হবসিয়ান প্রকৃতির রাজ্যের নৈরাজ্য থেকে বাঁচতে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র তৈরি করেছিল নাগরিক নিরাপত্তার জন্য। লকের দর্শনে যে ঘটনাটি উঠে এসেছে মানুষের মধ্যে ‘সামাজিক চুক্তি’ হিসেবে। নাগরিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে মানুষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলে, আমলাতন্ত্র ভাগ হয়ে যায় দুই ভাগে। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সদস্যরা, সীমান্ত পাহারা আর যুদ্ধের দায়িত্ব পড়ে সামরিক আমলাতন্ত্রের উপর। সময়ের সাথে রাষ্ট্রের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রের আকৃতিতেও। ফলে, আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, পরিবর্তন ঘটেছে সামরিক বাহিনীগুলোতে, বিপুল বিবর্তন এসেছে আমলাতন্ত্রের কার্যপরিধি আর কার্যপ্রকৃতিতে।
প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলো আমলাতন্ত্রের নতুন একটি বিবর্তন, যেটি ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে জাতিরাষ্ট্রগুলোতে। সাধারণভাবে, এরা আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত, পরিচয় আছে বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবেও। প্যারামিলিটারি বাহিনী সাধারণত একটি সংগঠিত আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ হন, তাদের ইউনিফর্ম থাকে, বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনার জন্য থাকে অস্ত্রের মজুতও। কাঠামোগতভাবে, প্যারামিলিটারি বাহিনী সামরিক বাহিনীর মতোই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, কার্যকর চেইন অফ কমান্ড রয়েছে। সাধারণত, প্যারামিলিটারি বাহিনী অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে, তবে সাধারণ পুলিশের চেয়ে তাদের কাজ হয় ব্যতিক্রম। সাধারণত, পুলিশ যেসব অপারেশন পরিচালনা করতে পারে না, প্যারামিলিটারি বাহিনী সেই অপারেশনগুলো পরিচালনা করে। সেসব করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আর সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, নাগরিক জীবনের সরল; প্রবাহ নিশ্চিত করতে।
সাধারণত, প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং পুলিশ থেকে আলাদা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা হয় সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং থেকেও। তবে, প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যরা সাধারণত সামরিক বাহিনীর আদলে প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ট্রেনিং সামরিক বাহিনীর চেয়েও বিশেষায়িত হয়। প্যারামিলিটারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণও বিভিন্ন দেশে হয় বিভিন্ন রকম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্যারামিলিটারি বাহিনী সাধারণত নিয়ন্ত্রিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে, ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে প্যারামিলিটারি বাহিনী থাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
দায়িত্ব আর কাজের পরিধিতে ভিন্নতা থাকলেও, অধিকাংশ দেশেই রয়েছে প্যারামিলিটারি বাহিনীর উপস্থিতি। কিছু কিছু দেশে দাঙ্গার মতো ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকে পুলিশ বাহিনীর কাছে, আবার সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে এই দায়িত্ব অর্পিত হয় প্যারামিলিটারি বাহিনীর কাছে। নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শক্তিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার কাজও করে প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলো, অনেক সময়ই পরিচালনা করে বিশেষায়িত উদ্ধার অভিযান।
প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা
স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র আর ব্লকের মধ্যে নিরাপত্তার সংকট স্থিমিত হয়েছে, বেড়েছে সংলাপের চর্চা। বেড়েছে সংলাপের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করার ঘটনা। ফলে, পূর্ণাঙ্গ সামরিক বাহিনীর কাজের পরিধি সীমিত হয়েছে, কমেছে তাদের ভূমিকাও। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘাত কমায় কমেছে যুদ্ধের ঘটনাও। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর প্রথাগত ভূমিকার তাই হ্রাস ঘটেছে, রাষ্ট্রগুলো তাই অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিয়ন্ত্রণের দিকে অধিক মনোযোগ দিতে পেরেছে, বিপুল বাজেট এসেছে এ খাতে।
রাজনৈতিক বিতর্ক
তবে, প্যারামিলিটারি বাহিনী তৈরির ব্যাপারে রাজনৈতিক বিতর্কও আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো দেশগুলোতে কেন্দ্রীভূত পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারেই আইনসভার সদস্যদের একটি ভয় সবসময় কাজ করেছে, সীমিত করতে চেষ্টা করেছে এক্সিকিউটিভ ক্ষমতার চর্চা।
এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত প্যারামিলিটারি বাহিনীর উপস্থিতি সবসময়ই রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় উদ্বেগের নিয়ামক। কারণ, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকায় এরা বিপুল এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পায়, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক বিবর্তন
এই রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই, অধিকাংশই দেশেই সাংবিধানিকভাবেই প্যারামিলিটারি বাহিনী তৈরি করেছে, গড়ে উঠেছে এই ঘরানার বাহিনীগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলোও নিষ্ঠার সাথে পালন করছে তাদের দায়িত্ব, নিশ্চিত করছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আর শৃঙ্খলা, বিভিন্ন দেশে তাদের ভূমিকা আছে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে। তবে, দেশভেদে এই ঘরানার বাহিনীগুলোর ক্ষমতার চর্চার ধরনের যে পার্থক্য রয়েছে, তার দায়ভার যার রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণ আর নাগরিক সহনশীলতার উপর। সংঘাত একটি সমাজের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ফলাফল। ফলে, সংঘাত নির্মূলের মূল দায়ভার যায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত শক্তি, ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের উপর। এরমধ্যেও, বিশেষায়িত দায়িত্ব আর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথেই পালন করছে প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যরা, বজায় রাখছে নাগরিক শৃঙ্খলা।
