পেন এবং যুক্তরাজ্যকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহবান জানায়। স্পেন এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনার পর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশ দুটো একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। সেই সমঝোতা অনুযায়ী, জিব্রাল্টার ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেনজেন চুক্তির অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ১৯৮৫ সালে লুক্সেমবার্গের শেনজেন শহরে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে, ইউরোপের কয়েকটি দেশের মধ্যে পাসপোর্টবিহীন সীমান্ত ধারণার উপায় তৈরি করা হয়।
বর্তমানে স্পেন ১৭১৩ সালে স্বাক্ষরিত ইউট্রেখ্ট শান্তি চুক্তি থেকে বের হয়ে এসে জিব্রাল্টারের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ, স্প্যানিশ সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য যেকোনো মূল্য জিব্রাল্টারের দখল বজায় রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। কারণ, জিব্রাল্টার প্রণালির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য জিব্রাল্টারের দখল অত্যন্ত তৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্য এবং আর্জেন্টিনা ভয়াবহ সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। জিব্রাল্টারের দখল এবং জিব্রাল্টার প্রণালিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাজ্য এবং স্পেনের মধ্যে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কিনা- তা সময়ই নির্ধারণ করবে।