একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের নতুন জোয়ার এসেছে, এসেছে যোগাযোগের নতুন নতুন মাধ্যম। ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের মধ্যে সময়ের দূরত্ব কমেছে, যোগাযোগ সহজতর হয়েছে, সহজতর হচ্ছে তথ্যের সরবরাহ। এই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, সংযোগ ঘটাচ্ছে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের। ফলে, প্রথাগত গণমাধ্যমের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে তথ্যের অন্যতম উৎস হিসেবে। প্রথাগত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেসব দেশে সীমাবদ্ধ, সেসব দেশের জনগণের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রাষ্ট্রচিন্তক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছয় ধরনের সরকার ব্যবস্থার উপস্থিতির কথা বলেছেন। সকলের মঙ্গলের জন্য একের শাসনব্যবস্থা হলো রাজতন্ত্র, এর বিচ্যুত ব্যবস্থা হলো স্বৈরতন্ত্র, যেখানে শাসকের সমৃদ্ধিই থাকে শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। সকলের মঙ্গলের জন্য গুটিকয়েকের শাসন পরিচিত অভিজাততন্ত্র হিসেবে, যার বিচ্যুত রূপ হলো কতিপয়তন্ত্র। কতিপয়তন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য থাকে গুটিকয়েক ব্যক্তির স্বার্থরক্ষা আর সমৃদ্ধির পথ করা, যারা ক্ষমতা আর শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকে। সকলের মঙ্গলের জন্য বহুজনের শাসনকে বলা হয় পলিটি, আর পলিটির বিচ্যুত রূপ হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে চতুর দরিদ্ররা ক্ষমতার কাছাকাছি এসে চেষ্টা করে সম্পদ অর্জনের, ক্ষমতা আর প্রভাবকে ব্যবহার করে অনেক সময় তৈরি হয় গুটিকয়েকের স্বার্থান্বেষী অংশও।
কাঠামোগতভাবে কর্তৃত্ববাদ স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও বর্তমান সময়ে কর্তৃত্ববাদকে বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মানবজাতির কাছে রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে ফ্যাসিজম ছিল, গণতন্ত্র ছিল, ছিল বলশেভিক বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হওয়া কমিউনিজমও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলার আর মুসোলিনিদের সাথে পতন ঘটে ফ্যাসিজমের, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে শাসনব্যবস্থা হিসেবে পতন ঘটে কমিউনিজমেরও। একমাত্র শাসনব্যবস্থা আর মতাদর্শ হিসেবে টিকে থাকে গণতন্ত্র। এ কারণে বর্তমানে সামরিক বাহিনী থেকে আসা শাসকেরাও নির্বাচন আয়োজন করে, গণভোটের আয়োজন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শাসকেরাও।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে শাসনব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটা দ্রুত পরিবর্তন ঘটলেও নাগরিকদের মানসিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি, নিষ্ক্রিয় হয়নি কতিপয়তন্ত্রের আর স্বৈরতন্ত্রের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোও। ফলে, প্রাতিষ্ঠানিক গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এর মধ্যেই প্রকাশ পায় শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রের, শাসকের আশেপাশে থাকা অংশগুলোর কতিপয়তান্ত্রিক চরিত্রেরও। শাসকদের এই চরিত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কারসাজি এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে গণতন্ত্রের ধারণাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে জায়গায় ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটির ব্যবহার আসলে প্রকৃত অবস্থাকে আড়াল করে একটা একাডেমিক নাম দিতে ব্যবহৃত হয়। তবুও, ব্যাপক অর্থে একটি ব্যাখ্যা আমাদের সামনে রয়েছে, যেটি বিশ্বের সব দেশের সরকারব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পোশাকি গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের চর্চার কারণে গণতন্ত্রের বহুত্ববাদের ধারণার যে অবক্ষয় হচ্ছে, সেটি বোঝাতেই ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
সাধারণভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে স্বৈরতন্ত্র আর শাসকদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের লড়াইয়ের একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়, দেখা হয় বাকস্বাধীনতা চর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে। এই মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে সাধারণ জনগণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীর বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, বাধ্য করতে পারে জনমতের নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে। গণতন্ত্রের যে বহুত্ববাদের ধারণা, একটি বৈশ্বিক সম্প্রদায় হিসেবে মানুষকে প্রকাশের যে তাড়না, তার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বাহ্যিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কি আসলেই আমাদের মধ্যে বহুত্ববাদের ধারণা বিকশিত করছে? বিকশিত করছে উদার গণতন্ত্রের ধারণাকে?
