শুরুটা হয়েছিল ‘মি টু’ আন্দোলন দিয়ে। প্রাথমিকভাবে বলিউড অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা পাটেকরকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত করে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দেন। তনুশ্রীর দেখাদেখি অন্যান্যরাও তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করে দেন জনসমক্ষে। আর ক্রমেই ‘মি টু’ আন্দোলনের পরিধি বলিউড ছাড়িয়ে অন্যান্য পেশা, যেমন সংবাদমাধ্যমকেও স্পর্শ করে। আর এই প্রসঙ্গে সবার আগে যার নাম আসে তিনি হলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এম জে আকবর। বর্তমানে যিনি ভারতের বিদেশমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী।
আমার সাংবাদিক জীবনের গোড়ার দিকের একটি ঘটনা বলি। আমি তখন একটি ইংরেজি দৈনিকে কাজ করি। আমার উর্দ্ধতন যেই ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বয়সে তরুণ হলেও তার মুখ ছিল খুব খারাপ। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই তিনি তার দলের সদস্যদের উপরে খড়গহস্ত হতেন। সামান্য ভুলচুকেও তার হাত থেকে পরিত্রাণ ছিল না। চলতো অকথ্য গালিগালাজ, চাকরি খেয়ে নেওয়ার ভয় দেখানো। তা অন্যান্যরা এই ব্যাপারে সেই ব্যক্তির ভয়ে কুঁকড়ে থাকলেও আমি ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারতাম না। একদিন আর থাকতে না পেরে আমি কাগজটির যিনি সেই শহরের কার্যনির্বাহী সম্পাদক, তার কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বলি। “এইরকম গালিগালাজ চলতে থাকলে আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়,” তাকে এই কথা বলতেই তিনি আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন এক অদ্ভুত কথা।
বলেন, “এম জে আকবরের সঙ্গে কাজ করেছ কখনও? এ তো কিছুই নয়। আমরা উনার সাথে কাজ করেছি। উনি বাপ-মা তুলে গালাগালি করতেও ছাড়েন না।”
এম জে আকবরের নাম তার আগে শুনিনি তা নয়। কিন্তু প্রথিতযশা সাংবাদিক ছাড়াও যে তার অন্যান্য নানা পরিচয়ও রয়েছে, সেটা তখনই প্রথম জানলাম। আমি সম্পাদক মহাশয়টিকে বিনীতভাবেই জানিয়েছিলাম যে, বাপ-মায়ের নামে গালাগালি শুনে কাজ করতে হয়তো তাদের অসুবিধে হয়নি, কিন্তু আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। “নিজের সম্মান সবার আগে,” বলে আমি সেই সংবাদপত্রের অফিস থেকে পদত্যাগ করেছিলাম সেইদিনই।
আজকে বহু বছর পরে যখন সেই এম জে আকবরের নাম ফের দেখছি সর্বত্র- কীভাবে একের পর এক নারী যারা এক সময়ে আকবর সাহেবের সঙ্গে কাজ করে তার বিরুদ্ধে এনেছেন ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ, তখন বছর দশেক আগেকার সেই সম্পাদকের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথাই মনে পড়ছিল। নিজের ‘সম্মান’ নিয়ে সমঝোতা কেন করবে মানুষ? তারা একজন প্রতিভাবান মানুষের সংস্পর্শে যায় তার থেকে ইতিবাচক কিছু শিখতে, কিন্তু যখন সেই মানুষটির তরফ থেকেই ধেয়ে আসে প্রবল আঘাত, তখন সেই যন্ত্রণা রাখার জায়গা মেলা ভার।
আকবরের বিরুদ্ধে যারা আজ অভিযোগ আনছেন, তারা প্রত্যেকেই মানুষটির মধ্যে এক উৎকৃষ্ট মানের সাংবাদিক দেখেই তার কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তাদের যে দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল বলে তারা দাবি করছেন, সেটা কাম্য নয়। আকবরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি আজ উঠছে, তার পূর্ণ তদন্ত হওয়া অবশ্যই উচিত।
এখন এই অধ্যায়টিতে একটি অন্য দিকও রয়েছে। আকবরের বিরুদ্ধে যে প্রবল ধিক্কার শোনা যাচ্ছে চারিদিকে এখন, তার মধ্যে কিন্তু এখন ‘রাজনীতি’ও ঢুকে পড়েছে। যেহেতু এই ৬৭ বছর বয়সী সাংবাদিক এখন ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের একজন রাষ্ট্রমন্ত্রী, তাই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো প্রকারান্তরে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বা আরও গুছিয়ে বললে, তা পরোক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে যাচ্ছে। গত চার বছরের উপরে মোদী এমন একটি সরকার উপহার দিয়েছেন যার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা যৌন ঘটনা নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। সামনেই দেশের পাঁচটি প্রদেশে বিধানসভা ও সামনের বছর লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনের এই ভরা মরশুমে এম জে আকবরকে নিয়ে এই আলোড়ন যে বিরোধীদের হাতে এক বড় অস্ত্র তুলে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আক্রমণ শানানো হবে শাসকদল বিজেপির দিকে। বিজেপির তরফ থেকে এই পর্যন্ত আকবরের প্রসঙ্গে কোনো সরকারি বিবৃতি দেওয়া হয়নি। বেশ কিছু অভিজ্ঞ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে (যাদের মধ্যে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও রয়েছেন) দেখা গিয়েছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে, আর আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্র স্মৃতি ইরানি বলেছেন যে এই প্রসঙ্গে যা বলার তা আকবর নিজেই বলবেন। এখানেও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা সুস্পষ্ট।
বিরোধী দল কংগ্রেস মুখে এই নিয়ে হৈচৈ জুড়লেও একটি বিষয় খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, তারাও যে খুব গরজ দেখাচ্ছে, তা নয়। দলের অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীকে সম্প্রতি একটি সাংবাদিক বৈঠকে বলতে শোনা যায় যে, ‘মি টু’ একটা খুব বড় ইস্যু এবং তিনি পরে এই নিয়ে বক্তব্য রাখবেন। রাফালে চুক্তি নিয়ে রাহুল যতটা তেড়েফুড়ে উঠেছেন বিজেপি এবং মোদীর বিরুদ্ধে, ‘মি টু’ বা আকবরকে নিয়ে সেরকম আগ্রহের কি তাহলে অভাব কংগ্রেসের কৌশলে?