বিভিন্ন দেশের প্যারামিলিটারি বাহিনী
ফ্রান্সের প্যারামিলিটারি বাহিনীর নাম ‘গ্যান্ডারমেরি’ (gendarmerie)। এটি ফ্রান্সের জাতীয় প্যারামিলিটারি বাহিনী, যাদের কাজ স্থানীয় এবং জাতীয় পুলিশ থেকে কার্যকরভাবে আলাদা। পুলিশের দৈনিক কাজগুলো সাধারণত এই বাহিনী করে না, এদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সাধারণত সহিংসতা, সংঘাত আর দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করে এই বাহিনী, যেটি প্যারামিলিটারি বাহিনী হিসেবে পরিচিত।
জার্মানিতে পুলিশ বাহিনীর কাজের বিরাট পরিধি রয়েছে, রয়েছে রাষ্ট্র স্বীকৃত উপায়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধা। এরপরও, জার্মান সরকার সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য একতি প্যারামিলিটারি বাহিনী গড়ে তুলেছে, যেটির নাম ‘ল্যান্দার’ (Lander)। সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি, এই বাহিনীকে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, রয়েছে সামরিক বাহিনীর মতো অস্ত্রের যোগান।
যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিকভাবে কোনো প্যারামিলিটারি বাহিনীর উপস্থিতি নেই। কিন্তু, বিশেষ বিশেষ ঘটনার তড়িৎ পাল্টা পদক্ষেপ, উদ্ধার অভিযান, নিরাপত্তার সংকটগুলো মোকাবেলার জন্য একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী তৈরির আলোচনা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে, এই আলোচনাতে সম্মতি রয়েছে উদারপন্থী লেবার পার্টিরও। দ্রুত যুক্তরাজ্যে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যেতে পারে।
উত্তর কোরিয়াতে প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য আছে ষাট লাখের মতো, উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে প্যারামিলিটারি বাহিনী আছে ত্রিশ লাখের মতো। দক্ষিণ কোরিয়াতে প্যারামিলিটারি বাহিনী অনেকটা রিজার্ভ ফোর্সের মতো, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে সেখানে বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং নিতে হয়। ভারতে প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৫ লাখের কাছাকাছি, যাদের বড় একটা অংশ কাজ করে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে। সমাজতন্ত্রী কিউবার প্যারামিলিটারি বাহিনীর আকার এগারো লাখের মতো, ইরানেরও প্রায় একই সংখ্যক সদস্য আছে প্যারামিলিটারি বাহিনীতে। এর বাইরে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে, পাকিস্তানের প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলোর সর্বমোট সদস্য পাঁচ লাখের মতো, আফগানিস্তানের দেড় লাখের মতো, শ্রীলঙ্কাতে প্যারামিলিটারি আছে নব্বই হাজারের মতো।
বাংলাদেশের প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলো
বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলোর সদস্য সংখ্যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ, বাংলাদেশের প্যারামিলিটি বাহিনীগুলোর সর্বমোট সদস্য প্রায় আটষট্টি লাখের মতো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্যারামিলিটারি বাহিনীও বাংলাদেশের, বাংলাদেশ আনসারের সদস্যসংখ্যা প্রায় ষাট লাখের মতো। বাংলাদেশ আনসার গ্রামীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে, ক্ষেত্রবিশেষে কাজ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবেও। এর বাইরে, বাংলাদেশ আনসার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করে, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনেও কাজ করে এই বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে এই বাহিনীর কাজের পরিধি মেট্রোপলিটনগুলোতে বিস্তৃত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে শিল্প অঞ্চলগুলোতেও। ভিআইপিদের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি এই বাহিনী যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর সাথে স্মমুখ সমরে অংশ নেওয়ার ট্রেনিং লাভ করে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত এবং পরিচিত প্যারামিলিটারি বাহিনী হচ্ছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, সংক্ষেপে যে বাহিনী বিজিবি নামে পরিচিত। প্রায় অর্ধলক্ষ সদস্যের এই বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে, ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই বাহিনীর বর্তমান প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে সীমান্তের সুরক্ষা দেওয়া, সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকানো, অবৈধ পণ্যের প্রবেশ আটকানো। এই দায়িত্বগুলোকে কেন্দ্র করেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মূলমন্ত্র নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী’। এই বাহিনীর অফিসার পর্যায়ের নেতৃত্ব সাধারণত আসে সেনাবাহিনী থেকে।
সীমান্তে নিরাপত্তার দায়িত্বের পাশাপাশি বিজিবি মাদক চোরাচালান রোধে কাজ করে, কাজ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মাদকের ব্যবসার বিস্তার আটকাতেও। অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে বিজিবি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগী হিসেবে কাজ করে, যুদ্ধকালীন সমরে অংশ নিতে পারবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে। তবে, বাংলাদেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে এই বাহিনীর সংযুক্তি থাকায়, সময়ের সাথে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কের সূচনা হয়েছে এই বাহিনীকে কেন্দ্র করে।
এর বাইরে, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড নামে আরেকটি প্যারামিলিটারি বাহিনী আছে বাংলাদেশের। এই বাহিনীর কাজ সমুদ্রের নিরাপত্তা রক্ষা করা, সমুদ্রসীমায় নজরদারি করা, সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা। বিজিবির মতো এই বাহিনীতে অফিসার পর্যায়ের সদস্যরা আছে সামরিক বাহিনী থেকে, এদের নেতৃত্বও আসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে। তবে, এই বাহিনী আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট, মাত্র সাড়ে তিন হাজার সদস্য রয়েছে এই বাহিনীর। র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (RAB) ও প্যারামিলিটারি বাহিনীগুলোরে অন্তর্ভূক্ত।