প্রকৃত অর্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এর কোনোটাকেই বিকশিত করেনি, বরং শক্তিশালী করেছে কর্তৃত্ববাদের ব্যবস্থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীদের বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে, এটা কোনো নতুন খবর নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এই বিপুল তথ্য, যা ব্যবহারকারীদের পছন্দ আর অপছন্দের প্রকাশ করে, সেগুলোর গ্রাহকের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বহু কর্তৃত্ববাদী সরকারও। এ তথ্যের মাধ্যমে শাসকেরা জানতে পারে গ্রাহকের, যারা উক্ত শাসকের দেশের নাগরিক, তাদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা, মন্দলাগা, এমনকি ব্যক্তিগত ভাবনাগুলোও।
ধরুন, আপনি ‘ক’ দেশের নাগরিক, যে দেশে হয়তো গণতান্ত্রিক উপায়ে শাসক ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছে, কিংবা কর্তৃত্ববাদী হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক মোড়কে এসে। এখন, এই সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসককে হয়তো আপনার পছন্দ না, সেই ব্যাপারটা ভাগ করলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একান্ত এক বন্ধুর সাথে, করলেন সমালোচনাও। আপনাদের সে কথোপকথনের তথ্য হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিক্রি করে দেবে আপনার দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃত্ববাদী সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন বৃহৎ পরিসরের জনগণের সামনে আসবে, তখন দিনের সময়ের একটা বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাটালেও আপনি নিজের চিন্তাগুলো প্রকাশ করবেন না, সুযোগ পাবেন না প্রকাশের।
এই ইস্যুই কি একমাত্র সমস্যা? না। ধরুন, গ্রাহকদের ব্যবহৃত ডিভাইসের সিকিউরিটি সিস্টেম ভালো, কিংবা ব্যবহৃত যোগাযোগ মাধ্যম নৈতিক জায়গা থেকে এই তথ্যগুলো বিক্রি করল না। কিন্তু এর বাইরেও প্রত্যেকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু তথ্য থাকে সবার জন্য উন্মুক্ত, কিছু তথ্য বা চিন্তাভাবনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার জন্য প্রতিনিয়ত উন্মুক্ত করা হয়। এই বিপুল তথ্য স্বাভাবিকভাবেই শাসকের সাইবার উইং ম্যানুয়ালি যাচাই করতে পারবে না। এর জন্য সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অ্যালগরিদমের তৈরি হয়েছে, যেগুলো শব্দ ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য যাচাই করতে পারে।
‘ক’ দেশের সকল নাগরিকেরা তাই সরকারকে নিয়ে কী কী পোস্ট দিচ্ছে, তা ‘সরকার’ শব্দটাকে ব্যবহার করে ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব, সম্ভব শাসকের নাম ধরে ফিল্টারিং করলেও। এ প্রক্রিয়ায় যেকোনো পোস্টের পৌঁছানোর হার কমিয়ে দিতে পারা যায়, বাড়িয়ে দেয়া যায় প্রশংসাসূচক পোস্টগুলোর রিচ।
ফলে, খুব সহজেই শাসকের পক্ষে কনসেন্ট ম্যানুফেকচারিং বা সম্মতি উৎপাদন করা সম্ভব, সম্ভব জনমতকে প্রভাবিত করা। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে একটা সময় দেশের জনগণ চিন্তার এই একমুখী প্রবাহে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে, এই জনগণের মধ্য থেকে কোনো ক্ষুদ্র অংশ মুক্তচিন্তার চর্চা করতে চাইলে, গণতন্ত্রায়নের দাবি করলে এই একমুখী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুক্তচিন্তা আর বহুত্ববাদের প্রথম বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এর বাইরে থেকে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে জনমতের সাথে সরকারকে একাত্ম হতে বাধ্য করার ব্যাপারটি। হ্যাঁ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ট্রেন্ডের সাথে মাঝে মাঝে সরকার একমত হচ্ছে, করছে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, নিচ্ছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। সরকারের কোর ইন্টারেস্টে আঘাত করলে নতুন ইস্যু বা জনমত দ্বারা পুরাতন ইস্যুকে প্রতিস্থাপিত করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় দু’টি ব্যাপার লক্ষণীয়। প্রথমত, এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদের বদলে গণতন্ত্রায়ন হচ্ছে না, বরং কর্তৃত্ববাদ বৈধতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষেত্রবিশেষে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিলেও তারা আসলে এর বিকল্প চ্যালেঞ্জগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। বাহ্যিক আন্দোলন গণতন্ত্রায়নের যে সুযোগ তৈরি করতে পারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সে জায়গায় বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে পারেনি।
এগুলো কেবলমাত্র কর্তৃত্ববাদী সরকারের রক্ষণশীল উদ্যোগ। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের শাসন আর কার্যক্রমের বৈধতার জন্য যাচ্ছে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করছে সম্মতি উৎপাদনের কাজে, ব্যবহার করছে জনমতের প্রবাহকে একমুখী করতে। এভাবেই কর্তৃত্ববাদ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হরিহর আত্মা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।