সোজা বুদ্ধিতে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কংগ্রেস ইতিহাস-ভীরু। আশির দশকের শেষের দিকে আকবর যখন নির্বাচনী রাজনীতিতে আসেন, তিনি তখন কংগ্রেস দলে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছাকাছি ছিলেন তো বটেই, ১৯৮৯ সালে যখন বাকি কংগ্রেস লোকসভা ভোটে হেরে পর্যুদস্ত, তখন আকবর বিহারের কিষাণগঞ্জ কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৬,০০০ ভোটে জেতেন। পরে তিনি রাজীবের মুখপাত্র হন এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের উপদেষ্টাও হন। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে হেরে পরের বছর আকবর সাংবাদিকতায় ফেরেন। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর পরে রাজনীতিতে ফের পা রাখেন এবং বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ড এবং ২০১৬ সালে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য থেকে আকবর রাজ্যসভার সদস্য হন। ওই বছরই তিনি বিদেশমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হন।
এখন কংগ্রেসের বিড়ম্বনা হচ্ছে যে, অতীতে যেহেতু তাদের সঙ্গে আকবরের দহরম-মহরম ছিল এবং খোদ গান্ধী পরিবারের সঙ্গে এই বর্ষীয়ান সাংবাদিক-রাজনীতিকের যোগাযোগ ছিল, তাকে এখন আক্রমণ করা মানে পাল্টা আক্রমণের মুখেও পড়া। পাশাপাশি কংগ্রেসের জাতীয় ছাত্র সংগঠন এনএসইউআই-এর অধ্যক্ষ ফাইরোজ খানের বিরুদ্ধেও সংগঠনেরই পাঁচ নারী সদস্যকে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। খোদ রাহুল গান্ধীর কাছে দাবি উঠেছে ফাইরোজকে অপসারিত করার। পাশাপাশি, কংগ্রেসের কিছু প্রাক্তন নেতা নির্বাচনে লড়ার টিকিট পাইয়ে দেওয়ার বদলে কিছু নারী পদপ্রার্থীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতে চেয়েছেন বলেও কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। এই কানাঘুষা যেকোনো মুহূর্তে দাবানলের আকার নিয়ে গ্রাস করতে পারে খোদ কংগ্রেসকেই। এই অবস্থায় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব যে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে এগোবে, তাতে সন্দেহ নেই।
সমস্যা হচ্ছে, আকবর কাণ্ডটি এখন একটি রাজনৈতিক খেলার অংশ হয়ে গেছে। আর তাতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আসল সমস্যাটি, যা হলো ক্ষমতাবানদের হাতে নিম্নস্তরের লোকজনের সম্মানহরণ। শুধু আকবর কেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠছে তা কান পাতলে শোনা যাবে মিডিয়া জগতের অনেক প্রভাবশালী সম্পাদকের বিরুদ্ধেই; বা সমাজের অন্যান্য অনেক পেশার ক্ষেত্রেই। এটি এখন একটি শ্রেণী-সমস্যার আকার নিয়েছে যেখানে উচ্চপদস্থের কাছে তার অধীনস্থের নিত্য হয়রানি বাধা। এর মোকাবেলা কি শুধু একজন এম জে আকবরকে শূলে চাপিয়ে হবে? না। এর জন্যে চাই প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ, কড়া আইন এবং তার বাস্তবায়ন।
আমরা আপাতত মেতেছি এক ব্যক্তির মুণ্ডুপাত করতে। রাজনীতির কারবারিরা মেতেছেন গা বাঁচানো আর দোষারোপের খেলায়। এই সারশূন্যতার অন্তিম ফলাফল কতটা কার্যকরী হবে তা বলা মুশকিল। দুঃখের ব্যাপার একটাই, যদি আদৌ এই বিষয়টি কোনো সুফল না আনতে পারে, তাহলে যে ক’জন নারী অনেক সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন তাদের স্ব-স্ব অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে, তাদের পুরো সংগ্রামটাই মাঠে মারা যাবে।